গিরিখাত পেরিয়ে দুর্গম আলীর গুহা অভিযান

, ফিচার

শুভ্রনীল সাগর, স্পেশালিস্ট রাইটার, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 10:53:39

আলিকদম থেকে ফিরে: আলীকদম সদর থেকে তিন কিলোমিটারের মতো পথ। মাতামুহুরীর পেট থেকে জন্মানো তৈন খালের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে আলীর পাহাড়। গন্তব্য সেখানেই। শীত ঢুকছে। তৈন খালের ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ অবস্থা। মাসটি বৈশাখ নয় তবু হাঁটুপানি। পাতার ফাঁক দিয়ে দ্বিপ্রহরের রোদ ঠিকরে পড়ে।

সবাই চলছিল গদাই লস্করি চালে। গতদিন (২৭ নভেম্বর ২০২০) ভারী ব্যাগ টেনে মারায়ন তং পাহাড় চড়তে হয়েছে। আজ সেই কষ্ট নেই। বাস কাউন্টারে ব্যাগ-বোঁচকা রেখে আসা গেছে। ঝাড়া হাত-পা হয়ে ফুরফুরে মেজাজে তৈন খাল ডিঙিয়ে যাচ্ছে সবাই। ভাবটি এমন, পাঁচ কিলোমিটার খাড়া পাহাড় জয় করে এসেছি, আলীর গুহা আর এমন কী! তখন অব্দি কারও বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই, সামনে কী ঝুঁকি অপেক্ষা করছে!

একদম ঢালুপথ নেমে গেছে ছোট্ট একটি সাঁকো মুখে। মাটির গায়ে খাঁজ কেটে কেটে সিঁড়ি মতো বানানো

ফুরফুরে মেজাজ উবে গেলো একটু বাদেই। ঘন বনের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে পাথুরে ঝিরি। এই ঝিরি পেরিয়ে যেতে হবে আলীর গুহা। একদম ঢালুপথ নেমে গেছে ছোট্ট একটি সাঁকো মুখে। মাটির গায়ে খাঁজ কেটে কেটে সিঁড়ি মতো বানানো। পেরিয়ে ধরতে হবে ঝিরিপথ। এইটুকু নামতেই কান্নাকাটি দশা! পথ সামান্য কিন্তু পা ফসকালেই গড়িয়ে গোকুল। পেছনে অরগাইনাইজারের তাড়া, এতো অল্পে ভড়কে গেলে হবে! এ তো কিছুই না, আসল খেলা তো সামনে..

সামনে তো সামনেই! পা বিশেক পরেই শুরু হলো আসল সিনেমা। সত্যি বলতে, এতোক্ষণ ট্রেইলারও ছিলো না! পাথুরে পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে সরু ঝিরি। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও-বা গোঁড়ালি ভেজে। ঝিরিজুড়ে এবড়ো-থেবড়ো পাথর। ভুল জায়গায় পা পড়লে আর দেখতে হবে না! যত সামনে এগোই দুপাশের পাহাড় আরও চেপে ধরে। সরু হয়ে আসে ঝিরিও। দুজন পাশাপাশি হাঁটা তো দূরের কথা, এক পায়ের পাতাও ভালোভাবে রাখা যায় না..

ঘন বনের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে পাথুরে ঝিরি। এই ঝিরি পেরিয়ে যেতে হবে আলীর গুহা

এভাবেই শিরে সমুহ বিপদ নিয়ে এগিয়ে চলেছি। এই ফাঁকে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে ফেলা ভালো! আলীর গুহা নিয়ে রহস্য আর মিথের শেষ নেই। তবে সরকারি নথিপত্রে এর অন্তর্ভুক্তি পুরাকীর্তি হিসেবেই। শুধু যে গুহার নাম আলীর নামে তা কিন্তু নয়, যে পাথুরে পাহাড়ে এর অবস্থান তার নামও আলীর পাহাড়। ভৌগলিক অবস্থান আলীকদম উপজেলায়। কাজেই আলীকদম, আলীর পাহাড় আর আলীর গুহা যে একযোগে বাঁধা তা সহজেই অনুমেয়। তবে কখন কীভাবে এই দুর্গম পাহাড়ে এমন রহস্যময় সুড়ঙ্গ ও গুহা তৈরি হলো তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য বা নথি পাওয়া যায় না।

বহুল প্রচলিত ধারণা, আলোহক্যডং থেকে আলীকদম নামটির জন্ম। যার অর্থ পাহাড় আর নদীর মধ্যবর্তী স্থান। বান্দরবানের রাজা বোমাং সার্কেল চিফের নথিপত্র এবং পাকিস্তান আমলের মানচিত্রে আলোহক্যডং নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো মানচিত্রেও (Ensea Det Bengalla) পর্তুগিজ পণ্ডিত জাও ডা বারোজ (Jao De Barros) আলোহক্যডং নামটি ব্যবহার করেছেন।

আরাকানি ভাষায় অনেক পাহাড় ও জায়গার নামে ডং, থং বা দং উপসর্গ রয়ে। সম্ভবত, ডং মানেই পাহাড়। তাই ধারণা করা হয়, তাজিংডং ও কেউক্রাডং পাহাড়ের মতোই আলোহক্যডং একটি পাহাড়ের নাম, যা কালক্রমে আলীকদম নাম নিয়েছে।

পাহাড়ি ঝিরি থেকে মূল গুহায় ওঠাটা খুবই কষ্টকর।

অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটির প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টিএইচ লুইনের মতে, Alley Kingdom থেকে Ali Kadam নাম হয়েছে। তার মতে, Alley অর্থ দমন, আর Kingdom অর্থ রাজ্য। বাংলায় মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এখানে ক্ষুদ্র এক রাজ্য শক্তিকে করায়ত্ব বা দমন করেন। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে এ অঞ্চলের নাম হয় Alley Kingdom বা দমন করা রাজ্য। যা পরবর্তীতে আলীকদম নামে টিকে থাকে।

অন্য এক ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, আরবিতে কদম অর্থ পা। প্রয়োগ ভেদে যার অর্থ পদাচারণাও হতে পারে। আলী নামের কেউ একজন কোনো এক সময় এ অঞ্চলে পা রেখে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে তার নামের সঙ্গে কদম শব্দটি যুক্ত হয়ে আলীকদম নামটির জন্ম।

হযরত শাহজালাল এর নেতৃত্বে ৩৬০ আউলিয়া ধর্মপ্রচারের জন্য সিলেট অঞ্চলে এলে তাদের একটি অংশ পার্বত্য এলাকায় আসেন। যাদের কারও নামের আলী উপাধি থেকে আলীকদম নামের জন্ম এমন ধারণাও প্রচলিত।

পাহাড়ের মাঝখানে লম্বাকৃতির গুহাটি প্রায় ১শ ফুট লম্বা ও চার-পাঁচ ফুট চওড়া।

ধারণা প্রচলিত হতে থাকুক। আমাদের কদম তথা পা-ও চলতে থাকে কিন্তু খুব ভালোভাবে চলে না! এক তো শীতের মধ্যে ঠান্ডা পানি মাড়িয়ে চলাটা বেশ সুখকর নয়, এর সঙ্গে পাহাড়ের গা বেয়ে বৃষ্টির মতো পড়া পানির ফোটা শরীর ভিজিয়ে দেয়। সঙ্গে ক্যামেরা, পানি বাঁচিয়ে তাকে নিয়ে চলাও মস্ত হ্যাপা হয়ে দাঁড়ায়। ঝিরি সরু হতে হতে এমনও হয়, পায়ের পাতা রাখার জায়গা নেই, পায়ের অবলম্বন ছাড়াই দুহাতে ভর দিয়ে দিয়ে এগুতে হলো। দুইপাশের পাথুরে পাহাড় মোটেও মসৃণ নয় – ফলে কোথায় ছিলে যাচ্ছে, কোথায় কেটে যাচ্ছে মুহূর্তের উত্তেজনায় নজরেও আসছে না! মনে হয়, কোনো কমান্ডো ট্রেনিংয়ে রয়েছি। সামান্য কাটা-ছেঁড়ায় মনোযোগ দিলেই বরং নম্বর কাটা যাবে!

আরও পড়ুন:মারায়ন তং চূড়ায় জোছনাস্নান (১ম পর্ব)

পাহাড়ি ঝিরি থেকে মূল গুহায় ওঠাটা খুবই কষ্টকর। পাথরবেষ্টিত এই গুহায় কিছুদিন আগেও চড়তে হলে দড়ি বা পাহাড়ের লতা ধরে উঠতে হতো। পর্যটকদের এই সমস্যার সমাধানে আলীকদম সেনা জোনের উদ্যোগে তিনটি লোহার সিঁড়ি বসানো হয়েছে। ফলে পর্যটকদের বড় কোনো সমস্যা পোহাতে হয় না। সহজেই গুহাদর্শন করা যায়।

পাহাড়ের মাঝখানে লম্বাকৃতির গুহাটি প্রায় ১শ ফুট লম্বা ও চার-পাঁচ ফুট চওড়া। এর পাশেই আরও দুটি গুহা রয়েছে। এগুলোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থও প্রায় একই রকম। গুহার ভেতরে নিকষ অন্ধকার। গুহা যেমন হয় আরকি। পদে পদে অজানা বিপদ। টর্চ লাইট, আগুনের মশাল বা হেড ল্যাম্প নিয়ে নিয়ে ঢুকতে হয়। গুহার ভেতরে রয়েছে ছোট-বড় বাদুর। কারও উপস্থিতি টের পেলে পিলে চমকানো শব্দ করে এদিক-ওদিক উড়ে যায়। একেবারে ভৌতিক সিনেমার সত্যিকার সেট।

গুহার ভেতরে নিকষ অন্ধকার। পদে পদে অজানা বিপদ।

গুহামুখ অব্দি এসেই এসেই অনেকে ক্ষান্ত দেয়, ভেতরে আর ঢোকে না। সহ-ট্রেকারদের মধ্যেও অনেকে এদিক-ওদিক চেয়ে ফিরে গেলো। আমরা কয়েক অক্লান্ত-অকুতভয় আত্মা ঢুকে পড়লাম সুড়ঙ্গে। শুরুর খানিকটা হামাগুড়ি পথ, এই আট-দশ ফুট মতো। এরপর ভালোভাবে দাঁড়িয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। ৮০-৯০ ফুট মতো যাওয়ার পর সুড়ঙ্গের পথ গেছে দুদিকে। একটি মিশেছে অন্য একটি ঝিরির কোলে গিয়ে। অন্যটি গুহায় গিয়ে শেষ, এরপর আর পথ নেই। পাহাড় ধ্বসের খবর পড়ি প্রায়ই। অজানা শঙ্কা মনে উঁকিও দেয়। হোক না যতই মজবুত পাথুরে পাহাড়, যদি ধ্বসে পড়ে!

নাহ, তেমন কিছুই ঘটলো। সবাই সুস্থভাবে ফিরে আসা গেলো। গুহা জয় করে ফিরে আসাটা স্বাভাবিকভাবেই আনন্দময়। দিগ্বিজয়ীর মতো তৈন খালের জলে শরীর ধুয়ে ফেরার পথ ধরি। স্থানীয় কায়েসুলের ব্যাটারিচালিত রিকশা করে ফিরছি। আলীর গুহার নামকরণ নিয়ে তার মতামত জানতে চাই।

তার বিজ্ঞের মতো উত্তর, ‘আলীর গুহার নাম হয়েছে হযরত আলীর (র.) নাম থেকে’।

আলী (রা.) এখানে কীভাবে আসবেন? (চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করি)

‘তাদের ব্যাপার কী আর আমরা সাধারণ মানুষ বুঝবো। তারা হলেন আল্লাহর বিশেষ বান্দা। তারা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন। সেইভাবে আসছেন আরকি!’, কায়েসুলের আধ্যাত্মিক উত্তর।

ফোকলোরের ভাষায় যাকে বলে, লোকগল্প। লোকগল্প বহুদিন প্রচলিত হতে হতে একসময় লোকবিশ্বাসে পরিণত হয়। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের লোকবিশ্বাস বনে যায় মিথ...

আরও পড়ুন: মারায়ন তং পাহাড়ে মেঘের ফাঁকি (২য় পর্ব)

এ সম্পর্কিত আরও খবর