আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার নতুন সূর্য

সিনেমা, বিনোদন

গোলাম রাব্বানী, লেখক ও সাংবাদিক | 2023-09-01 15:01:12

একজন গ্রেট ম্যাজিশিয়ানকে যদি আপনি হাত পা বেঁধে ছেড়ে দেন, তবুও তিনি আপনাকে ম্যাজিক দেখাতে পারবেন। যদি তার কলিজায় দম থাকে। 'লাল মোরগের ঝুঁটি' দেখে নূরুল আলম আতিককে সেই ম্যাজিশিয়ানই মনে হয়েছে। যিনি তাঁর ছবির প্রতিটা ফ্রেমে বুনে গেছেন এক রুদ্ধশ্বাস সময়ের গল্প।

ছবির শুরুই হয় একটি অ্যানিমেশন দৃশ্য দিয়ে যেখানে আমরা দেখি দুটো লাল মোরগ লড়াই করছে আর ব্যাকগ্রাউন্ডে শুনতে পাই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ম্যাজিকের শুরুটা এখানেই।

সৈয়দপুর বিমান বন্দরের রানওয়েতে পাকিস্তানি আর্মি ক্যাপ্টেনের জিপে চলতে শুরু করে ছবির সাদা কালো গল্প।


দীপালি আর তার বর পরিমল যখন স্টুডিও ছবি তুলছিল তখন সূর্য সেনের শীতল চোখের ছবি দেখে খুব চমকে ওঠেছিলাম। যাদু দেখার মতো। দূর দেয়ালে ঝুলে থাকা সূর্য সেনও যে এই বাঙালি জাতির অন্দোলন, সংগ্রাম আর যুদ্ধের একটি অংশ। সেটাই যেন নির্মাতা মনে করিয়ে দিলেন। দীপালির ঘরে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের পোস্টার দিয়ে আতিক কীসের ইঙ্গিত দেন সেটা বুঝতে আর কষ্ট হয় না বা পদ্মর সরুইখানায় উর্দু চলচ্চিত্র ক্যাপ্টেন এহতেশামের ‘চকোরী’ ছবির পোস্টারও একটি সময় ও সংস্কৃতিকে বহন করে দেয়ালে ঝুলে থেকে।


ধরণী মোহন ও তার স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য দেখার পর সাহেব আলীর যে মানসিক অবস্থা পাল্টে যায়, তার মনোজগতের অবস্থা বোঝাতে নির্মাতা ফুটন্ত চায়ের কেটলির যে মন্তাজ ব্যবহার করেছেন তা যে কোনো পরিণত সিনেমার দর্শককে নাড়া দেবে বলে আমার বিশ্বাস। ফুটন্ত চায়ের কেটলি তো সাহেব আলীর ভেতরের আগুন ফোটার প্রতীক হয়ে ধরা দেয়।

রেবা যখন বন্দিশালায় ক্যাপ্টেন নকভীর চাবুকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে এক পা শেকলে বাঁধা অবস্থায় নেচে যাচ্ছিলো চোখে মুখে ঘৃণা নিয়ে আর অন্যদিকে রেবার বৃদ্ধা দাদি মোরব্বা বানানোর জন্য চালকুমড়ার ফালিগুলো খেজুরের কাঁটায় কেঁচছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল তিনি যেন আমারই হৃদয় ঝাঁঝরা করে ফেলছেন। এ সিনেমায় আরও কিছু সিম্বলিক ব্যাপার-স্যাপার আছে, যা রস আস্বাদনে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারে।


যেমন ঘোড়া এ ছবির এক নীরব ক্যারেক্টার সব দেখে সহ্য করে যাচ্ছে বুদ্ধর মতো। বুদ্ধ যখন দীঘির পাড়ে দূরে ঘোড়ার গাড়িটা রেখে মদে বুদ হয় রয় তখন সাহেব আলী যে গাছটাকে নিবিরভাবে দেখে, আস্ত একটা সতেজ তাগড়া গাছ কিছু পরগাছার কারণে নিজের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। এই দৃশ্য দেখে সাহেব আলীর মনোজগতে একটা পরিবর্তন দেখি।

এ সিনেমার বড় সম্পদ এর স্ক্রিন প্লে ও ঝরঝরে মচমচে ডায়লগ। ধরণী আর সাহেব আলীর আলোচনায় আমেরিকা আর ভিয়েতনাম যুদ্ধর রেফারেন্সটাও ৭১ এর বিশ্ব রাজনীতির ছায়া ফেলে যায় ছবিটিতে। ক্যাপ্টেন মুনওয়ার আর নকভীর বাহাসের একটা জায়গা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে আমার কাছে, যখন মুনওয়ার বলে- ‘আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন’। তখন নকভী রেগে গিয়ে বলে, ‘আল্লাহ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটোকেই রক্ষা করবে’। এই জায়গাটায় নকভী যেন এক অন্য ক্যারেক্টার হয়ে ধরা দেয় সংলাপের কারণে।


একটা ডায়লগ তো এখন লোকের মুখে মুখে, ‘এপার ওপার বুঝি না, দরকার হইলে পরপারে যামু’ বা বুদ্ধ যেমন বলে ,‘মানোয়া আর মানোয়া নাই রে...’। পুরো সিনেমা জুড়ে পাত্র-পাত্রীর মুখে মেদহীন ডায়লগের কারিশমা কানে ও মনে আরাম দেয়।

ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ড সংগীতও বেশ আরামদায়ক। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে সংগীত সংযোজন করেছেন সংগীত পরিচালক। কাকের ডাক, ঘুঘুর ডাক, রাত বিরাতে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, কুকুরের ডাক, ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ, বিশেষ করে রেডিওর যে অ্যান্টিক সাউন্ড, খুব দারুন।

‘লাল মোরগের ঝুঁটি’র একটা ডায়লগ আছে, ধরণী মোহনকে সাহেব আলী বলেন, ‘আমগো নেতা শেখের ডাকে পান্তা খাওয়া পোলাপাইন আবার ফাইটব্যাক করতে শিখছে।’ তো এই সিনেমার বড় শক্তি এর অভিনয়শিল্পীরা। প্রতিটা চরিত্র যেন নির্মাতার ডাকে আবার নিজেদের সেরাটা দিয়ে ফাইটব্যাক করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।


কোনো রকম ডায়লগ ছাড়াও যে শুধুমাত্র অভিনয় দিয়েই একটি ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে ওঠা যায় তা স্বাগতার অভিনয় দেখলেই আন্দাজ করা যায়। মুখে না বলেও এক্সপ্রেশনে অনেক কথাই বলে দেয় এই চরিত্রটি। এ পর্যন্ত আমি আশনা হাবিব ভাবনার যত অভিনয় দেখেছি, সবকটাকে ছাড়িয়ে গেছে পদ্ম। এই চরিত্রটিই পুরো সিনেমার অন্যান্য পাত্র পাত্রীর চেয়ে একেবারে আলাদা, চলনে বলনে, দেমাগে, ভাষায় আর পোশাকে।

ক্যাপ্টেন নকভী চরিত্রে শাজাহান সম্রাট তো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, বেশ আপস অ্যান্ড ডাউন ছিল চরিত্রটিতে। এক্সপ্রেসশন ডায়লগ থ্রোয়িংয়ে, কণ্ঠ সব মিলিয়ে পুরো সিনেমাটায় এই চরিত্রটি একটি উত্তেজনা ধরে রাখতে পেরেছে।


অদ্ভুত ঘোরলাগা এক চরিত্রে পুরো ছবিটিতে হাজির ছিলেন আহমেদ রুবেল। তার অভিনয় নিয়ে নতুন করে আর কী বলব, তিনি তো পরীক্ষিত। সুযোগের সবটুকু ব্যবহার করেছেন। জয় রাজের অভিনয় মুগ্ধ করবে আপনাকে। পর্দায় একটি বারের জন্য তাকে আমার জয়রাজ মনে হয়নি। তিনি পর্দায় শামছুই ছিলেন। বুদ্ধ চরিত্রে আশীষ খন্দকার পারফেক্ট। জ্যোতিকা জ্যোতি, দোয়েল, অশোক ব্যাপারী, শিল্পী সরকার অপু, অন্তু, ইলোরা গহর প্রত্যেকে ফাইটব্যাক করার চেষ্টা করেছেন।


নির্মাতা ছবিটি শুরু করেছিলেন ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে। সেই ভাষণেই ফিরে যাই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ আর এই পুরো ছবিটি দেখে আমার তাই মনে হয়েছে, ছবির প্রত্যেক শিল্পী, কলাকুশলীরা যার যা আছে তাই নিয়ে ছবিটিতে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন নির্মাতার উপর ভরসা রেখে।

আর তাই বাংলা ছবির ইতিহাসে, মুক্তিযুদ্ধের ছবির ইতিহাসে ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ দাগ কেটে থাকবে। সকল সঙ্কট আর বাধা পেরিয়ে নির্মাতা নূরুল আলম আতিক শেষ পর্যন্ত তার ম্যাজিকটা দেখাতে পেরেছেন ফ্রেমে ফ্রেমে গল্পে আর সংলাপে। আমাদের মুক্তি যুদ্ধের সিনেমার নতুন সূর্য যেন উদয় হলো।

এ সম্পর্কিত আরও খবর