শোকের শহরে বীরের প্রত্যাবর্তন

সুরতাল, বিনোদন

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-24 21:57:50

চট্টগ্রাম থেকে: শনিবার (২০ অক্টোবর) চট্টগ্রামের অন্য নাম ‘শোকের শহর’। শেষ বারের মতো প্রিয় শহরে ফিরে আসেন এই সবুজ শহরের প্রিয়তম সন্তান। বীরের শোকাবহ প্রত্যাবর্তনের অভিঘাতে অতলান্ত বেদনা-মথিত শহরের প্রতিটি নাগরিক। শোকে মূহ্যমান প্রকৃতি ও পরিবেশ।

২০ অক্টোবর দিনটি সত্যিই তীব্র বেদনার। হাজার বছরের ঐতিহ্যময় জনপদ চট্টগ্রামের ইতিহাসে অমোচনীয় ব্যাথার কালো কালিতে লিপিবদ্ধ দিনটি। শোকের চাদর হয়ে শহর চট্টগ্রামে এমন দিন অনেকদিন আর আসেনি। বিশ্বজয়ী বীরের শোক জাগানিয়া এমন প্রত্যাবর্তনের কথা কেউ কল্পনা করেনি কখনোই। ব্যথিত জনসমুদ্রে শোক-উত্তাল দিনটি প্রিয়জন হারানোর বিচ্ছেদের ইতিকাহিনীর মতো এক ট্র্যাজিক উপাখ্যান যেন।

নগরের পথে পথে পুঞ্জিভূত মানুষের বুকভরা হাহাকার মাখানো এই দিনে দক্ষিণের সমুদ্রস্পর্শী-পতেঙ্গা থেকে ভেসে আসে দুখী মেঘের দল। সকাল থেকেই চট্টগ্রামের আকাশ মনভার-করা ব্যাথায় কাতর। ঝরঝরে হেমন্তের রোদমাখা দিনটিও ম্লান আর বিদীর্ণ হলো কফিনবাহী বিমানের আগমনে। তিনি এলেন তার প্রিয়তম শহরে শেষশয্যা গ্রহণের চির-অবকাশে। শোকস্তব্ধ পুরো শহর ভেঙে পড়লো বীর নায়কের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়। শোকমগ্ন বরণের ঢালি নিয়ে অপেক্ষমাণ জনতার রোদন যেন বাতাসকে ভারি করেছে অনেকটাই।

আদি চট্টগ্রামের হৃৎপিণ্ডর কাছে অবস্থিত পুরনো মহল্লা এনায়েত বাজারের রবিন নামের ছেলেটি সুর আর সঙ্গীতের ইন্দ্রজালে ভুবন বিজয় করে ফিরে আসছেন। তিনি আসছেন আর কখনোই না ফিরে যাবার প্রত্যয়ে। রবিন থেকে বাংলাদেশের আধুনিক রক গানের আইকনে পরিণত আইয়ুব বাচ্চু জন্ম নিয়েছেন এই শহরে; বার বার ফিরেও এসেছেন। আজ তিনি এলেন না ফেরার গান হয়ে।

তিনি এলেন তার প্রিয় শহরে; শহরের বনানী ও পাহাড়ের আচ্ছাদনে ঘেরা শ্যামলিম ভূগোলে। নদী কর্ণফূলী আর বঙ্গোপসাগরের ক্লান্তিবিহীন ঢেউয়ের কাছে। বাইশ মহল্লার কবরগাহের সারি সারি নিদ্রামগ্ন মানুষের মিছিলের ঠিকানায়; মায়ের শেষশয্যা পাশে।

কালো ব্যাজ আর পুষ্পিত স্তবক হাতে অগণিত ভক্তের গন্তব্য প্রিয় শিল্পীর সাণ্নিধ্যে এগিয়ে চলে দিনময়। এনায়েত বাজার, নানাবাড়ি, জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের দিকে তাদের গন্তব্য। জীবিত আইয়ুব বাচ্চুর মতোই প্রাণহীন আইযুব বাচ্চুকে অনুসরণ করছে মানবস্রোত। জীবনে বা মরণে মানুষের হৃদয়েই যেন চির ঠিকানা এই চিরায়ত শিল্পীর। সজিব আর প্রাণবন্ত তিনি জনরবের শিহরণে। জীবনে আর মরণেও সমান লোকপ্রিয়।

শহর ছাড়িয়ে উপশহর আর শহরতলী থেকেও দলে দলে আসছে তরুণ-তরুণী, ভক্ত-শ্রোতার দল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো থেকে দলবদ্ধ হয়ে এসেছে বহুজন। ষোলশহর, নাসিরাবাদ, জিইসি মোড় পেরিয়ে দামপাড়া ওয়াশার মোড় থেকে জামিয়াতুল ফালাহ ময়দানে দেখা যাচ্ছে উপচানো ভিড়। পুরো চট্টগ্রাম শহরের এক ও অভিন্ন গন্তব্যের নাম আজ আইয়ুব বাচ্চু।

কেন এতোটা গভীরভাবে মানুষকে টেনে নিতে পারলেন তিনি? কি ছিল তার জাদু? দৃশ্যত উচ্চকণ্ঠ ও সুতীব্র যন্ত্রের আড়ালে রক অ্যান্ড রোল গানের মধুময়তা সচরাচর ধরা পরে না। মনে হয় প্রচণ্ড শব্দ নিনাদে হারিয়েছে সুর ও সঙ্গীতের সুষমা। আসলেই কি তাই? মোটেও নয়। তিনি তার গানে স্পর্শ করেছিলেন শাশ্বত মানব হৃদয়। পৌঁছে গিয়েছিলেন আনন্দ-বেদনা-আধ্যাত্মিকতার বাহন হয়ে মানবাত্মার চৌকাঠে।

‘আমার বহু বহু বিষণ্ন দিন আর রাত্রিগুলো কেটেছে তার গানের সঙ্গে। যখন মন ভালো না লাগে, বিষণ্নতার অন্ধ-অন্ধকার চেপে ধরে, তখন তার গান আলো ও হাওয়ার সন্ধান দেয়। প্রাণের ঊষর ভূমিতে জীবনের পরশ দিয়ে যায়’, লালখান বাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললেন সাবিহা সানজিদা। তার ছলছল চোখ তাকিয়ে আছে অদূরের ঈদগাহ ময়দানে। জনস্রোত যেখানে শেষ আলিঙ্গন করছে প্রিয় শিল্পীকে।

সাবিহার সঙ্গে এসেছে অপূর্ব শামস। বাহুতে কালো কাপড়ের শোকচিহ্ন। হাতে তার একগুচ্ছ পুষ্পাঞ্জলী। ‘বাইরে থেকে আইয়ুব বাচ্চুর গান পুরোটা বোঝা যাবে না। তার গানের অনেক ভেতরে গেলে শুনতে পাই আমারই কথা। আমরা রাগ-ক্ষোভ-হতাশা-পাওয়া-না-পাওয়ার কথাগুলোই তিনি ব্যক্ত করেছেন। আমি আমার চেতনা ও আবেগের অব্যক্ত কথাগুলো বলার ভাষা পাই তার গানে’, জানালেন এই তরুণ।

সাবিহা বা শামসের মতো শত সহস্র তরুণের দখলে আজ চট্টগ্রামের পথগুলো। এভিনিউগুলো ভেসে যাচ্ছে তারুণ্যের পদভাবে। খানিক এগিয়ে ইস্পাহিন মোড়ে দেখা মেলে অভিন্ন জনস্রোত। একজন কফিনবন্দি মানুষ তার শারীরিক উপস্থিতির মতোই টেনে নিচ্ছেন জন মানুষের আগ্রহ ও হৃদয়ের অনেকটুকু। এমন মানবজনম অনেকেরই হয় না। আইয়ুব বাচ্চুর হয়েছে। ভালোবাসার আস্ত একটি সমুদ্র মানুষের মধ্যে ঢেলে দিয়ে মানুষের কাছ থেকে তিনি প্রতিদানে ফেরত পেয়েছেন ভালোবাসার অখণ্ড এক মহাসমুদ্র।

জানাজা শেষে চিরঘুমে তিনি চলে যাবেন মাটির সুগভীর বুকে। তার গান থেকে যাবে জাগ্রত বাংলাদেশে। বাংলা ও বাঙালির চিরকালীন সুরের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে তিনি রইবেন। ঢাকায়, চট্টগ্রামে, ফরেস্টহিলে, সমুদ্র উপকূলে, ক্যাম্পাসে ক্যম্পাসে একটি অদেখা পাখির গানে ও সুরে কল্লোলিত হবেন আইয়ুব বাচ্চু। মৃত্যু নামের বিদায় ও বিচ্ছেদকে অতিক্রম করে ছন্দ ও তানের ঝঙ্কারে তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদেরই মাঝে।

প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু, বাংলাদেশের এবি, আমাদের চট্টগ্রামের রবিন, সবাইকে কাঁদিয়ে ঠিকই উড়াল দিলেন আকাশে, সুরের চিরন্তন পাখি হয়ে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর