আফগানিস্তানে মৃত্যু ও ধ্বংসের দায় কার?

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-30 05:08:32

প্রায়-পঞ্চাশ বছর ধরে আফগানিস্তানে চলছে সংঘাত, পাল্টা সংঘাত, যুদ্ধাবস্থা। প্রথমে আসে সোভিয়েত বাহিনী। তাদের হটায় মুজাহিদিন গ্রুপগুলো। এদের সরিয়ে আসে তালেবান। তালেবান সরিয়ে নর্দান অ্যালায়েন্স। তারপর আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট হামিদ কারজাই সরকার। তারপর আশরাফ গণির সরকার। এবং অবশেষে আবার তালেবান। এরাও কতদিন থাকবে, তা সুনিশ্চিত নয়। অস্থিরতার দোলাচলে এখনও আফগানিস্তান।

অতীত বা বর্তমানের এইসব  পালাবদলের ঘটনাগুলো শান্তিপূর্ণ ছিলনা। রক্ত, মৃত্যু ও ধ্বংসের পথে ছিন্নভিন্ন হয়েছে সারা দেশ। পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং এশিয়ার শীর্ষ শরণার্থী হয়েছে আফগানিস্তানের নাগরিকগণ। কত নারী, শিশু, আপামর মানুষ মরেছে তার ইয়াত্তা নেই। এই দীর্ঘ সময়ের সংঘাত, মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষতির জন্য দায়ী কে?

আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ এই  প্রশ্নের উত্তর চাইতেই পারেন। কলকাতার বিখ্যাত 'সবার উপরে' ছবির সেই প্রসিদ্ধ সংলাপের মতো দাবি জানাতেই পারেন তারা। সেই ছবিতে মিথ্যে মামলায় দোষী সাব্যস্ত বাবাকে কারাগারের অন্ধকূপ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ছেলে সর্বস্ব দিয়ে নিজেই বাবার ওকালতি করছে এবং জয়ী হচ্ছে, কিন্তু জীবনের দুর্মূল্য দীর্ঘ বারোটা বছর কালো কুঠুরিতে কাটিয়ে 'মিথ্যে' আসামীরূপী অভিনেতা ছবি বিশ্বাস কাঠগড়ায় বলে উঠেন 'দাও, ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বছর'। শুধু সংলাপ নয় একজন অসহায়-সর্বহারা মানুষের যে অভিব্যক্তি ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, পুরো আফগান জাতির ভাগ্যেও যেন তেমনই করুণ, অসহায় পরিস্থিতি বিরাজমান। কে তাদের এতোগুলো বছর, এতো রক্ত, এতো মৃত্যু, এতো ধ্বংস ফিরিয়ে দেবে?

আফগান প্রশ্নে আমেরিকা নানা লাভ-ক্ষতি এবং দায়-দায়িত্বের মূল্যায়ন করছে। অতি-স্পর্শকাতর আফগানিস্তান ইস্যুতে সেখানে চলছে তীব্র বাদানুবাদ। সেসব তর্ক-বিতর্ক মোটেও গ্রাহ্য না করে নিজের সিদ্ধান্তকে 'সঠিক' জানিয়ে অনঢ় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমেরিকার দুটি নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কস্ট অব ওয়ার' প্রজেক্ট যে ভয়াবহ ক্ষতির বিবরণ দিয়েছে, তাতে আমেরিকার জাতীয় স্বার্থে আফগানিস্তান থেকে বাইডেনের পিছিয়ে আসার বিষয়টি 'দূরদৃষ্টিসম্পন্ন' বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তথাপি বিভাজিত আমেরিকান জনমতের সামনে এই প্রশ্নও থেকেই যাচ্ছে যে, আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণকারী বুশ, ওবামা, ট্রাম্প সঠিক ছিলেন নাকি সৈন্য প্রত্যাহার করে বাইডেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসবই এখন আবর্তিত আমেরিকার পণ্ডিতমহল ও থিঙ্কট্যাঙ্কে।

অন্যদিকে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কেনেডি স্কুল' এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ওয়াটসন ইনস্টিটিউট' আফগান যুদ্ধের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তৈরি করেছে, তাতে বাইডেনের সৈন্য প্রত্যাহারের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ সীমাহীন খরচে বছরের পর বছর পরিণামহীন যুদ্ধে আমেরিকা কত প্রাণের মূল্য আফগানিস্তানে দিয়েছে এবং কতটা নিয়েছে, তা পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

‘কস্ট অব ওয়ার’-এর তথ্য বলছে, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে ৬ হাজার ৩০৭ জন আমেরিকান প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২ হাজার ৪৬১ জন আমেরিকার সেনা। ৩ হাজার ৮৪৬ জন আমেরিকার ঠিকাদার। অন্য দিকে, ২০ বছরে নিহত তালেবানের সংখ্যা ৫১ হাজার ১৯১ জন।

আমেরিকা ছাড়াও তালেবান উৎখাত করতে নেমেছিল বহুজাতিক ন্যাটো বাহিনী। এই ন্যাটোর সদস্য আমেরিকা ছাড়াও বৃটেন-সহ প্রায় ৩০টি দেশ। ২০ বছরে আমেরিকার সহযোগী ওই দেশগুলোর সৈন্যদের মধ্যে ১ হাজার ১৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তদুপরি, আমেরিকার হয়ে যুদ্ধে নামা ৬৬ হাজার আফগান সেনা ও পুলিশ মারা গিয়েছেন। এমনকি আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল যে সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, তাদেরও ৪৪৪ জন মারা গিয়েছেন সেনা-তালেবান সংঘর্ষে।

২০ বছরের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে বলি হয়েছেন বহু সাংবাদিক। তালিকায় শেষ নাম পুলিৎজার পাওয়া ভারতীয় চিত্র সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি। তার মতো আরও ৭১ জন প্রাণ হারিয়েছেন আফগানিস্তানের পরিস্থিতির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে। এরা সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন।

কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক তথ্য হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন না এমন ৪৭ হাজার ২৪৫ জন আম আফগান জনতা মারা গিয়েছেন। যারা আফগানিস্তানে থাকার মূল্য দিয়েই চলেছেন। চলে আসার আগেও বিমানবন্দরে রকেট হামলার জবাবে আমেরিকার ড্রোন হানায় একই আফগান পরিবারের ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে সাত জনই শিশু এবং নাবালক।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কেনেডি স্কুল'-এর এসব তথ্যের বাইরে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ওয়াটসন ইনস্টিটিউট'-এর তথ্যানুযায়ী, ২০০১ সালে আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ পর আমেরিকা সর্বমোট ২.৩১৩ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এই খরচের বিষয়টি কেবল আফগানিস্তানের ভেতরে হয়েছে। এর বাইরে পঙ্গুদের পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও বীমা ব্যয়ের বিশাল অঙ্ক রয়েছে। ১/১১ পরবর্তী আমেরিকার মোট যুদ্ধ সংক্রান্ত খরচের সিংহভাগই ব্যয় হয়েছে আফগানিস্তানে। আর এ সময়কালে উভয়পক্ষের প্রায় তিন লক্ষ মানুষ আহত, নিহত কিংবা উদ্বাস্তু হয়েছেন, যে মানবিক বিপর্যয়ের চিত্রটিও মর্মন্তুদ।

ফলে করোনায় চরমভাবে আক্রান্ত আমেরিকার আর্থিক অধঃপতন, বেকাত্ব ও অন্যান্য সঙ্কট মাথায় রেখে বিপুল ব্যয়ের অলাভজনক ও ফলাফলবিহীন 'আফগান প্রজেক্ট' থেকে বাইডেনের সরে আসায় আমেরিকার 'ইমেজ' বা 'সুপ্রিমেসি' আপাতত নষ্ট হলেও অপরিসীম লোকসানের বোঝা কমেছে। এসব টাকা এখন অতীব জরুরি জনস্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক-মানবিক খাতে ব্যয় করা সম্ভব হবে।

যদিও ৩১ আগস্ট তারিখটি ক্যালেন্ডার ছোঁয়ার এক মিনিট আগেই আফগানিস্তান ছেড়েছে আমেরিকার সেনা। রাতের অন্ধকারে মাথা নিচু করে আমেরিকার শেষ সৈন্যের হেঁটে আসার দৃশ্য দেখে থমকে গিয়েছে গোটা বিশ্ব। অনেকে তখন মনে করেছেন আমেরিকার প্রায়-পঙ্গু হয়ে যাওয়া এক সেনার আক্ষেপ, ‘এই দিন দেখার জন্যই কি আমরা এত কিছু হারালাম!’ তথাপি বাইডেন দাঁড়িয়ে আছেন আবেগ থেকে বহুদূরের বাস্তবের মাটিতে। তালেবানদের পক্ষের উন্মাদনা কিংবা বিপক্ষের ক্ষোভ-বিদ্বেষের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে প্রবীণ বাইডেন হিসাব করেছেন আমেরিকার জাতীয় স্বার্থের প্রকৃত লাভ-ক্ষতি।

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতেই জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগান নীতি প্রসঙ্গে নিজের সিদ্ধান্তের অটলতার কথাই জানালেন। বললেন, সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত 'একেবারে সঠিক' ছিল। তার দাবি, এটাই একমাত্র উপায় ছিল দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম যুদ্ধে ইতি টানার। পাশাপাশি সেনার সাহায্যে অন্য দেশের পুনর্নিমাণের ব্যর্থ চেষ্টারও অবসান হয়েছে এতে।

তবে বাইডেন আশ্বস্ত করেন যে, ৯৮ শতাংশ আমেরিকানকে উদ্ধার করা হয়েছে যারা আফগানিস্তান ছাড়তে চাইছিলেন। বাকি ২০০-৩০০ জন আমেরিকানকে নিরাপদে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে 'প্রতিশ্রুতি' দেন তিনি। তিনি বলেন, আফগান বিষয়ক 'সিদ্ধান্তের দায় আমার'। 'কেউ হয়তো বলবেন এটা আগেই করা উচিত ছিল। তাতে আমি একমত নই। তড়িঘড়ি সেনা প্রত্যাহার করলে সে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত,' জানান তিনি।

বাইডেন যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখনও আফগান নীতি ও সৈন্য প্রেরণের বিরোধিতা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েও তিনি সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে গুরুত্ব দেন। বার বারই তিনি বলেছেন, 'আমার বিশ্বাস, এটা একেবারে নির্ভুল ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। দেশবাসীকে কথা দিয়েছিলাম, যুদ্ধ শেষ করব। এই যুদ্ধ অনন্তকাল চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।'

অবশ্য সেনা প্রত্যাহার করলেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমেরিকা চলমান লড়াই চালিয়ে যাবে বলে অঙ্গীকার করেছেন বাইডেন। বিশ্লেষকদের মতে, বাইডেনের যুদ্ধ আগ্রাসী হবে না, হবে কৌশলী। যেমনটি তিনি আফগান ইস্যুতে দৃঢ়তার সঙ্গে করেছেন। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেখানে বাইডেনের আফগান নীতির তীব্র নিন্দা করেছেন সেখানে নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় থেকেছেন বাইডেন।

ফলে অদূর ভবিষ্যতে নির্ধারিত হবে আফগানিস্তানে অর্থ ও মৃত্যুর পর্বত-সদৃশ্য 'কস্ট অব ওয়ার' এবং মানবিক বিপর্যয়ের প্রকৃত দায় কার? আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণকারী বুশ, ওবামা, ট্রাম্প সঠিক ছিলেন নাকি সৈন্য প্রত্যাহার করে বাইডেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ প্রশ্নের উত্তরও একদিন জানা যাবে। ইতিহাস অবশ্যই মূল্যায়ন করবে সোভিয়েত, আমেরিকান, মুজাহিদিন, তালেবান ইত্যাদি বাহিনীর কার্যকলাপ। আজ না হলেও অদূর ভবিষ্যতে আফগান প্রজন্ম এসব প্রশ্ন নিশ্চয় উত্থাপন করবে। একদিন অবশ্যই লিপিবদ্ধ হবে, আফগানিস্তান নামক দেশটি কে বা কাদের কারণে এতো প্রাণের মূল্য আর ধ্বংসের পথ পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে?

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর