দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলন- এই লম্বা সময়ে শোবিজের চাকা ছিলো একেবারেই বন্ধ। দীর্ঘদিন প্রোডাকশন বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে ইন্ডাস্ট্রি।
শিল্পীরাও একঘেয়ামি জীবনযাপন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারমধ্যে কয়েক গুন বেড়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রল ও সামলোচনা।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে দেশের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন হয়েছে অনেক বেশি। ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছাড়া আর কোন বিষয়ে তারকারা কোন পোস্ট করলে অকথ্য গালি ও অহেতুক সমালোচনার মুখে পড়ছেন।
নেটিজেনরা বুঝতেই চাইছে না যে, দেশের সব সেক্টরের কাজ কম বেশি চললেও শোবিজের শিল্পীরা একেবারেই কাজ না করে ঘরে বসে আছেন। তাছাড়া একজন শিল্পী তথা দেশের জন্য শিল্পচর্চা কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি অনুধাবন করছে না কেউ! শিল্পীদের দলীয় করণ করতে ব্যস্ত অধিকাংশ নেটিজেন।
ফলে দেশে এখনো সেভাবে শুটিং-এর ব্যস্ততা বাড়েনি। তাই এখন বিদেশেই শুটিং-এর দিকে ঝুঁকছেন অনেকে। কারণ, বিদেশে বেশ গোপনীয়তা রক্ষা করে কাজ করা সম্ভব। যে তারকারা বিদেশে গিয়ে কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগই সোশ্যাল মিডিয়ায় তেমন কিছুই প্রকাশ করছেন না।
গত মাসে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন অনেক নির্মাতা-শিল্পী-কুশলীরা। চলতি আগস্ট ও আসছে সেপ্টেম্বরেও আছে শুটিং। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধ শত নাটক নির্মীয়মাণ।
মাবরুর রশীদ বান্নাহর নেতৃত্বে একটি শুটিংদল ব্যাংককে গিয়েছিল গত ২৫ জুলাই। সেই দলে ধীরে ধীরে যোগ দেন অভিনেতা তৌসিফ মাহবুব, ফারহান আহমেদ জোভান, ইরফান সাজ্জাদ, নিলয় আলমগীর, সাফা কবির, আইশা খান, সাদিয়া আয়মান, জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি। চিত্রগ্রাহক ছিলেন রাজু রাজ, মেহেদী রনি ও ফোরকান। বান্নাহর সঙ্গে পরে আরো যোগ দেন আরো তিন নির্মাতা। এর মধ্যে রয়েছেন শহীদ উন নবী ও হাসিব হোসেন রাখি।
১৬ আগস্ট পর্যন্ত এই চার নির্মাতা নির্মাণ করেছেন ২২টি একক নাটক। বান্নাহ একাই নির্মাণ করেছেন আটটি। তবে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে বান্নাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন নাটক-সিনেমা নিয়ে কথা বলতে চাই না। শুটিং করেছি, সময়মতো মুক্তিও পাবে। আমাদের এখন দেশ গঠনে মনোযোগ দেওয়া উচিত। অন্তত দুই-চার মাস দেশ সংস্কারে সবার একসঙ্গে কাজ করা উচিত। আমি নাটকগুলোর শুটিং করেছিলাম আগে থেকে শিডিউল নেওয়া ছিল বলে। তবে এই মুহূর্তে দেশ নিয়েই ভাবতে চাই। ওখানে (ব্যাংকক) শুটিং করার সময়ও সারাক্ষণ দেশের প্রতি নজর ছিল। আমরা ইউনিটের কেউ ভালো ছিলাম না।’
বান্নাহ’র কথার দুটো দিক হতে পারে। একটি হলো সত্যি তিনি এখন দেশ গঠনের চিন্তা থেকে নাটক সিনেমা নিয়ে কথা বলতে চান না। আরেকটি হলো- আগে উল্লেখিত সোশ্যাল মিডিয়ার অযথা ট্রলের কারণে কাজ করলেও তা আপাতত গোপন রাখতে চান তিনি।
হাসিব হোসেন রাখি নির্মাণ করেছেন ছয়টি নাটক। তার নাটকগুলোতে অভিনয় করেছেন নিলয় আলমগীর, জান্নাতুল সুমামইয়া হিমি, তৌসিফ মাহবুব ও সাদিয়া আয়মান। নির্মাতা শহীদ উন নবী নির্মাণ করেছেন ছয়টি। অভিনয় করেছেন তৌসিফ মাহবুব, সাফা কবির, ফারহান আহমেদ জোভান ও আইশা খান।
হাসান রেজাউলের নেতৃত্বে একটি দল এখন শুটিং করছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গত সপ্তাহে ব্যাংকক হয়ে কোরিয়া গিয়েছে দলটি। সেখানে আছেন অভিনেতা ইয়াশ রোহান ও তানিয়া বৃষ্টি। জানা গেছে, তারা একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি ৫টি নাটকের শুটিংও করবেন। এর আগে কোনো নাটকের শুটিং দক্ষিণ কোরিয়ায় হয়নি-এমনটা দাবি করেছেন তানিয়া বৃষ্টি।
মালয়েশিয়া নাটক নির্মাণের উদ্দেশ্যে আগামী ২৬ আগস্ট যাবে আরেকটি দল। তিন পরিচালক মাইদুল রাকিব, শহীদ উন নবী ও হাসিব হোসেন রাখির সঙ্গে এই দলে থাকবেন অভিনয়শিল্পী নিলয় আলমগীর, তানিয়া বৃষ্টি, সামিরা খান মাহিসহ আরো কয়েকজন। মাইদুল রাকিব গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নাটকগুলো প্রযোজনা করবেন বশির ভাই [আলী বশির]। আমরা প্রত্যেকে পাঁচটি করে নাটক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছি।’
আগেও আমেরিকায় নাটক নির্মাণ করেছেন ওসমান মিরাজ। দেশটিতে বসবাস করেন তিনি। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর তার আমন্ত্রণে দেশটিতে যাবেন ফারহান আহমেদ জোভান ও কেয়া পায়েল। এই জুটিকে নিয়ে আটটি নাটক নির্মাণ করবেন মিরাজ। সেখানে আরো কয়েকজন নির্মাতা রয়েছেন। তারাও এই জুটিকে নিয়ে নাটক নির্মাণ করবেন বলে জানান মিরাজ।
প্রসঙ্গত, বিগত দিনে বিদেশের লোকেশনে প্রচুর একক নাটক এমনকি ধারাবাহিকও নির্মিত হয়েছে। তবে কোনোটিই পায়নি দর্শকপ্রিয়তা। তবু কেন নির্মাতা-প্রযোজকরা বিদেশমুখী হচ্ছেন? নির্মাতা মুহম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অনেকের সঙ্গে আমিও একমত। বিদেশে নির্মিত নাটক দর্শক সেভাবে গ্রহণ করে না। এর কারণও আছে। যথাযথ পাণ্ডুলিপি বেছে নেন না নির্মাতারা। আবার একই লোকেশনে অল্প সময়ের মধ্যে শুটিং শেষ করতে হয়। তা ছাড়া লোকবল কম থাকায় চিত্রগ্রাহককেই লাইট-ক্যামেরা ঠিক করতে হয়। অভিনয়শিল্পীদের মেকআপ করতে হয় নিজেদেরই। টেকনোলজিরও ঘাটতি থাকে। সবার আগে চিন্তা করতে হয়, কত দ্রুত শুটিং শেষ করা যায়। কারণ এক দিন বেশি থাকলে তো খরচ বেড়ে যাবে! এতসব মেইনটেইন করতে গিয়ে নাটকের মান আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না।’
তাহলে কেন দিন দিন বিদেশে শুটিংয়ের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে? রাজ বলেন, ‘বিদেশে বেশ কিছু সুবিধাও পাওয়া যায়। যেমন দেশে অভিনয়শিল্পীদের স্পটে আসতে দেরি হয়। বিদেশে সেটা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ সবাই এক হোটেলেই থাকেন। দেশে শুটিং করতে গেলে প্রায় ৫০ জনের ইউনিট থাকে, বিদেশে মাত্র চার-পাঁচজন। সত্যি বলতে, বিমান খরচ আর হোটেল খরচ বাদ দিলে দেশের তুলনায় অর্ধেক ব্যয়ে নাটক নির্মাণ করা যায়। এই সুবিধা নেওয়ার জন্যই বিদেশে শুটিং করেন প্রযোজক-পরিচালক।