ছবিটিতে একটি দৃশ্য ছিল এমন-
জাফর ইকবাল গ্রাম থেকে ঢাকায় নতুন এসেছেন। আজিমপুর যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিলেন।
নিয়তির নির্মম পরিহাস, ছবিটি মুক্তির এক মাসের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন জাফর ইকবাল।
এরপর আজিমপুরে গোরস্থানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি।
‘লক্ষ্মীর সংসার’ই ছিল জাফর ইকবালের শেষ ছবি। তবে তার জীবিত অবস্থায় মুক্তি পায় এটি।
বেঁচে থাকলে আজ ২৫ সেপ্টেম্বর জাফর ইকবালের বয়স হতো ৬৮ বছর।
গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় অকাল প্রয়াত এই নায়ককে স্মরণ করছেন ভক্ত-দর্শকরা।
আশির দশকে জাফর ইকবাল ছিলেন দেশীয় চলচ্চিত্রের নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ও ফ্যাশন সচেতন। সেই সময়ে তরুণরা ফ্যাশন আইকন ভাবতো তাকে।
জাফর ইকবাল ছিলেন তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা একজন শিল্পী।
হাফ হাতা গেঞ্জি, চোখজোগা সানগ্লাসে ঢেকে বা চুলের বাহারি স্টাইলে তখনকার তরুণ প্রজন্মে তুমুল জনপ্রিয়তা পান জাফর ইকবাল।
অভিনয় ও ফ্যাশনের সম্মিলনে ছিলেন ক্রেজ। সাদামাটা পোশাকেও দারুণ লাগতো তাকে।
গলা কাঁপিয়ে একটা দারুণ রেশ তৈরি করে সংলাপ বলে অাকর্ষণ ধরে রাখার দক্ষতা ছিল অন্যরকম।
১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে জন্মগ্রহণ করেন জাফর ইকবাল। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ।
বড় ভাই প্রয়াত সুরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ ও ছোট বোন কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ।
ভাইবোনের মতো নিজেও গাইতে ভালোবাসতেন জাফর ইকবাল।
কারও কাছে গান শেখেননি।
তবুও খুব ভালো গাইতে পারতেন।
জাফর ইকবালের গাওয়া জনপ্রিয় কয়েকটি গান হলো-
‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’, ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে পুড়ে’, ‘যেভাবে বাঁচি, বেঁচে তো আছি’, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে’।
প্রায় ২০০টি গান গেয়েছেন জাফর ইকবাল।
চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় গানে আর ক্যারিয়ার গড়া হয়নি।
এ ছবির ‘যারে যাবি যদি যা, পিঞ্জর খুলে দিয়েছি’ গানে জাফর ইকবালের বরফ শীতল অভিব্যক্তি আজও দর্শকদের চোখে ভাসে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর আবারও যোগ দেন চলচ্চিত্রে।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন জাফর ইকবাল।
শহুরে রোমান্টিক ও রাগী তরুণের ভূমিকায় দারুণ মানালেও যেকোনও চরিত্রে অবলীলায় মিশে যাওয়ার দক্ষতা তাকে পৌঁছে দিয়েছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
প্রেমিক, পুলিশ অফিসার, মাস্তান, পিতৃহত্যার প্রতিশোধপরায়ণ সন্তান, ডাক্তার, ভিখারি, গায়ক- রূপালি পর্দায় জাফর ইকবালকে বিচিত্র ধরনের চরিত্রে দেখা গেছে।
‘এক মুঠো ভাত’ ছবির কঠোর সমাজ বাস্তবতায় বিপথগামী এক তরুণ, ‘মাস্তান’ ছবির প্রেমিক যুবক, ‘নয়নের আলো’তে গ্রাম থেকে শহরে আসা গায়ক, ‘অবুঝ হৃদয়’ ছবির প্রেমের টানপোড়েনে অস্থির তরুণ, ‘ভাইবন্ধু’ ছবির অন্ধ গায়ক ও ‘বন্ধু আমার’ ছবির বন্ধুবৎসল চরিত্র, ‘অপেক্ষা’য় মায়ের আদর থেকে দূরে পিতার কাছে বেড়ে ওঠা যুবক, গর্জন ছবিতে প্রথমে শহরের মাস্তান ও পরে পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় তার অভিনয় ভোলার নয়।
বাণিজ্যিক সিনেমায় দাপটের পাশাপাশি ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর মতো নিরীক্ষাধর্মী ছবিতেও তার অভিনয় পারদর্শিতা ছিল।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সূর্যসংগ্রাম’, ‘সূর্যস্বাধীন’, ‘ভাই বন্ধু’, ‘চোরের বউ’, ‘অবদান’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘ফকির মজনুশাহ’, ‘দিনের পর দিন’, ‘বেদ্বীন’, ‘মিস লংকা’, ‘আবিষ্কার’, ‘বিরহ ব্যথা’, ‘অংশীদার’, ‘মেঘবিজলী বাদল’, ‘সাত রাজার ধন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘নয়নের আলো’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘প্রেমিক’, ‘নবাব’, ‘প্রতিরোধ’, ‘ফুলের মালা’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘সিআইডি’, ‘মর্যাদা’, ‘অবুঝ হৃদয়’ ও ‘সন্ধি’।
জাফর ইকবাল ও ববিতার জুটি ছিল বেশ জনপ্রিয় ও আলোচিত। তারা মোট ৩০টি ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেন।
এক সময় জাফর ইকবাল ও ববিতার সম্পর্ক নিয়ে বেশ গুঞ্জন ওঠে।
‘অবুঝ হৃদয়’ ছবির রোমান্টিক দৃশ্যগুলো সেই গুঞ্জনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
তবে দু’জনের কেউই কখনও বিষয়টি স্পষ্ট করেননি।
জুটি হিসেবে শুধু ববিতা নন; চম্পা, সুচরিতা, রাণী, দিতিসহ সবার বিপরীতেই দর্শকরা জাফর ইকবালকে পছন্দ করেছিল।
ব্যক্তিজীবনে জাফর ইকবাল ছিলেন খামখেয়ালী, আবেগপ্রবণ ও প্রচণ্ড অভিমানী।
ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯২ সালের ২৭ এপ্রিল মারা যান।
সিনেমার গল্পের মতোই যেন এই মৃত্যু!
‘নয়নের আলো’ ছবির ‘এই আছি এই নেই’ গানের কথাই যেন সত্যি হলো।
রূপালি পর্দায় অসাধারণ অাখ্যান তৈরি করে যাওয়া জাফর ইকবাল চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন দর্শকদের হৃদয়ে।