আফগানিস্তান: একদার আশ্রয়দাতা এখন রিফিউজি

, ফিচার

মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 22:45:57

আফগানিস্তান, যে দেশ একদা ছিল আশ্রয়দাতা, সে দেশের মানুষ গত ৪২ বছরের অব্যাহত যুদ্ধ ও সংঘাতে রিফিউজি। আফগানিস্তান নামক ভূখণ্ডটি জন্মভূমি ও নিজস্ব দেশ হলেও সেদেশের ২.৫ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন, দেশছাড়া, উদ্বাস্তু বা রিফিউজি, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বাধিক এবং বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহৎ। বাস্তুহারা আফগান রিফিউজিদের সিংহভাগ আশ্রয় পেয়েছেন পাকিস্তানে। দ্বিতীয় আশ্রয়দাতা দেশ ইরান।

সাম্প্রতিক তালেবান নেতৃত্বের ভয়ে আরও মানুষ দেশ ছাড়ছে। বিমানবন্দরের অকল্পনীয় ভিড় দেখে আফগানদের দেশত্যাগের হিড়িক আঁচ করা যায়। অথচ ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়েছে আফগানিস্তান। কমিউনিস্টরা আফগান হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসা-যাওয়ার নিরাপত্তা পেয়েছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু বাঙালির আশ্রয়স্থল ছিল আগানিস্তান।

১৯৭২ সালের আফগানিস্তান মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠেনি। সেখানে তখনও মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাস খেলা করে বেড়ায়। তবে আগুন জ্বলছে ঠিক তার পাশের দেশেই। পাকিস্তানে। সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশই তখনও বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসাবে মেনে নেয়নি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ছিল বহু প্রতিবন্ধকতা। তখন পশ্চিম পাকিস্তানে থাকা বাঙালিরাও ছিলেন বিপদে। তাঁদের অবস্থাও বন্দিদের চেয়ে উন্নত কিছু ছিল না।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। পাকিস্তানে বন্দি বাঙালিদের মনও তাই ঘরে ফেরার জন্য ব্যাকুল। অথচ ফেরার কোনো উপায় নেই, কারণ পাক সরকারের কাছ থেকে কোনো অনুমতি পাওয়া যাবে না। এর মধ্যেও উপায় খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁরা। পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্তের কাছাকাছি যাঁদের বাস, তাঁরা সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসতে শুরু করেছেন ভারতে। আর পশ্চিম সীমান্তের মানুষরা চলে যাচ্ছেন আফগানিস্তানে। প্রথম রাস্তাটা অবশ্য অনেক বেশি নিরাপদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সবরকম সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে ভারত সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন ভারতীয় সেনারাও। কিন্তু আফগান সীমান্তে ধরা পড়লে আর কিছু করার নেই। আর সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারলেও কি সেখানে মাথা গোঁজার বা সেখান থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার পথ পাওয়া যাবে?

তবুও প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত পেরিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন থেকে তেমনটাই জানা যাচ্ছে। হ্যাঁ, প্রায় এক বছর আগেই বিজয়দিবস পালন করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আর এই এক বছরেও উদ্বাস্তু মিছিল বন্ধ হয়নি। নভেম্বর মাসের সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী সেই মাসেই প্রায় ৪০০-৫০০ বাঙালি পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছেন। কাবুল ও অন্যান্য শহরে তখন হিপিদের যথেষ্ট যাওয়া-আসা। তাদের জন্য গজিয়ে উঠেছে নানা সস্তার হোটেল। সেই হোটেলেই গাদাগাদি করে জড়ো হচ্ছেন বাঙালিরা। তবে এই সময়ে আফগানিস্তানের শরণার্থী বাঙালিদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকেই।

আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া বাঙালিদের থাকা-খাওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছিল কাবুলের ভারতীয় দূতাবাস। এমনকি ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে তাঁদের জন্য তৈরি হয়েছিল বিশেষ সরকারি পরিচয়পত্রও। এই পরিচয়পত্রের ভিত্তিতেই আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরতে পেরেছিলেন সেইসব বাঙালিরা।

ভারতীয় দূতাবাসের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৬ হাজারের বেশি মানুষকে বাংলাদেশ পৌঁছতে সাহায্য করেছেন তাঁরা। না, বাংলাদেশকে তখনও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি আফগানিস্তান। কিন্তু বেলুচ সীমান্ত পেরিয়ে এই দেশটাই হয়ে উঠেছিল অসংখ্য বাঙালির কয়েকদিনের আশ্রয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর