কেন প্রতি শতাব্দে প্রায় ১ মিটার করে বাড়ছে এভারেস্ট?

, ফিচার

শুভ্রনীল সাগর, স্পেশালিস্ট রাইটার, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 20:18:58

চায়নার আগের পরিমাপে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ছিল ৮৮৪৪.৪৩ মিটার। নেপালের মাপে তা ছিল প্রায় চার মিটার বেশি। সম্প্রতি নতুনভাবে মেপে দেখা পর উচ্চতা দাঁড়িয়েছে ৮৮৪৮.৮৬ মিটার অর্থাৎ ২৯,০৩২ ফুট। নেপাল ও চায়নার যৌথ সরকারি ঘোষণা, এভারেস্টের উচ্চতা প্রায় দশমিক ৮৬ মিটার বেড়েছে।

চায়না ও নেপাল দুই দেশের সীমান্তেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এভারেস্ট। পর্বতারোহীরা দুই দেশ দিয়েই এতে চড়তে পারে। নেপালের বিদেশ মন্ত্রণালয় এবং সার্ভে বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, দুই দেশের জরিপকারীরাই এভারেস্টের নতুন উচ্চতার ব্যাপারে একমত।

এর আগে, নেপাল ও চায়না বরাবরই চূড়ায় জমা বরফ ধরে উচ্চতা মাপা হবে কী, হবে না – তা নিয়ে দ্বিমত করতো। গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাঠমান্ডু সফরকালে এভারেস্টের নতুন উচ্চতার বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক ঘোষণা আসে।

গত কয়েকশো বছরের পরিমাপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ইন্ডিয়ান ও ইউরাসিয়ান দুই ট্যাকটনিক প্লেটের সংঘর্ষে সৃষ্ট এ পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা প্রতি শতাব্দীতে প্রায় এক মিটার করে বেড়ে চলেছে। প্রায় ৫০-৬০ মিলিয়ন বছরের পুরনো এভারেস্টের মূল শরীর পাথুরে হলেও এর চূড়া বরফে আচ্ছাদিত। মূল চূড়ার জায়গাটুকুতে ছয়জন মানুষ ভালোভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এই বরফাচ্ছাদিত চূড়ায় হিমবাহের তারতম্যের ফলেই এর উচ্চতা একটু একটু করে বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

চীনের জরিপকারীরা চূড়ায় চড়েন চলতি বছরের (২০২০) মে মাসে (GETTY IMAGES)

উচ্চতার মাপের ক্ষেত্রে দাপ্তরিক পার্থক্য কেন?

চীন কর্তৃপক্ষের বরাবরের বক্তব্য ছিল, মাউন্ট এভারেস্টের পাথুরে উচ্চতা (রক হাইট) ধরেই তাকে মাপতে হবে। অন্যদিকে, নেপালের দাবি, পাথুরে চূড়ায় জমা বরফের আস্তরণও উচ্চতায় ধরতে হবে।

২০০৫ সালে নেপাল উচ্চতা মাপার পর চীনের জরিপকারীরাও তাদের দিক থেকে মেপে ফেলে। ২০১২ সালে নেপালের সরকারি কর্মকর্তারা বিবিসি-কে জানান, চীনের মাপা উচ্চতা মেনে নিতে দেশটির (চীন) সরকার তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এরপর তারা নতুনভাবে উচ্চতা মাপার সিদ্ধান্ত নেয়।

এতোদিন নেপাল ১৯৫৪ সালে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার মাপা উচ্চতাই (৮৮৪৮ মিটার) সরকারিভাবে ব্যবহার করে আসছিল। এই প্রথম দেশটি এভারেস্টের উচ্চতা মাপতে নিজস্ব উদ্যোগ নেয়। চার নেপালি ভূমি জরিপকারী আনুষ্ঠানিকভাবে মাপার কাজ শুরু করার আগে দুই বছর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

নেপালের সার্ভে বিভাগের মুখপাত্র দামোদার ধাকাল বিবিসি-কে বলেন, এর আগে আমরা নিজেরা কখনও জরিপ করিনি। এখন আমাদের একটি নবীন কারিগরি দল রয়েছে। আমরা নিজেরাই এখন এটা করতে পারি।

হিমশীতল পরিবেশে উচ্চতা-পরিমাপক যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে গিয়ে গত বছর পায়ের আঙুল হারান দলের প্রধান জরিপকারী খিমলাল গৌতম।

ফিরে এসে বিবিসি নেপালি-কে তিনি বলেন, পর্বতারোহীদের কাছে বিশ্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানো একটি বিরাট অর্জন। আমাদের জন্য এটা ছিল কেবলই শুরু।

এইবার অতীতের অন্যান্য জরিপের মতো ভুল আমরা করিনি। আমরা যথাসম্ভব ত্রুটি এড়ানোর জন্য উচ্চতা মাপার ক্ষেত্রে সময় বেছে নিয়েছিলাম রাত ৩টা। দিনের আলোয় চূড়ার বরফ গলে যায়, তখন সঠিক উচ্চতার পরিমাপ মেলে না, যোগ করেন তিনি।

গত বছর (২০১৯) নেপালি জরিপকারীরা চূড়ায় চড়েন (GETTY IMAGES)

কেন সঠিক উচ্চতা এতো প্রশ্নবিদ্ধ?

কিছু ভূতাত্ত্বিকের ধারণা, ২০১৫ সালের বড় ভূমিকম্পে এভারেস্টের উচ্চতার তারতম্য ঘটেছে। ৭.৮ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে নেপালে প্রায় নয় হাজার মানুষ নিহত হয় এবং সেসময় বেসক্যাম্প তুষারপাতে চাপা পড়ে নিহত হন কমপক্ষে ১৮ জন পর্বতারোহী।

অন্যদিকে, এভারেস্টের চূড়ায় বরফের আস্তরণ সঙ্কুচিত হয়ে এই ভূমিকম্প ঘটে বলে মত কিছু ভূতাত্ত্বিকের। কাঠমান্ডুর দক্ষিণ দিকে (ভূমিকম্পস্থলের নিকটবর্তী স্থান) ল্যাংট্যাং হিমালের মতো হিমালয়ের অনেক চূড়ার উচ্চতা ওই ভূমিকম্পের পর এক মিটার মতো কমে গেছে বলে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন।

অন্যরা আবার দ্বিমত করে বলছেন, ট্যাকটনিক প্লেট যেটির উপর এভারেস্ট বসে আছে, সেটির স্থানান্তরের ফলে সৃষ্ট এই ভূমিকম্প। হিমালয় চূড়াগুলোও এই একই প্লেটে স্থিত।

২০১৫ সালের এই বড় ভূমিকম্পও নতুন করে এভারেস্টের উচ্চতা মাপার কারণ বলে জানান নেপালের সার্ভে বিভাগের মুখপাত্র ধাকাল।

কীভাবে নতুন করে মাপা হলো মাউন্ট এভারেস্ট?

সাধারণত পাহাড়-পর্বতের উচ্চতা মাপা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠকে ভিত্তি ধরে। নেপাল বঙ্গোপসাগরকে মূল ভিত্তি ধরে উচ্চতা মেপেছে। ইতোমধ্যেই ভারত বঙ্গোপসাগর থেকে এভারেস্টের নিকটবর্তী নেপাল-ভারত সীমান্তে একটি বেজ পয়েন্ট জরিপ করে রেখেছে। নেপালের জরিপকারীরাও এই পয়েন্টটি ব্যবহার করেন। এভারেস্ট থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে এই পয়েন্ট থেকে নেপাল লাইন অব সাইট স্টেশনের একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করে। এখান থেকেই এভারেস্ট প্রথম দৃশ্যমান হয়। এরপর তারা অনেকগুলো পয়েন্টের চেইন তৈরি করে পরবর্তীতে একত্রে জুড়ে দেয়।     

অন্যদিকে, চীনের জরিপকারীরা শ্যানডংয়ের পূর্ব প্রদেশের ইয়েলো সি-কে ভিত্তি করে জরিপ চালায় বলে চায়না ডেইলির খবর।

দুই দেশেরই জরিপকারীরা চূড়ার উচ্চতা মাপার ক্ষেত্রে ত্রিকোণোমিতির সমীকরণ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু নিচ থেকে যতই গাণিতিক হিসাব হোক না কেন, কাউকে না কাউকে চূড়ায় উঠতেই হতো।

গত বছর (২০১৯) নেপালি জরিপকারীরা চূড়ায় চড়েন। অন্যদিকে, চীনের জরিপকারীরা চূড়ায় চড়েন চলতি বছরের (২০২০) মে মাসে।

নেপালের মুখপাত্ররা জানান, তারা একদম সঠিক ফলাফল পেতে ত্রিকোণোমিতির গাণিতিক হিসাবে ১২টি আলাদা আলাদা নিচের চূড়ার (লোয়ার পিক) উচ্চতা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। চীনও একই পদ্ধতিতে হিসাব করেছে বলে তাদের দেশের মিডিয়ার খবর।

উভয়ই উচ্চতা পরিমাপের ক্ষেত্রে গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম ব্যবহার করেছে। এর আগে চায়না ১৯৭৫ ও ২০০৫ সালে এভারেস্টের উচ্চতা মেপেছিল।

হিমালয়ান ডাটাবেজ বলছে, দ্বিতীয় জরিপকারী দল চাইনিজ ভার্সনের একটি জিপিএস ডিভাইস চূড়ায় স্থাপন করেছে।

এইবার চীনের জরিপকারীরা ব্যবহার করেছেন সেদেশেরই বেইডৌ (BeiDou) নেভিগেশন সিস্টেম। যেটিকে মার্কিন-মালিকাধীন গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম’র (জিপিএস) প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এ বিষয়ে সিনহুয়া’র খবর, পরিবেশগত সুরক্ষার পাশাপাশি বেইডৌ সিস্টেম হিমবাহ পরিমাপসহ বরফের ঘনত্ব, আবহাওয়া ও বাতাসের গতিবেগ মাপতে সাহায্য করে।

অন্যদিকে, নেপাল মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা মাপতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি অনুসরণ করেছে জানান ধাকাল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর