নাভেদ পারভেজ এক দশকের বেশি সময় ধরে সংগীতপরিচালক ও সুরকার হিসেবে কাজ করছেন। তার বেশকিছু গান সুপারহিট হয়েছে। তবে অনেক মিউজিশিয়ানের মতো তার মুখ দর্শক শ্রোতার কাছে পরিচিত নয়। কারণ তিনি একেতো থাকেন দেশের বাইরে, তারওপর ভীষণ প্রচারবিমূখ। অন্তরালে থাকা সেই মানুষটিকেই খুঁজে বের করে বার্তা২৪.কম মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তার সঙ্গে কথা বলেছেন মাসিদ রণ
আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে হিট গান কি শাকিব খানের ‘লিডার আমি বাংলাদেশ’ সিনেমার ‘সুরমা সুরমা’?
আসলে আমার বেশকিছু গান আলাদা আলাদা দিক দিয়ে মাইলফলক। যেমন, ২০১৩-১৪ সালের দিকে ‘কিস্তিমাত’ সিনেমার ‘শুধু একবার বলো’ গানটি বের হয়। ওটাই আমার প্রথম বাংলা গান। অর্থাৎ চলচ্চিত্রের গান দিয়েই আমার যাত্রা শুরু। গানটি তখন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ আলোড়ন ফেলে। ওই গানটি ‘কিস্তিমাত’ সিনেমার একটি সেলিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছিল। ‘মুসাফির’ সিনেমার টাইটেল গানটি আবার অন্যভাবে সফল। সাম্প্রতিক সময়ের বাংলা সিনেমার সেরা ৩টি টাইটেল গানের তালিকা করলে এটিও তারমধ্যে থাকবে। গানটি সে সময় যতোটা হিট হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সাড়া ফেলেছে কোভিডের সময়। ‘অস্তত্ব’ সিনেমার ‘আয় না বল না’ গানটিও জনপ্রিয়তা পায়। এরপর ‘সুপার হিরো’ সিনেমায় গান করি। এই ছবি দিয়েই শাকিব খানের সঙ্গে পরিচয়। ২০২২-এর সুপারহিট সিনেমা ‘পরান’-এর ‘চলো নিরালায়’ গানটি সে বছরের অন্যতম জনপ্রিয় গান। সেটিও শাকিব খান শুনেছেন। তার সুবাদেই গত বছর ‘লিডার আমি বাংলাদেশ’-এ কাজ করা হয়। তিনি আমাকে তার বাসায় ইনভাইট করেছিলেন। আমি দেখা করতে গেলে এই ছবিতে গান করার কথা বলেন। এরপর তো সবাই জানেন, ‘সুরমা সুরমা’ কতোটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এক দশকের সংগীত ক্যরিয়ারে বেশকিছু জনপ্রিয় গান উপহার দেওয়ার পরও তারকাখ্যাতি পাননি। বড় কোন পুরস্কারও ঘরে আসেনি। কতোটা তুষ্ট আপনি?
আসলে আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো- আমার গানগুলো দর্শক এতোটা গ্রহণ করেছে সেটি। নিজের সৃষ্টিকে দর্শক শ্রোতার মনে জায়গা করাতে পারার মতো সফলতা আর কি হতে পারে? এটা সবার ভাগ্যে জোটেও না। খুব কষ্টকর কাজ কিন্তু। আরেকটি বিষয় হলো- আমি যে সিনেমাগুলোতে গান করেছি সেই গানগুলো ওই ছবির সেলিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে। এটাও এক ধরনের সার্থকতা। প্রযোজক-পরিচালকরা আমাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করেন সব সময়। এজন্য আমি বছরে কয়টা গান করলাম সেটি কখনোই মূখ্য ছিল না। যে গানটি করলাম সেটি কতোখানি সফল হলো তা আমার আছে অগ্রগন্য। আর তারকাখ্যাতির কথা বলতে গেলে, এর জন্য যে পরিমাণ সময় কিংবা এফোর্ট দিতে হয় সেটি আমার দিতে ইচ্ছে করে না। আমি বরং সেই সময়ে নতুন কিছু সৃষ্টির কথা ভাবি। মানুষ আমাকে চিনলে, ভালোবাসা দিলে তো ভালো লাগেই। কিন্তু এটাই আমার কাজের একমাত্র লক্ষ্য নয়। আমার কাজ বেঁচে থাকলে সেটি বরং আমার চরম সার্থকতা হবে। এখন যে গানটি মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়েছে, সেই গানটি সার্থক হবে যদি ১০ বছর পরও মানুষের মুখে মুখে থাকে। আমি এই বিশ্বাস নিয়েই কাজ করি।
‘পরান’ সিনেমার সুপারহিট গান ‘চলো নিরালায়’-এর পেছনের গল্পটি শুনতে চাই...
মজার বিষয় হলো, ‘চলো নিরালায়’ কিন্তু মুক্তির পরদিনই সাড়া ফেলেনি। প্রথম চারদিনে মাত্র ৪০ হাজার ভিউ হয়েছিল ইউটিউবে। হুট করেই পঞ্চম দিনে গানটি অন্য জায়গায় চলে যায়। এটা হয়েছিল মূলত টিকটকের কল্যানে। টিকটকে গানটি ট্রেন্ড হওয়ার পর মূল গানটিও সবাই শোনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়। এটা তো গেল মুক্তির পরের কথা। গানটি তৈরীর সময়ও মজার গল্প আছে। যা আগে কখনো কোথাও বলিনি। পরিচালক মোস্তফা কামাল রাজ ‘তুমি যে আমার’ নামে একটি ছবি করতে চেয়েছিলেন ২০১৫ সালে। এই গানটির আইডিয়া আমি তখন সেই ছবির জন্য করেছিলাম। ছবিটি যেহেতু হয়নি, তাই আইডিয়াটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম যাতে ভালো কোথাও ব্যবহার করতে পারি। কোভিডের মধ্যে রায়হান রাফী ‘পরান’ সিনেমার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার গল্পে যে সিচুয়েশন তার সঙ্গে এই গানটি একেবারেই মিলে যায়। এজন্যই গানটি ‘পরান’-এ দিয়েছি।
মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়। লবিং ছাড়া নাকি ফিল্মের গান পাওয়ায় যায় না। আপনিতো থাকেন দেশের বাইরে। তাহলে এই ভালো ভালো কাজগুলো কিভাবে পান?
অনেকেই ভাবে আমি অনেক লবিং করে কাজ করছি। কিন্তু এই অপবাদ আজ অস্বীকার করছি। ‘কিস্তিমাত’ ছবিতে গান করার সুযোগ পাওয়ার আগে শোবিজের কেউ আমার পরিচিত ছিল না। দেশের বাইরে থাকায় অনলাইনে যোগাযোগ করা ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না। ফেসবুকে পরিচালক, গায়ক-গায়িকাদের খুঁজে খুঁজে মিউজিক কম্পোজিশন পাঠাতাম। কয়েক’শ বার আমার গান রিজেক্ট হয়েছে। এখন যে সিঙ্গারদের সঙ্গে কাজ করছি তাদেরও কেউ কেউ সে সময় আমাকে পাত্তা দেয়নি। হয়ত সে কথা তাদের মনেও নেই। একটা সময় ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, ‘কিস্তমাত’-এ সুপারহিট গান উপহার দেওয়ার পরও এক বছর আমাকে কেউ কাজ দেয়নি। পরে একই পরিচালক তার ‘মুসাফির’ সিনেমায় আমাকে কাজ দেন। এসব কথা বলার কারণ হলো, আমি কখনোই লবিং করে কাজ করিনি। করলে শুরু থেকেই অনেক কাজ করতে পারতাম। আমি বেছে বেছে ভালো কিছু ছবিতে গান করেছি। কিছু ছবির মুক্তিই পায়নি। ফলে সেই গানগুলোও আলোর মুখ দেখেনি।
নিজের কোন প্ল্যাটফর্ম খুললে তো গানগুলো সেখানে প্রকাশ করতে পারবেন...
আমার নিজের নামে ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। সেখান থেকে একেবারেই নিজের পছন্দমতো কিছু গান প্রকাশ করছি। কিছুদিন আগে বেলাল খান আর কনার গাওয়া একটি গান এসেছে। এছাড়া যারা ভালো লিখতে পারে, গাইতে পারে তাদেরও সুযোগ দিচ্ছি। কেউ যদি মনে করেন আপনি মেধাবী তাহলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি তাদের সঙ্গে কাজ করতে পারি। তবে যে গানগুলো আটকে আছে সেগুলো নিজের চ্যানেলে প্রকাশ করার উপায় নেই। কারণ গানগুলোর স্বত্ত্বতো ওই সিনেমার প্রযোজকের। তিনি তো আমাকে পারিশ্রমিক দিয়েই কাজটি করিয়েছেন।
সম্প্রতি বিয়ে করলেন। বিয়ের গল্পটা কেমন ছিল?
পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছি। এটা শুনলে অনেকে বিশ্বাসই করতে চায় না। বিয়ের আগে কোন প্রেমও করিনি! এদিকে বিয়ের বয়সও হয়েছে অনেক আগে। তাই পরিবার থেকে চাপ ছিল। আমেরিকাতে সদ্য আইটি জব পেয়ে ভেবেছিলাম আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে বিয়ের কথা ভাবব। কিন্তু এরইমধ্যে আমার ঘনিষ্ট এক বন্ধু বলল, কিরে বিয়ে সাদি কি করবি না? আমি বলেছিলাম, তোমরা তো পাত্রী দেখ না! সিরিয়াসলি বললেও সে ভেবেছে মজা করছি। কিছুদিন পর আবারও একই প্রসঙ্গ। আমি একই উত্তর দিলাম। এবার সে সিরিয়াস হলো। অল্পদিনের মধ্যেই আমাকে পাত্রীর ছবি ও সিভি দেখালো। বলল, মেয়েটি তার বন্ধবীর ফ্রেন্ড। আমি আমিও সেই বন্ধুর বান্ধবীকে চিনি, নিউ ইয়র্কে থাকে। এজন্য আমি সিরিয়াসলি নিলাম বিষয়টি। বায়োডাটা, ছবি সব মিলিয়ে আমার ভালো লাগলো। পরিবারের সঙ্গে কথা বললাম, তারাও খুব পছন্দ করলো। এরপর ফোনে কথা বলে দেখলাম মেয়েটি খুবই পজিটিভ মানসিকতার। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সেও খুব সংস্কৃতিমনা। ফোনে কথা বলেই মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। দেশে ফিরে একদিন মাত্র দেখা করার পরই বিয়ের দিনক্ষন পাকা হয়ে গেল। এরপর তো বিয়ে। তবে বিয়ের অনুষ্ঠানটি করেছি আরও কয়েক মাস পরে। আমার স্ত্রীর নাম ফারহানা বিনতি। তিনি এখনো ঢাকাতেই থাকেন। আমি ঢাকা-নিউ ইয়র্ক যাওয়া-আসার মধ্যে আছি।