রেহানা মরিয়ম নূর: নারীবাদ নয়, ব্যক্তিগত ইগোর বহিঃপ্রকাশ

সিনেমা, বিনোদন

শুভ্রা গোস্বামী, অতিথি লেখক | 2023-09-01 09:18:16

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সিনেমা অঙ্গন কাঁপছে 'রেহানা মারিয়াম নূর' জ্বরে। কান উৎসব থেকেই এই সিনেমা নিয়ে বাংলাদেশের দর্শকের মধ্যে শুরু হয়েছে নানান জল্পনা কল্পনা। অবশেষে বাংলাদেশের দর্শক এই সিনেমাটি দেখার সুযোগ পেয়েছে। রিলিজের পর থেকেই নানান দর্শকের ছিল নানান ধরনের অভিমত।

কারো কাছে এই সিনেমা নারীবাদের প্রতীক, কেউ দেখছেন প্রচণ্ড সাহসী সিনেমা হিসেবে, কেউ আবার এই সিনেমার মূল চরিত্র আজমেরী হক বাঁধনের ব্যক্তিগত জীবনের লড়াই এর সাথে এই সিনেমাকে গুলিয়ে ফেলছেন। কেউ বলছেন টেকনিক্যালি খুবই রিচ এই সিনেমা আবার কারো কাছে ক্যামেরার কাজ বিরক্তিকর মনে হয়েছে। সম্প্রতি দেখে এলাম রেহানা মারিয়াম নূর। নানান দেশের নানান ভাষার চলচ্চিত্র দেখার সুবাদে আমার মনে হয়েছে নিজের দেশের এই সিনেমা নিয়ে যে আলোচনাগুলো হচ্ছে সেগুলো আসলে অনেকাংশে অতিরঞ্জিত।  

প্রথমত বাংলাদেশের নব্য নারীবাদীরা মনে করছেন, এটা প্রচন্ড রকমের নারীবাদী সিনেমা, এই সিনেমায় নাকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখে ঝামা ঘষে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে নারীবাদ চর্চার এখন থার্ড ওয়েভ চলে। এবং এই থার্ড ওয়েভে এসে নারীবাদীরা নারীবাদ বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলছেন। যেমনটা কিছুদিন আগে নায়িকা পরিমনি ইস্যুতেও আমরা দেখেছি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই সেটা নারীবাদ হয়ে যায় না। এমনকি পুরুষের প্রতি ঘৃণা, কিংবা কারো ব্যক্তিগত জেদকেও নারীবাদ বলা যায় না। নারীবাদ একটা দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন।

নারীবাদী সিনেমার উৎকৃষ্ট  উদাহরণ আমাদের পাশের দেশেই আছে। আপনারা ‘পিংক’ কিংবা ‘থাপ্পড়’ সিনেমাটা দেখে থাকলে বুঝবেন যেখানে সরাসরি নারীবাদকে প্রমোট করা হয়েছে। ‘থাপ্পড়’ সিনেমায় মূল চরিত্রে যিনি ছিলেন তার জেদ আর রেহানা মারিয়াম নূর সিনেমার মূল চরিত্রের জেদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় চলচ্চিত্রটির

রেহানা মারিয়াম নূর-এ আমরা যেটা দেখি সেটা স্পষ্টত ব্যক্তিগত ইগোর বহিঃপ্রকাশ। চরিত্রটি শুরু থেকেই এংগজাইটিতে ভুগত এবং তার ইগো এতটাই বেশি যে নিজের সন্তানও সেই ইগোর হাত থেকে রক্ষা পায় নি। অপরদিকে ‘থাপ্পড়’ সিনেমায় সাধসসিধা এক গৃহবধূর লড়াই আমরা দেখি। যাকে তার স্বামী কোন দোষ ছাড়াই থাপ্পড় মেরেছিল এবং সে সেটা মেনে নিতে পারেনি তাই পরিবার ,সমাজের সাথে যুদ্ধ করে সে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছিল। কাজেই মানসিক ভাবে অস্থির, একজন ওসিডি পেশেন্টকে শুধুমাত্র অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারনে নারীবাদী বানিয়ে দিলে ঝামেলা। আমরা যেটা সচরাচর করে থাকি।

হ্যাঁ চরিত্রটি অসম্ভব সাহসী, বাস্তববাদী তবে সে নারীবাদী নয়। নারীবাদী হলে ওই শিক্ষককে শাস্তি দেবার জন্য এনির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিজের বলে মিথ্যা অভিযোগ করতেন না বরং ঠান্ডা মাথায় ভিন্ন উপায়ে ওই শিক্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করতেন। এখানে শুধুমাত্র নিজের জেদ, ব্যাক্তিগত ট্রমা আর ইগোকে স্যাটিসফাই করেছেন তিনি। নিজের মেয়ের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। তার মেয়েকে তিনি পুরো ঘটনা না বলে, না বুঝিয়ে শুধু নিজের ইগোকে জিতিয়ে দিতে জঘন্য খারাপ ব্যবহার করেছেন। যাকে নব্য নারীবাদীদের নারীবাদ বলে মনে হতেই পারে তবে নারীবাদ এতটা স্থুল নয়।

এবার টেকনিক্যাল জায়গায় যদি আসি, তবে দেখব যে ক্যামেরার অতিরিক্ত নড়াচড়া দর্শকের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করেছে। অনেকেই বলছেন দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলতে ডিরেক্টর এটা ইচ্ছে করেই করেছেন। সেটা মানছি। মাথায় আপনি বাড়ি মেরে বুঝাতেই পারেন যে এই সিনেমা আরাম পাবার জন্য নয় কিন্তু চোখের কথাও তো ভাবতে হবে স্যার।

এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডে দু’টি পুরস্কার জেতে চলচ্চিত্রটি

বার্টল ব্রেখট একজন মার্ক্সবাদী নাট্যকার ছিলেন। তিনি তার প্রযোজনাগুলোতে এলিয়েনেশন থিওরি ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ কোন ইমোশনাল মুহূর্তে দর্শকের মোহ ভেঙ্গে দিয়ে তাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনা। তিনি মনে করতেন দর্শক নিষ্ক্রিয় নয়। তাদেরকে ভাবাতে পারলেই থিয়েটার সফল। সেই থিওরি অনুযায়ী চিন্তা করলেও আমরা এই সিনেমায় মোহ ভঙ্গের কিছু বিষয় দেখতে পাই, তবে সেটা দর্শককে ভাবানোর চাইতে বিরক্তিতে ফেলেছে বেশি। আমি নিজেই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম কারন ব্যথা করছিল। মাথার আরাম চাইছিও না কারন বিষয়বস্তু আরামের নয় কিন্তু চোখের আরাম ভীষণ প্রয়োজন ছিল। তবে ফলো শট, কিছু জায়গায় ফোকাস ডিফোকাসের খেলাগুলো বেশ ভালো লেগেছে।

কালার গ্রেডেশন নিয়েও অনেকের নানান মতামত দেখা গেছে। এ ধরনের কালারে বাংলাদেশে খুব একটা সিনেমা দেখা যায়নি। বিষয়বস্তুর সাথে সিনেমার কালার আমার কাছে বেশ সামঞ্জস্যপূর্নই মনে হয়েছে। তবে লাইটের খেলা আরেকটু খেলতে পারতেন ডিরেক্টর। কিছু কিছু জায়গায় অযথা শ্যাডো চলে এসেছে যেটা সিনের সৌন্দর্য নষ্ট করেছে।

অভিনয় নিয়ে কোন কথা নাই। বাঁধনের এটা এখনো পর্যন্ত বেস্ট কাজ। বাকি সবাই বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। আরেফিন চরিত্রের ডায়লয় থ্রোয়িং এ শুরুর দিকে ঝমেলা মনে হলেও পরবর্তীতে সেটাকেই ন্যাচারাল মনে হয়েছে। ইমু চরিত্রে বাচ্চাটি বেশ ভালো অভিনয় করেছে।

এই সিনেমায় মিউজিকের তেমন ব্যবহার নাই। তবে আবহসংগীত বেশ ভালো ছিল। কিছু জায়গায় আবার বেশি ও মনে হয়েছে যেমন দরজা খোলা বন্ধ করার শব্দ মাঝে মাঝেই মিলছিল না। তারপরও ফলি নিয়ে বেশ খেটেছেন রেহানা মারিয়াম টিম।

ডায়লগ খুবই পরিমিত পরিমানে ছিল। তবে কিছু জায়গায় চরিত্র কি বোঝাতে চাচ্ছে তা ভালোভাবে বোঝা যায়নি। যেমন রেহানা যতবার ফোনে কথা বলেছে ততবারই ডায়লগ শুনে পুরো পরিস্থিতি কল্পনা করতে হয়েছে কারন এক্সপ্রেশন যতটা বোল্ড ছিল ডায়লগ ততটা ছিল না।

আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা হিসেবে যথেষ্ট ভালো সিনেমা। তবে সিনেমার ভাষা কম মনে হয়েছে সেটা, ডায়লগ, কালার, সিনেমাটোগ্রাফি সব জায়গাতেই। ক্লোজ শটের সংখ্যা খুব বেশি ছিল তাই কিছু কিছু জায়গায় নাটক বা টেলিফিল্মের মতন লেগেছে। কয়েকদিন আগে ‘ধামাকা’ নামে নেটফ্লিক্সে একটা সিনেমা দেখলাম যেখানে একটা স্টুডিও তে পুরো সিনেমা শেষ হয় অথচ শট গুলো কি চমৎকার।

কান উৎসবে প্রযোজক, নির্মাতা, ও অভিনেত্রী বাঁধন

বিষয়বস্তু মানেই সিনেমা নয়। তাহলে তো ক্যামেরা লাগতোই না বই পড়েই সিনেমার স্বাদ নেয়া যেত। আসলে বাংলাদেশে এই ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে সিনেমা হয় না বললেই চলে তাই দর্শক ওভাররেটেড করে ফেলেছেন।

অপরদিকে কান ফেস্টিভ্যাল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  কানে না গেলে এই সিনেমা বাংলেদেশের কতজন দর্শক দেখতেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে দিনশেষে মন্দের ভালো সাদ কে অভিনন্দন এইরকম বিষয়বস্তু নিয়ে সিনেমার গল্প ভাবার জন্য।

 

 

আরও পড়ুন
‘রেহানা মরিয়ম নূর’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ অনুরাগ কাশ্যপ
অ্যাপসায় সেরা ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ও বাঁধন
‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সমালোচনায় তসলিমা, প্রতিবাদী প্রিন্স
এর চাইতেও আরও ভালো কিছু হয়তো করতে পারতাম: সাদ
কানের লালগালিচায় এক টুকরো বাংলাদেশ

এ সম্পর্কিত আরও খবর