স্মৃতির দরজায় মায়াবী আঙুলে কড়া নাড়ছেন তিনি, যে আঙুল একদা রোমান্টিক দ্যোতনা জাগিয়েছিল গিটারের তারে। স্বপ্নের মতো সুরেলা কণ্ঠে গেয়েছেন, ‘স্মরণের জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে তুমি আমায় ডেকো!’
২১ এপ্রিলের স্মৃতি-সরণি বেয়ে তাকে আবার ভালোবেসে ডাক দিচ্ছে বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমী মানুষ। ২০১৭ সালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান অনন্য সংগীতশিল্পী লাকী আখন্দ।
সংগীতশিল্পী, সুরকার ও সংগীত রচয়িতা হিসেবে লাকী আখন্দের (৭ জুন ১৯৫৬- ২১ এপ্রিল ২০১৭) প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, তার সুরেলা গানগুলো খুবই বাণী নির্ভর। গানের কথাগুলো সুরের ইন্দ্রজালে ভেসে মানুষের গভীর-গহীন মর্মে প্রবেশ করে।
তিনি গেয়েছিলেন, ‘আমায় ডেকো না’, কিন্তু মানুষ তাকে বার বার কাছে ডাকছে। ‘হ্যাপি টার্চ’- এর হয়ে গানের কথা ও সুর সৃজন করেছিলেন তিনি অনুপম নিজস্বতায়, যে স্বকীয়তার কারণেই অনেকের মধ্যে তিনি হারিয়ে যাননি, স্বতন্ত্র পরিচিতিতে দীপ্ত হয়েছেন।
মৃত্যুর পরেও তার গানগুলো মায়াবী দোলা দিয়ে যায় বাংলাদেশের সংগীতের দিগন্তে।
আশির দশকের মাদকতাময় গানের নায়ক লাকী আখন্দের মৃত্যুতে সমকালীন বাংলাদেশের আধুনিক সংগীত জগতের একটি বিশেষ ঘরানার অবসান হয়েছিল। ‘এই নীল মণিহার’, ‘আবার এসেছে সন্ধ্যা’ ইত্যাদি হৃদয়স্পর্শী ও জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা দীর্ঘদিন রোগের সঙ্গে লড়াই করে যখন মারা যান, তখন তার বয়স ষাট হলেও তিনি ছিলেন লেলিহান তারুণ্যের সঙ্গীতময় আইকন।
তার মৃত্যু হয়েছিল শুক্রবার সন্ধ্যায়। রাজধানী ঢাকার প্রাচীনতম অঞ্চলে, যে ঢাকা ছিল তার জীবন ও কর্মের সর্বসময়ের পাদপীঠ। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা-সুরকার। সঙ্গীতযোদ্ধা লাকী আখন্দের দোসর ছিলেন অকাল প্রয়াত শিল্পী ও ভাই হ্যাপি আখন্দ। হ্যাপির মৃত্যুতে একাই গিটার হাতে বছরের পর বছর সুর তুলেছেন তিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ব্যান্ড মিউজিকের প্রাথমিক উত্থানের সময় একটি আলাদা সংগীত প্রবাহ আনেন এই শিল্পী। উচ্চনাদ ও যন্ত্রের ব্যবহারের যুগে কণ্ঠের মাধুর্য, মিউজিক্যাল মেলোডি ও স্পর্শকাতর গায়কী দিয়ে তিনি তার সঙ্গীতের লালিত্যময় বৈশিষ্ট্যকে অটুট রাখেন।
লাকী আখন্দের সমকালে বিভিন্ন ব্যান্ড নিয়ে ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদরা সুরের উন্মাতাল ইন্দ্রজাল তৈরি করছিলেন আর লাকী আখন্দ ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা, অন্য রকম, তথাপি জনপ্রিয়। আরও পরে ব্যান্ড সঙ্গীতের এই ঘরানায় তপন চৌধুরী, শাফিন, হাসান, আইয়ুব বাচ্চু, মকসুদ, জেমস প্রমুখ শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু সবার চেয়ে আলাদা থেকে মোহময় সুরের বিস্তার ঘটান লাকী আকন্দ।
একটা নস্টালজিক, হারানো সময় ও স্মৃতি তাঁর গানে প্রাধান্য পায়। সুরের বিষণ্ন ঝরনাধারার মতো তাঁর গানের কথায় বেদনার টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ শোনা যায়।
খুবই আত্মমুখী, নিভৃত ও একান্ত উচ্চারণ লাকী আখন্দের গানগুলোকে উচ্চকণ্ঠী সংগীত-ধারা থেকে বিশিষ্ট করে রাখে। অকালে নেশার নীল আঘাতে হারিয়ে যাওয়া ভাই হ্যাপি আখন্দের একটি ছায়া সব সময়ই তাঁর সঙ্গীত প্রচেষ্টায় প্রভাব বিস্তার করে রাখে।
তারুণ্যের বেদনাময় আর্তিকে তিনি আধুনিক আঙ্গিকে হৃদয়জ উচ্চারণে স্পষ্ট করতে থাকেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। বৈশাখের এক সন্ধ্যায় নিজের গানে খোঁজা ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’র মতোই তিনি হারিয়ে যান। হারিয়ে গিয়েও তিনি তার গানের মধ্যে বর্ণিত একটি স্বর্ণালী রাতের নীল মণিহার হয়ে বেঁচে আছেন বাংলা সংগীতের সংখ্যাহীন শ্রোতার স্মৃতি ও সত্ত্বায়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রজন্মগুলোর সংগীত-তৃষ্ণা জাগাতে ও সংগীত-বোধ নির্মাণ করতে যারা ছিলেন অগ্রণী, লাকী আখন্দ তাদের অন্যতম। সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের সংগীত জগতকে ধীরে ধীরে আরও অনেকের সঙ্গে তৈরি করেছিলেন তিনি। নাগরিক-সমাবেশ ও রেডিও-বিটিভি কেন্দ্রীক স্বল্পতম মিডিয়া কাঠামোতে আধুনিক গান, সুর ও মর্ডান মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের ছোঁয়া দিয়েছিলেন লাকী আখন্দ। বাংলাদেশের লোকজ ও চিরায়ত গানের সম্ভারে যুক্ত করেছিলেন বৈশ্বিক আধুনিকতার যোজনা।
লাকী আখন্দের গানগুলো আধুনিক ব্যক্তিজীবনের অস্তিত্বের বেদনাকে মূর্ত করেছিল। ব্যক্তি-মানুষ ও তার চেতনা ছিল তার গানের মূল ফোকাস। মানুষের আর্তি ও প্রত্যাশার সেতুবন্ধ হয়ে তিনি আবেদন জাগিয়ে ছিলেন সব সময়ের তারুণ্যের অন্তর্গত হৃদয়ে। যে কারণে মৃত্যুর পরেও তার গান প্রাসঙ্গিক। অসংখ্য শ্রোতা হৃদয়তাড়িত কণ্ঠে ‘স্মরণের জানালায় দাঁড়িয়ে’ তাকে আবার ডাকে। আধুনিক বাংলা গানের শ্রোতারা তাকে শুধু মৃত্যু বা জন্ম দিবসেই নয়, বার বার ডাকবে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম