জনপ্রিয় উপস্থাপক ও নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস। শোবিজে টানা দুই যুগ ধরে কাজ করছেন। সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনকে উপজীব্য করে নির্মাণ করেছেন একটি শর্টফিল্ম। সমসাময়িক আলোচিত ইস্যু নিয়ে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে কথা খোলামেলা কথা বলেছেন এই তারকা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসিদ রণ
মাসিদ রণ: ছাত্র আন্দোলনকে উপজীব্য করে ‘৩৬ জুলাই’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সেটি নিয়ে জানতে চাই...
দেবাশীষ বিশ্বাস: আমি বরাবরই প্রতিবাদী স্বভাবের। ন্যায়কে ন্যায় আর অন্যায়কে অন্যায় বলাই আমার বৈশিষ্ট্য। সেদিক থেকে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন নিয়েও আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা ছিলো। আমি এই আন্দোলনের মাহত্ম অনুভব করেছি। ছাত্ররা তাদের জায়গা থেকে সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। তবে আমি তো আর ছাত্র না। আমি ফিল্মমেকার, তাই এমন কিছু করে এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকতে চেয়েছি যা আর কেউ করেনি। আমার প্রতিবাদের ভাষা হলো চলচ্চিত্র। তাই ‘৩৬ জুলাই’ নামে একটি শর্টফিল্ম নির্মাণ করেছি। এর পটভূমি দেয়াল লিখন বা গ্রাফিতি। ছাত্র আন্দোলনের ফলে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পুরো বিষয়টিই কিন্তু রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। সেই গ্রাফিতিগুলো ধারণ করেই ছবিটি করেছি। ছবিটির মাধ্যমে দেশবাসীর সঙ্গে যারা দেশের বাইরে থাকেন তারাও এই আন্দোলন সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারেন। এজন্য ছবিটির দুটো ভার্সন করেছি। চলমানচিত্রের সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষায় ধারাভাষ্য দিয়েছি। যাতে একজন বিদেশিও সহজে ছবিটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। এটা কোন বানিজ্যিক চিন্তা থেকে করা হয়নি। কাজটি ইউটিউবে রয়েছে। চাইলে আপনারা দেখে নিতে পারেন। যারা দেখেছে তারা প্রশংসা করেছে কাজটির।
মাসিদ রণ: গণ অভ্যুত্থানের প্রভাব শোবিজের কাজে কতোটা পড়েছে?
দেবাশীষ বিশ্বাস: ভীষণভাবে পড়েছে। করোনার সময় আমরা একটা বড় ধাক্কা খেয়েছি, এবার আরেকটি ধাক্কা খেলাম। এতোদিন হয়ে গেলো, এখনও তো কাজই শুরু হয়নি সেভাবে। সবাই একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে আছে। এমনিতেই আমাদের শোবিজ অঙ্গনটা আর্থিকভাবে বেশ দুর্বল ছিলো। আমাদের প্রযোজক পেতে অনেক কষ্ট হতো। যারা টুকটাক প্রযোজনা করতেন তাদের সিংহভাগই এখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে প্রযোজনা থেকে দূরে আছেন। এখন নতুন লগ্নিকারক পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে কোন কিছুর পজিটিভ এবং নেগেটিভ দিক থাকে। এটা যেহেতু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছিলো তাই আমি বিশ্বাস করি দেশের সমস্ত ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হবে। আর সেটি হলে আমাদের শোবিজের কাজও আবার গতি ফিরে পাবে।
মাসিদ রণ: আপনি শোবিজের বহুদিনের বৈষম্যগুলোর কথা বলছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের পরে খোদ শিল্পীদের মধ্যেই অনেক বেশি বৈষম্য ও বিরোধ দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে কি বলার আছে?
দেবাশীষ বিশ্বাস: এ প্রসঙ্গে প্রথমেই দুটো কথা বলতে চাই। শিল্পে রাজনীতি থাকতে নেই, আর শিল্পীর রাজনীতি করতে নেই। হ্যাঁ, একজন শিল্পী যখন পরিণত বয়সে শোবিজ থেকে অবসর নেন তখন তিনি রাজনীতি করতে পারেন। কিন্তু যখন তার শিল্পকর্ম দিয়ে দর্শককে আলোড়িত করার কথা সেই সময়ে রাজনীতির মাঠে না যাওয়ায় উত্তম। এখন শোবিজ অঙ্গনে যা ঘটছে তা কিন্তু এই কারণেই ঘটছে। শিল্পীরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ায় তাদের বিরাগভাজন মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই দুটো পক্ষ হয়ে একে অন্যকে টেনে নিচে নামাতে চাইছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিল্পী হবে সবার জন্য, তার কাজের মাধ্যমে সবার কথা বলবে। যেমন আমি, কোন নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে যুক্ত নই।
মাসিদ রণ: দেশের নতুন পরিস্থিতিতে ‘ধর্ম’ নিয়ে নানা ইস্যু তৈরী হচ্ছে। আপনি একজন সংখ্যালঘু হিসেবে বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
দেবাশীষ বিশ্বাস: আমি জন্মসূত্রে একটি ধর্মের অনুসারী, যেটাকে সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম যাই বলেন না কেন। কিন্তু আমি সকল ধর্মকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করি। তাছাড়া আমার এই বয়স পর্যন্ত আমি কখনো নিজেকে একজন বাংলাদেশি ছাড়া আর কিছুই মনে করিনি। কারণ আমার চারপাশের মানুষরা আমাকে সেটা ফিল করতে দেয়নি যে আমি সংখ্যালঘু। আমিই এখন পর্যন্ত ঈদের টিভি অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশিবার ঈদ মুবারাক বলেছি। অর্থাৎ এদেশে ধর্ম, বর্ণ, জাত, পাত বিচার করা হলে একজন হিন্দু ধর্মের মানুষ হিসেবে আমি সবচেয়ে বেশি ঈদের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে পারতাম না। তবে ‘ধর্ম’কে ইস্যুকে করে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা যখন ঘটে তখন খারাপ তো লাগেই। আশা করব ভবিষ্যতেও আমরা সম্প্রীতির বাংলাদেশ বজায় রাখব।
মাসিদ রণ: ২০০১ সালে শাবনূর-রিয়াজ জুটিকে নিয়ে সুপারহিট ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ ছবি দিয়ে ফিল্ম মেকার হিসেবে আপনার যাত্রা শুরু। এরপর আরও কিছু ছবি করেছেন। নির্মাতা হিসেবে কতোটা সন্তুষ্ট?
দেবাশীষ বিশ্বাস: শুধু আমি নই, সব পরিচালকেরই নিজের কাজ পরবর্তীতে দেখার পর মনে হয় এই শটটি অণ্যভাবে নিলে ভালো হতো, গল্পের এই জায়গাটা আরেকটু ভালোভাবে প্রেজেন্ট করতে পারতাম। অর্থাৎ শিল্পী কখনোই তার নিজের কাজে শতভাগ তুষ্ট হয় না। তবে ওভারঅল যদি চিন্তা করি তাহলে বলব, আমি ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ থেকে শুরু করে ‘শুভবিবাহ’, ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’, ‘চল পালাই’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’ ছবিগুলো করেছি। এখন কাজ করছি ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’ নামের একটি ছবির। আমি তো রোমান্টিক কমেডি ছবিই করি। সে দিক দিয়ে শুধু একটি ছবি আমার ক্যারিয়ারগ্রাফের সঙ্গে যায় না। সেই ছবিটির নাম হলো ‘চল পালাই’। এটি একটি থ্রিলার ছবি ছিলো। এই কাজটি সেভাবে দর্শক সাড়া পায়নি। তাই আমি চিন্তা করেছি আমি আজীবন রোমান্টিক কমেডি ছবিই করে যাব।
মাসিদ রণ: আপনার সিনেমায় কাজ করেছেন ফেরদৌস, রিয়াজ ও আরিফিন শুভ কাজ করেছে। বর্তমানে এই তিন অভিনেতাই রাজনৈতিকভাবে চাপে রয়েছেন। তাদের নিয়ে কি বলবেন?
দেবাশীষ বিশ্বাস: আমি আগেই বলেছি যারা শিল্পী তাদের রাজনীতি করতে নেই। ফেরদৌস ভাই কিংবা রিয়াজ ভাই হয়েতো সেটি বুঝতে পারেননি। ফলে তাদের ইমেজ সংকট তো হয়েছেই। এটা কখনোই কাম্য ছিলো না। তারা আরও গুছিয়ে চলতে পারতেন। আর শুভ’র কথা বলব, তাকে সিনেমার একক নায়ক হিসেবে আমিই আত্মপ্রকাশ করাই ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’ সিনেমার মাধ্যমে। যদিও তার কোন সাক্ষাৎকারে সেকথা তিনি উল্লেখ করেননি। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এজন্য আমি তার খারাপ চাইবো এমন মানুষও আমি না। দেখুন, শুভ একটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। একজন শিল্পী চাইলে যে কোন ছবিতে কাজ করতে পারেন। তিনি যে ছবিটিতে (বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক) কাজ করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন সেখানে তো তিনি দারুণ অভিনয় করেছেন। সেই কাজের জন্য তাকে তৎকালীন সরকার একটি প্লট দিয়েছে। আমি আশা করব যদি কোন আইনি ঝামেলা না থাকে তবে তিনি যেন সেই প্লটটি আবার ফেরত পান।
মাসিদ রণ: আপনার বাবা দীলিপ বিশ্বাস এ দেশের কালজয়ী অনেক চলচ্চিত্রের নির্মাতা। তিনি কি রাষ্ট্রের কাছ থেকে যথার্থ মূল্যায়ন পেয়েছেন?
দেবাশীষ বিশ্বাস: আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই, আমার বাবা যে মাপের চলচ্চিত্রকার তার কোন মূল্যায়ন হয়নি রাষ্ট্র থেকে। বরং এমনও হয়েছে, তিনি দুই বার শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছেন জানার পরও গ্যাজেটে তার নাম আর আসেনি। এছাড়া একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক কিছুই তাকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু ভালোলাগে যে দর্শক আমার বাবাকে প্রাণভরে ভালোবাসা ও সম্মান দিয়েছেন। যা এখনো আমি দেশের আনাচে-কানাচে গেলে টের পাই।