পাখি-আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় বিরল পরিযায়ী ‘খয়রা কাস্তেচরা’

, ফিচার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট | 2023-09-01 06:53:04

পাখি আলোকচিত্রীদের সঙ্গী হওয়া দারুণ এক ব্যাপার! সঙ্গী মানে তিনি ছবি তুলবেন আর আপনি নিশ্চুপ থেকে সেই দৃশ্য হজম করবেন। ইয়া বড় ক্যামেরার লেন্স, তার ওপর পেঁচানো সেনাপোশাকি কাপড়, আলোকচিত্রীর গেঞ্জি, প্যান্ট, টুপি এমনকি জুতো সবই সেনাপোশাকি রঙের ভয়ংকর সৌন্দর্যে ভরা।

এই সেনাপোশাকির অর্থই হলো- পাখিদের তীক্ষ্ম চোখ যেনো সহজেই বিভ্রান্তির মাঝে পড়ে। সরল অর্থে সাদা পোশাকে পাখির ছবি তুলতে গেলেই পাখি অনেক ক্ষেত্রেই সেই সাদা পোশাক আগেভাগেই দেখে মুহুর্তে উড়ে যায়। কিন্তু বিবর্ণ সেনাপোশাক হলে পাখির চোখে ‘ধান্দা’ লাগে! পাখি দুটানায় পড়ে যায়! অর্থাৎ সে সহজে বুঝে উঠতে পারে না– এটি কি মানুষ? নাকি প্রকৃতির টুকরো অংশ?

ফলে শৌখিন-পেশাদার সমস্ত আলোকচিত্রীরাই এই সেনাপোশাকি রঙের কাপড় গায়ে পরে পাখির ছবি তুলতে এসে দারুণ সফলতা অর্জন করে থাকেন। নিরাপদ সীমার দূরত্বে থেকে অসাধারণ, কখনও অবিশ্বাস্য ছবি কাছ থেকে তোলার সৌভাগ্য পেয়ে যান। বার্ডিং অর্থাৎ পাখির ছবি তুলতে এ পোষাক অধিক জনপ্রিয়। শুধু বার্ডিং নয়, বন্যপ্রাণীদেরও ছবি ধারণে এই পোষাকের জুড়ি মেলা ভার।

 রঙের বৈচিত্র্যে ফুটে উঠে এ পাখিগুলো। ছবি- সাঈদ বিন জামাল


 

তো, এমনি বিস্ময়কর সেনাপোশাকি রঙে ভরে উঠার সুযোগ হয়েছিলো একবার। সাথে ছিলেন বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী সাঈদ বিন জামাল। অসাধারণ সব ছবি তুলে বন্যপ্রাণীময় মুহুর্তকে সহজে রাঙিয়ে দেবার দক্ষতা রাখেন যিনি।

আমাদের কাছে খবর এলো- বাইক্কা বিলের বিরল সারসদের উপস্থিতি। অল্পকিছু দিনের মধ্যেই তাদের ফিরে যাবার পালা। মার্চের শেষে সদলবলে তারা ফিরে যায়। এবার তারা ফিরে যাবে, যেখান থেকে তারা এসেছিল আমাদের জলাশয়ে। ফিরে যাবার এই যাত্রায় রয়েছে ডানায় ভর করে দীর্ঘপথ পাড়ি দেবার স্বপ্ন।

প্রতিবছর শীত মৌসুমে বাইক্কা বিল ভরে উঠে পরিযায়ী পাখিদের কলতানে। নানা প্রজাতির জলচর পাখি পৃথিবীর উত্তরগোলার্ধ থেকে ছুটে আসে এখানে। নির্দিষ্ট তিন-চার মাস কাটিয়ে সময় ঘনিয়ে আসে- এ সকল পরিযায়ীদের ফিরে যাবার।

এ সকল পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম ‘খয়রা কাস্তেচরা’। এদের শরীরে রয়েছে গাঢ় তামাটে আর ধাতব সবুজ-বেগুনির সৌন্দর্য। এ পাখিদের সহজে দেখা যায় না। বেশিরভাগ সময় বাইক্কা বিলের মাঝখানে অবস্থান করে। অন্যপ্রজাতির পাখিদের ভিড়ে তারা নিজেকে সুরক্ষা দান করে। আমাদের শীত মৌসুমে এদের দেখা যাওয়ার নজির রয়েছে। তবে বাংলাদেশে আসার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে না এরা।

মার্চ মাসের কোনো এক দুপুরে তখন পরিযায়ীদের মিলনমেলায় ভরে উঠলো। দূরবীক্ষণযন্ত্রে চোখ রাখতেই নানা প্রজাতির পাখিদের জীবন্ত ছবিগুলো ভেসে এলো। এগুলো চোখের দ্বারা হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে অসম্ভব ভালোলাগার জন্ম দিয়ে চলেছে। ‘খয়রা কাস্তেচরা’দের দেখা গেল। তারা বিরতিহীনভাবে কাঁদায় মুখগুজে খাবারের অনুসন্ধানে গভীর ব্যস্ত।

আমাদের মিঠা পানির অগভীর জলাশয়গুলোতে সম্মিলিতভাবে বিচরণ করে এরা। বিশেষ করে জলজ উদ্ভিদে ঢাকা হাওর-বিল অথবা কৃষি জমিগুলোতে একাকী বা জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। ঘন উদ্ভিদ সমৃদ্ধ জলাশয় এড়িয়ে চলে। স্যাঁতসেঁতে তৃণভূমিতেও শিকার খোঁজে। শিকার খুঁজতে গিয়ে হাঁটু জলের বেশি নামে না। এরা ঝাঁক বেঁধেও বিচরণ করে।

 রঙের বৈচিত্র্যে ফুটে উঠে এ পাখিগুলো। ছবি- সাঈদ বিন জামাল


 

বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী সাঈদ বিন জামাল বলেন, বাংলাদেশের বিরলপ্রায় পরিযায়ী প্রজাতি ‘খয়রা কাস্তেচরা’। একে ‘চকচকে দোচরা’ নামেও ডাকা হয়। ইংরেজিতে নাম Glossy Ibis এবং বৈজ্ঞানিক নাম Plegadis falcinellus। আমাদের দেশে বর্তমানে কদাচ হাওরে যে নমুনা দেখা যায় তা ছোট, একাকী বা মাঝারি একটি দলে থাকে। পানির কাছে বসবাসরত অন্যান্য পাখিদের সাথে এদের বেশি দেখা যায়।

তিনি আরও বলেন, ‘খয়রা কাস্তেচরা’ বাইরে থেকে দেখতে কালচে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে লালচে বাদামি শরীর ও উজ্জ্বল বেগুনি ডানা। প্রজনন ঋতুতে এদের গায়ে লাল আভা বেগুনির সাথে মিলে এক অপরূপ রঙের সৃষ্টি করে।’

‘খয়রা কাস্তেচরা’র শারীরিক গঠন এবং খাবার সম্পর্কে এ আলোকচিত্রী বলেন, এদের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৬৫ সেন্টিমিটার এবং ওজন এক কেজির চেয়ে সামান্য কম। ডাঙায় খাদ্য পোকামাকড় শূককীট, টিকটিকি এবং পানি থেকে ধরে ছোট মাছ, কেঁচো, ছোট সাপ, ব্যাঙ, অন্যান্য ছোট জলচর প্রাণী। এ ছাড়াও মৌসুমভেদে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনশীল।

বিশ্ব জীববৈচিত্র্য গবেষণা ও সংরক্ষণ সংস্থা ‘আইইউসিএন’ এ পাখিগুলোকে Least Concern (ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত) প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বিশ্বব্যাপী জলাভূমির পরিবেশ ধ্বংস এবং অবাধে শিকার এদেরকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর