পৃথিবী বাঁচাতে স্পেস সোলার পাওয়ার স্টেশনই ভরসা?

, ফিচার

শুভ্রনীল সাগর, স্পেশালিস্ট রাইটার, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 11:38:39

দেখে মনে হবে কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমা! জায়ান্ট সব সোলার পাওয়ার স্টেশন মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে শক্তি (এনার্জি)। প্রায় ধ্বংস হতে থাকা পৃথিবী শক্তি পেয়ে বেঁচে উঠছে ঠিক শেষ মুহূর্তে..

অবশ্য এই ধারণা একেবারে কল্পকাহিনীও নয়। ১৯২০ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী কনস্ট্যানটিন টিসিওলকোভস্কি পৃথিবীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এই ভাবনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। ১শ বছর পর বিজ্ঞানীরা টিসিওলকোভস্কির ওই ভাবনাকেই বাস্তবে রূপ দেওয়ার কথা ভাবছেন। না ভেবে উপায়ও নেই! গত ১শ বছরে বিশ্বব্যাপী মানুষ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ আর সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের বিদ্যুতের ব্যবহার। এই সীমাহীন শক্তির জোগান দিতে প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস করা প্রায় সারা!

কিন্তু কথা হলো, বিদ্যুতের প্রয়োজন তো থেমে থাকবে না! আবার পরিবেশ ধ্বংস করে ক্রমাগত নিউক্লিয়ার বা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে থাকলে পৃথিবীটাই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। অন্য গ্রহে তো এখনও যাওয়ার উপায় নেই! কাজেই শক্তির জোগানের জন্য ভাবতে হবে বিকল্প ব্যবস্থা।  

স্পেস সোলার পাওয়ার স্টেশন মডিউল

পরিবেশের কথা চিন্তা করে তথা পৃথিবীকে বাঁচাতে গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বজুড়ে নবায়নযোগ্য শক্তি (রিনিউয়েবল এনার্জি) প্রযুক্তি উন্নত করা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। উন্নত বিশ্ব এ নিয়ে কাজও শুরু করে দিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তিগত দক্ষতায় কম খরচে কীভাবে এই পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদন করা যায়, সবার মাথা ব্যথা এখানেই।

নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো, নিয়মিত শক্তির উৎসের জোগান। বাতাসকে কাজে লাগিয়ে শক্তি তখনই উৎপন্ন হবে যখন বাতাস বইবে। একইভাবে সূর্য আলো দিলেই মিলবে সৌরশক্তি বা সোলার এনার্জি। বিশ্বের সব দেশের আবহাওয়া এক নয়। কোথাও সূর্যই ওঠে না মাসের পর মাস। আর পরিবেশ দুষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে বাতাস-বৃষ্টিরও মর্জি বোঝা মুশকিল। এজন্য এককভাবে মানব সম্প্রদায়ই দায়ী অবশ্য!

যাইহোক, জীবন যাপন এখন এমন যে, ৩৬৫ দিনের ২৪ ঘণ্টাই আমাদের বিদ্যুৎ লাগবে। কাজেই শক্তি উৎপাদনের উৎসগুলো সম্পূর্ণভাবে নবায়নযোগ্য করার আগে আমাদের এমন একটি উৎস লাগবে যেখান থেকে অফুরান শক্তি সংগ্রহ করা যাবে।

যেহেতু সৌরজগতে আমাদের বাস তাই পৃথিবীর জন্য একমাত্র অফুরান শক্তির আধার হলো সূর্য। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য উপায়, মহাশূন্যেই সৌরশক্তি উৎপন্ন করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে নিয়ে আসা। এই ভাবনা মাথায় রেখেই কাজ করছিলেন টিসিওলকোভস্কি। শতবছর আগে প্রযুক্তিগত নানা সীমাবদ্ধতায় আশানুরূপ ফল তিনি পাননি। তবে তার উত্তরসূরী বিজ্ঞানীরা হয়তো পেতে পারেন। নতুন করে এই হাইপোথিসিসের ওপর কাজ শুরু করেছেন তারা।

মহাশূন্যভিত্তিক সোলার পাওয়ার স্টেশনের অনেকগুলো সুবিধার মধ্যে প্রধান একটি হলো, ২৪ ঘণ্টাই তীব্র সূর্যের আলো পাওয়া। পৃথিবী যেখানে ১২ ঘণ্টা সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত হয়, মহাশূন্যে এই সমস্যা নেই। এছাড়া সূর্যরশ্মি পৃথিবীর অনেকগুলো মণ্ডল পেরিয়ে আসতে আসতে তেজ ও শক্তি অনেক কমে যায়। মহাশূন্যভিত্তিক সোলার পাওয়ার স্টেশনগুলো সূর্যের যতটা কাছ থেকে সম্ভব শক্তি সংগ্রহ করতে পারবে।

সোলার সেল থেকে বিদ্যুৎ রূপান্তরিত করে শক্তি তরঙ্গে রূপান্তরিত করে পাঠাতে হবে পৃথিবীতে

কিন্তু শুনতে যতোটা সহজ লাগছে বাস্তবে রূপ দেওয়াটা ততোটাই কঠিন। সীমাবদ্ধতা নম্বর এক, এতো বড় বড় সোলার পাওয়ার স্টেশন পৃথিবী থেকে পাঠানো, প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ ও দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণ। একেকটি সোলার পাওয়ার স্টেশন ১৪শ ফুটবল মাঠের সমান বড়। মহাশূন্যে জায়গার অভাব নেই কিন্তু মুহূর্তের সংঘর্ষে গুড়িয়ে দেওয়ার মতো বস্তু অসংখ্য। সীমাবদ্ধতা নম্বর দুই, যথাসম্ভব ওজন কম রেখে একেকটি সোলার পাওয়ার স্টেশন মহাশূন্যে পাঠানোর খরচ।

বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতিতে সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা বরাবরই ছিল। সেগুলো জয় করাই আবিষ্কার ও উদ্ভাবন। বিজ্ঞানীরাও থেমে নেই। আপাতত একটি প্রস্তাবিত সমাধান, হাজার খানেক ছোট ছোট স্যাটেলাইট বানানো। মহাকাশে গিয়ে সবাই একসঙ্গে মিলে এক হয়ে একটি বড় সৌরশক্তি উৎপাদক হিসেবে কাজ করবে। ২০১৭ ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক) এক হাজার আল্ট্রালাইট সোলার সেল টাইলস দিয়ে বানানো ‘মডিউলার পাওয়ার স্টেশন’র একটি ডিজাইনও করেছে। তারা এর একটি প্রোটোটাইপও বানিয়েছে যার ওজন প্রতি স্কয়ার মিটারে মাত্র ২৮০ গ্রাম।  

সম্প্রতি, থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি মহাশূন্য শক্তি (স্পেস পাওয়ার) ব্যবহারের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব লিভারপুল থ্রিডি প্রিন্টিংয়ে আল্ট্রালাইট সোলার সেল থেকে সোলার সেইল প্রিন্ট করতে কাজ করছে। সোলার সেইল হলো খুবই কম ওজনের ভাঁজ করে ফেলা যায় এমন উচ্চ প্রতিফলন ক্ষমতা সম্পন্ন পর্দা। এটি সূর্যের বিকিরণকে নিয়ন্ত্রণ ও শক্তিতে রূপান্তরিত করে কোনো জ্বালানি ছাড়াই একটি মহাকাশযান চালাতে সক্ষম। সোলার সেল থেকে সোলার সেইলে রূপান্তরিত করে কীভাবে বড় একটি জ্বালানিমুক্ত স্পেস পাওয়ার স্টেশন বানানো যায় এটা নিয়েই কাজ করে চলেছে তারা।    

তারা আরও বলছে, সম্ভাবনা এখানেই শেষ নয়। আমরা কেবল পৃথিবী থেকে উপকরণ মহাকাশে নিয়ে পাওয়ার স্টেশন বানানোর চিন্তাতেই থেমে নেই, বরং মহাশূন্যে প্রাপ্ত উপকরণ কাজে লাগিয়েই কীভাবে মহাকাশে তা বানানো যায় সেসব নিয়েও কাজ করছি।

এ তো গেলো মহাশূন্যে পাওয়ার স্টেশন বানানো নিয়ে সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়-আশয়গুলো। ধরা যাক, মহাশূন্যে পাওয়ার স্টেশন বানানো গেলো। এইবার আসল কাজ হলো, উৎপাদিত শক্তি পৃথিবীতে আনা যাবে কীভাবে?

এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা, সোলার সেল থেকে বিদ্যুৎ রূপান্তরিত করে শক্তি তরঙ্গ (এনার্জি ওয়েভ) বানানো এবং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করে পৃথিবীর পৃষ্ঠে একটি অ্যান্টেনা বসিয়ে সেখানে স্থানান্তর করা। অ্যান্টেনা আবার শক্তি তরঙ্গকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করবে। জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশান এজেন্সির গবেষকরা ইতোমধ্যেই একটি নকশা দাঁড় করিয়ে ফেলেছে এবং একটি অরবিট সিস্টেমও প্রদর্শন করা সারা।

কাজ যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে আশাবাদী হওয়াই যায়। হয়তো আমাদের জীবদ্দশাতেই তা দেখে যেতে পারবো! এই আশা দিচ্ছে চীনও। তারা ‘ওমেগা’ নামে একটি সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে যেটি মহাশূন্য থেকে সর্বোচ্চ ২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎশক্তি পৃথিবীতে পাঠাতে সক্ষম। এই সমপরিমাণ বিদ্যুৎ পৃথিবীতে উৎপাদন করতে চাইলে প্রায় ৬০ লাখেরও বেশি সোলার প্যানেল লাগবে। চূড়ান্ত ফল হাতে পেতে চীন ২০৫০ সালের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।   

চাঁদে গবেষণার জন্য পাঠানো রোবটযান লুনার রোভার্সকে শক্তি সরবরাহ করতে পরীক্ষামূলকভাবে খুব শীঘ্রই ছোট সোলার পাওয়ার স্যাটেলাইট পাঠানো হবে। মানব সভ্যতার আরেকটি বিস্ময়কর মাইলফলক ‘স্পেস সোলার পাওয়ার স্টেশন’র প্রথম কারিগরি পদক্ষেপ হয়তো এর মধ্য দিয়েই শুরু হলো!

এ সম্পর্কিত আরও খবর