কখনো কখনো এমনও হয়। শূন্য থেকে শীর্ষে চলে যায় মানুষ। উত্তমকুমার তেমনই একজন। যাঁর আত্মপ্রকাশ এক্সট্রার ভূমিকায়। যাঁর প্রথম ছবিটি আজও মুক্তিই পায় নি। যাঁর প্রথম দিকের বেশ কয়েকটি ছবি বক্স অফিসে মোটেও সফল হয় নি। তিনিই পরিণত বয়সে বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক।
অভিনয়ে, গ্ল্যামারে, গানে অপ্রতিদ্বন্দ্বি দক্ষতা থাকলেও উত্তমকুমার কেবলই জোর দিয়েছিলেন অভিনয়ে। যদিও রূপালি পর্দায় গান তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ঠোট মিলিয়েছেন, তথাপি সেগুলো অন্য শিল্পীর গাওয়া। এমন কি, উত্তমকুমার একাধিক ছবিতে সুর দিলেও নিজের গান স্বকণ্ঠে স্থান দেন নি সিনেমায়। অথচ সমসাময়িক প্রায়-প্রতিটি গায়কের গান ধারণ করেছেন নিজের কণ্ঠে। নিজের সুকণ্ঠকে পর্দায় ব্যবহার না করে বিভিন্ন শিল্পীর গানকেই যুৎসইভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজস্ব অভিনয় শৈলীতে।
গান গাইবার তৈরি গলা ছিল তাঁর। ছিল দীর্ঘকালীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। ঘরোয়া আসরে যে মানের গান তিনি গাইতেন, তাতে ছবিতে গান গাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু নিজের সঙ্গীত পরিচালনায় বা প্রযোজনার ছবিতে নিজে গান গাওয়ার চেষ্টা তিনি করেন নি। পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গিতে সঙ্গীত শিল্পীর গানই নিয়েছেন।
সম্ভবত গোপন প্রেমের মতো নিজের গলার গানকে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করতেন উত্তমকুমার। অথচ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র-এর গান পর্দায় এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে, মনে হয় তিনিই গাইছেন। শিল্পী বদলের কারণে যে কণ্ঠের পার্থক্য হয়েছে, সেটা দর্শক টেরই পায় নি। মনে করেছে, সবই উত্তমের গাওয়া।
বিচিত্র ধরনের গান, বিভিন্ন পটভূমিতে চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন উত্তমকুমার। ‘শাপমোচন’ ছবির পথ চেয়ে বসে থাকা নায়কের গলায় থেকে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র পত্নীভক্ত স্বামীর কণ্ঠের আবহে চলে যেতে তাঁর মতো পারঙ্গমতা কেউ দেখাতে পারবেন না। ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে তিনি বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে দশটি গানে ঠোট মিলিয়ে ছিলেন। কিন্তু কোথাও কোনও ছন্দপতন বা পার্থক্য মনে হয় নি। অভিনয়কে জাত শিল্পীর মতোই ঘটনার আবহের সঙ্গে এমন সুন্দর করে মিশিয়ে দিতেন যে, গানে শিল্পীর কণ্ঠের তারতম্য বোঝাই যায় নি।
আধুনিক মেলোডি গানের অনেকগুলোই এসেছে কলকাতার সিনেমা থেকে, উত্তমের ঠোটে। ‘শাপমোচন’ (১৯৫৫) ছবির গানগুলো শুনলে পর্দার গায়ক উত্তমকুমার আর বাস্তবের গায়ক হেমন্তকে আলাদা করা যায় না। অর্ধশত বছর পেরিয়েও গানগুলো সমান জনপ্রিয়। যেমন, ‘বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনেরই গান গেয়ে’, ‘শোন বন্ধু শোন, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’, ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস আজকে হলো সাথী’, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’।
‘মযাদা’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘সহযাত্রী’, ‘নষ্টনীড়’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘সদানন্দের মেলা’,, ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শিল্পী’, ‘পথে হলো দেরী’ ইত্যাদি ছবিতে অসাধারণ সব গান উত্তরকুমারের ঠোটে জীবন্ত হয়ে আছে। অনেক গান, হয়ত গান হিসাবে ভালো, এতোটা জনপ্রিয় ও পরিচিত হতো না, যদি উত্তমের ঠোটে পর্দায় স্থান না পেতো!
উত্তমকুমারের প্রায়-সব ছবিই বাঙালি দর্শকের দেখা। আজকাল তো ইউটিউব সার্চ করলেই মোবাইল ফোনের পর্দায় ছবিগুলো দেখে নেওয়া যায়। আগে অত সহজ ছিল না। ভিসিআরের টেপে ছবিগুলো দেখতে হয়েছে। বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ির কাছে ‘রোজভ্যালি’ নামে একটি বড় ভিডিও’র দোকান ছিল। পুরনো স্টেডিয়ামেও তাদের একটি শো-রুম ছিল। আরেকটি ছিল ‘ভিডিও কানেকশন’ নামে। দোকানগুলো এখন উঠে গেছে।
লুপ্ত দোকানগুলোর প্রসঙ্গে উত্তমকুমার বিষয়ক একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে। তা হলো, ‘রোজভ্যালি’কে বলে উত্তমের সব ছবির ক্যাসেড আনিয়ে দেখেছিলাম। মাস্টার কপি থেকে কিছু কপিও করেছিলাম। যদিও এখন আর দেখার দরকার হয় না, তবু কিভাবে যেন ক্যাসেডগুলো রয়ে গেছে।
মাঝে মাঝে ক্যাসেগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা, সিনেমায় ঠোট মেলানো উত্তমের কোন গানটিকে আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়?’ আমার উত্তর তৈরিই থাকে। কালবিলম্ব না করে আমি ‘হারানো সুর’ ছবির সেই গানটিকেই বেছে নিই: ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে…।’