আইয়ুব বাচ্চু: ফরেস্ট হিল থেকে সুরের মহাসাগরে

সুরতাল, বিনোদন

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 01:58:24

চট্টগ্রাম মহানগরের নাসিরাবাদের ফরেস্ট হিল থেকে উত্থান হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চুর। অরণ্যময় এই টিলায় গানের তালিম নিতে নিতে বন্দরনগরীর কয়েকজন তরুণ শিল্পী ক্রমে ক্রমে মাতিয়ে ছিলেন তাবৎ বাংলাদেশের সঙ্গীত জগত। আশি দশকে আরও অনেকের সাথে ‘সোলস’ নামের আলোচিত সঙ্গীতদল গড়েছিলেন তিনিও। বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) সকালে যখন তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেলাম, আমি তখন চট্টগ্রামের সেই ফরেস্ট হিলের পাশেই। ফরেস্ট হিলের ঝাউ, দেবদারু, ইউক্যালিপটাসের শোকস্তব্ধ পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো মানুষেরও মতো বৃক্ষরাজিকেও স্পর্শ করেছে প্রিয়শিল্পীর চিরপ্রস্তানের নীলবেদনা।

হয়ত কাকতালীয়, তবু উল্লেখ করি, নব্বুই দশকের শুরুতে ‘সোলস’ ছেড়ে আইয়ুব বাচ্চু যখন ‘এলআরবি’ বা ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ গঠন করেন, তখন এলিফ্যান্ট রোডের এক চৈনিক রেস্তরাঁয় আয়োজিত সাংবাদিক সন্মেলনে আমিও উপস্থিত ছিলাম। তার সঙ্গে আরও অনেক অনেক দিন কেটেছে ঢাকার মগবাজার কাজি অফিস লেনের আড্ডায়, রিহার্সালে। নতুন অ্যালবাম ও গানের সূচনার স্বাক্ষী হয়ে দেখেছি সঙ্গীতের জন্মযন্ত্রণা। গানের কথা ও সুর সৃজনের পরিশ্রমী প্রয়াসের স্মৃতিমালার মধ্যে আইয়ুব বাচ্চু আমাদের আচ্ছন্ন করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। একটি পাহাড়ের শীর্ষ থেকে গানের এক ছোট্ট নদী হয়ে তিনি অন্তলীন মিশে গেছেন সুরের মহাসাগরে।

গিটারে অসামান্য দক্ষতা ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। সুর ভেঙে সুর গড়তে পারতেন অবলীলায়। আধুনিক মিউজিক্যাল ইন্ট্রুমেন্টগুলোকে অনন্য লহরীতে সমন্বিত করে তৈরি করতে পারতেন অসামান্য সিম্ফনি। পপ, রক অ্যান্ড রোল, কান্ট্রি মিউজিকের সমকালীন ফিউশন ধ্বনিত্ব হয়েছে তার গানে ও অ্যালবামে। তার গানে আরও ছিল তারুণ্যের লেলিহান যন্ত্রণায় বাতাস বিদীর্ণ করা আর্তি। বেদনার প্রতিধ্বনি। তার প্রায়-প্রতিটি গানেই নাগরিক জীবনের ব্যক্তিক হাহাকার মূর্ত হয়েছিল। 

অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ব্যান্ডসঙ্গীতে আইয়ুব বাচ্চুর ছিল বিপুল সংখ্যক নিজস্ব শ্রোতাগোষ্ঠী। অ্যালবামের পাশাপাশি খোলা মঞ্চে মাতিয়েছেন তিনি হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো ছিল তার সঙ্গীতময় পদচারণায় মুখরিত। আশি ও নব্বই দশকের বাংলাদেশের সঙ্গীতের আলোচনা তাকে বাদ দিয়ে অসম্ভব। সে সময়ে দ্রোহী তারুণ্যের আইকন ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু।

সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি গভীরভাবে ভাবাতেন তিনি। গানকে নিয়ে যেতে চাইতেন অনুভবের সূক্ষ্ণতম স্তরে। তীব্র যান্ত্রিক অনুষঙ্গের উচ্চকিত শব্দে তার গানগুলো সুতীব্র মূর্ছনা জাগালেও সেগুলোর অন্তর্নিহিত ভাব ও বাণী স্পর্শ করতো শ্রোতার অন্তর্গত হৃদয়। প্রেম-অপ্রেম, চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-হতাশা, স্মৃতি-বিস্মৃতি-নস্টালজিয়ার ঘন বুননে রচিত তার গানগুলো সুরের ইন্দ্রজালে শ্রোতাদের ভাসিয়ে দিত এমন এক অদেখা আকাশে, তাকে কাঁদালে বা কষ্ট দিতে সেই আকাশেই অভিমানে উড়াল দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি।

‘আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেবো আকাশে’র মতো মর্মস্পর্শী গানের শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু সবাইকে কাঁদিয়ে সত্যি সত্যি উড়াল দিলেন আকাশের রহস্যময় দিগন্ত পেরিয়ে স্বপ্নময় অন্তরীক্ষে। এই হেমন্তের বিষণ্নতা-ভরা মায়াবী প্রকৃতিতে মৃত্যুর অমোঘ পদচিহ্ণে ৬০ বছরের সঙ্গীতময় জীবনের যবনিকাপাত টেনে তিনি চলে গেলেন চিরতরে। রেখে গেলেন মায়াবী ফরেস্ট হিল, সমুদ্র, নদী ও বৃক্ষের চট্টগ্রাম এবং রাজধানী ঢাকার নাগরিক জীবনের ঘেরাটোপে বন্দি একখণ্ড আকাশের সুনীল বুকে ভাসমান মেঘে মেঘে সঞ্চারিত অসংখ্য গানের ভেলা।

জৈবিক অর্থে তিনি চলে গেলেও চৈতন্যের অনুভবে সঙ্গীতের ছোট্ট নদীর আদলে তাকে বার বার খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের সুরের অতলান্তিক মহাসাগরে। বাংলা ভাষা, গান, সুর ও বাঙালিত্বের শাশ্বত পাটাতনে সাংস্কৃতিক আবহে বেঁচে থাকবেন প্রিয়শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু।

এ সম্পর্কিত আরও খবর