বাড়ি থেকে পালিয়ে রেনু হন বাংলা সিনেমার ‘রোজিনা’

সিনেমা, বিনোদন

সোহেল মিয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজবাড়ী | 2023-12-12 20:13:48

ছোট বেলা থেকেই তার সিনেমার প্রতি আসক্তি। স্কুল পালিয়ে এবং বাবা-মার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছোট বেলায় হলে গিয়ে চুরি করে সিনেমা দেখতেন। নতুন কোনও সিনেমা মুক্তি পেলেই বান্ধবীদেরকে সাথে নিয়ে তিনি ছুটে যেতেন সিনেমা হলে।সেই সিনেমা আসক্তি থেকে এক সময়ে হয়ে ওঠেন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী অভিনেত্রী।

বলছি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের আশির দশকের জনপ্রিয় নায়িকা রোজিনার কথা। সম্প্রতি বার্তা২৪.কম-এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় দর্শকদের অজানা এমনই সব তথ্য জানিয়েছেন এই চিত্র নায়িকা।

এই আলাপচারিতায় উঠে আসে, বাংলা চলচ্চিত্রের সেকাল-একাল এবং ভবিষ্যৎ। ভীনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন এবং বাংলা চলচ্চিত্রকে রক্ষার জন্য তিনি তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান। তিনি বিশ্বাস করেন বাংলার তরুণেরা যদি আবার হলমুখী হয় তাহলে অস্তিত্ব সংকটে থাকা বাংলার চলচ্চিত্র আবার ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব।

 


স্মৃতিচারণ

আমার মা খোদেজা বেগম কখনও চাইতেন না আমি অভিনয় করি। আমার মা ছিলেন ভীষণ রাগী। আমাদের চার বোন ও দুই ভাইকে মা সব সময়ই কড়া নজরদারিতে রাখতেন। কিন্তু আমি মার কথা শুনতাম না। সিনেমার প্রতি ছিল আমার বিশাল টান। নতুন কোন ছবি রাজবাড়ীর চিত্রা হলে প্রদর্শনী শুরু হলেই আমরা কয়েকজন বান্ধবী মিলে স্কুল পালিয়ে সিনেমা হলে ঢুকে পড়তাম।

যেভাবে সিনেমা জগতে

যখন স্কুল পালিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতাম তখন শাবানা আপু, কবরী আপু, সুচরিতা আপুদের অভিনয় দেখে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমার মধ্যেও প্রবল ইচ্ছা ও শখ জাগে আমিও শাবানা আপুর মতো নায়িকা হব। এই স্বপ্ন থেকেই আমি এক সময় মাকে নানা বাড়ি বেড়ানোর কথা বলে পালিয়ে ঢাকা আসি। তারপর অনেক ইতিহাস।

“জানোয়ার” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম দর্শকদের সামনে আসেন রোজিনা

ঢাকা যে আত্মীয়র বাসায় থাকতাম সেই মহল্লায় মঞ্চ নাটক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নাটকটি মঞ্চায়িত হওয়ার কয়েকদিন আগে সেই নাটকের নায়িকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে আমি সেই নাটকের অভিনয় করি। এরপর একদিন জাতীয় সংসদ এলাকায় ঘুরতে যাই। ঘুরতে গিয়ে সেখানে দেখি একটি সিনেমার শুটিং চলছে। সিনেমাটির নাম “জানোয়ার”। সেই শুটিংয়ে ট্রে নিয়ে যাওয়ার ছোট একটি অভিনয় ছিল। আমি ওখানে থাকায় ঐ শুটিংয়ের একজন আমাকে অফার দেয় অভিনয় করার জন্য। আমি তো এতেই মহাখুশি। আমাকে ওরা মেকাপ করে দেয়। ছবির ক্যামেরাম্যান অন্য একজনকে বললেন, মেয়েটি দেখতে তো বেশ সুন্দর। ওর কয়েকটি স্টিল ছবি তুলে রাখ। তারপর তারা আমার কয়েকটি ছবি তোলে এবং অভিনয় করার জন্য আমাকে ১০ টাকা সম্মানিও দেয়। সেই ১০ টাকায় আমার জীবনের প্রথম অভিনয় করার সম্মানি।

সেই ছবিটি দেখে আমাকে কয়েকটি বিজ্ঞাপনের অফার আসে। আমি তখন মায়া বড়ির একটি বিজ্ঞাপনে মডেলিং হই। বিজ্ঞাপনটি প্রচার হওয়ার পর আর আমাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক আমি সিনেমাতে অভিনয় করার অফার পাই।

১৯৮৮ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন

ভীনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন ও বাংলা সিনেমা

বর্তমান আকাশ সংস্কৃতি ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার যুগ। এখানে টিকে থাকতে হলে প্রথমেই আমাদের দেশপ্রেম থাকতে হবে। দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। আমি মনে করি বাংলাদেশে এখন অনেক ভালো ছবি নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু দর্শকের সে রকম সাড়া নেই। তাই আমি মনে করি- এ দেশের তরুণেরা যদি সিনেমা হলমুখী হয় তাহলে বাংলার চলচ্চিত্র আবার ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব। আমি চাই বাংলার তরুণেরা মাদককে বয়কট করে তারা সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চায় এগিয়ে আসুক। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে তারা হোক অতন্দ্র প্রহরী।

অভিনয়ের পাশাপাশি নাটকও নির্মাণ করেছেন রোজিনা

রোজিনা রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের মেয়ে। তার ডাক নাম রওশন আরা রেনু। ১৯৭৬ সালে “জানোয়ার” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম দর্শকদের সামনে আসেন। এরপর এফ কবীর চৌধুরী পরিচালিত “রাজমহল” ছবিতে নায়িকা হিসেবে তার প্রথম অভিষেক ঘটে। তখন তার নাম পরিকর্তন করে রাখা হয় রোজিনা। এ পর্যন্ত তার অভিনীত মোট ছবির সংখ্যা ২৭৫টি। তার উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে- জানোয়ার, রাজমহল, মাটির মানুষ, চম্পা চামেলী, আনারকলি, শাহী দরবার, সুলতানা ডাকু, কসাই প্রমুখ।

১৯৮০ সালে রোজিনা “কসাই” ছবির জন্য জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন এবং ১৯৮৮ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে “জীবন ধারা” ছবির জন্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি বাচসাস পুরস্কারও লাভ করেন। অভিনয়ের জন্য তিনি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ হতে ছোট বড় প্রায় ১৫টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নাটকও নির্মাণ করেছেন। বর্তমানে তিনি দেশীয় চলচ্চিত্রকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নিজেকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রেখেছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর