তাজমহলের একেবারে পেছনে যমুনা ভেসে চলেছে

, ফিচার

সম্প্রীতি চক্রবর্তী | 2023-08-31 22:22:51

সকাল নটায় দিল্লি থেকে রওনা, গাড়ি করে নয়ডা হয়ে আগ্রা। কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লাগবে পৌঁছতে। highway তে পড়তেই গাড়ি এগিয়ে চললো তরতরিয়ে, পেট্রোলের বদলে CNG ভরা, তাই বারবার আমাদের বাহন থামছে এক একটা পাম্পের সামনে আর সকলকে বিনা প্রশ্নে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতে হচ্ছে কিচ্ছুক্ষণ। তাতে অবশ্য চারপাশটা একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাচ্ছে।

প্রায় তিন ঘণ্টা পর একটি ধাবায় নামলাম। কৃষক আন্দোলনের লোকেদের জমায়েত কাছেই, দিল্লি-ইউপি সীমান্তে এহেন কার্যকলাপ বেশ শিহরণ জাগালো। এতদিন টিভির পর্দায় দেখছিলাম, ভারতীয় চাষিরা মাইলের পর মাইল হাঁটছে রাজধানীর উদ্দেশে, তাঁদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে। তার কিয়দংশ চোখের সামনে দেখছি এবার। অকল্পনীয় অনুভূতি, ইতিহাসকে সামনে থেকে দেখা, এসব নিয়েই তো আজ থেকে অনেক বছর পর চর্চা হবে, আমিও চাক্ষুস দেখেছি, এইটুকুই যা রয়ে যাবে স্মৃতিতে।

ধাবাটির নাম শিবা, মস্ত বড়ো শিবের ছবি লাগানো। তার পাশে খাটিয়া পাতা, ভেতরে চেয়ার-টেবিল।  আলু-পরোটা, চানা-মশলা আর দুধচা খাওয়া হলো। আচার সহযোগে পরোটা খাওয়ার যা তৃপ্তি, মাখনের রেশ আর চায়ের ওপর পুরু মালাই, এরকম আগে খাইনি কোথাও।

আগ্রা পৌঁছে হোটেলে খানিক বিশ্রাম, বেশ আরামপ্রদ ব্যবস্থা। স্নান, খাওয়া করে দুপুরে বেরোলাম আগ্রা ফোর্ট দেখতে। অটো ভাড়া করা হলো, আঞ্চলিক গান চলছে তাতে, পাশেই দিল্লি-আগ্রা মেট্রোর কাজ চলায় বিস্তর ধুলো পেরোতে হচ্ছে এই যা সমস্যা।

ফোর্টে পৌঁছে প্রথমেই একটা লাল দেওয়ালে ঘেরা জায়গা। রোদ কমে এসেছে, আকাশে হালকা কালো মেঘ, দূর্গের উচ্চ প্রাচীরের কাছে কুপি জ্বালানোর জায়গা। বিকেলের অল্প আঁধারে যদি একটু মশালের আলো কল্পনা করা যায়, তাহলে time travel নিশ্চিত।

মনে মনে সুর ভাজছি আর চারদিকের কারুকার্যে হারিয়ে যেতে বাঁধা কি! তিনটে স্বতন্ত্র জায়গা কেল্লার, দুটো লাল পাথরে তৈরি এলাকা আর মধ্যিখানে সাদা মার্বেল। ওখানে নাকি শাহজাহানকে আটকে রাখতেন আওরঙ্গজেব, পাশেই জানলা দিয়ে দেখা যায় তাজমহল।

আমি এমনিতেই বিভোর, আলো-আঁধারিতে কেল্লা যেন আরও বেশি জনশূন্য লাগছে, ইতিমধ্যে একটা খুব ভালো ব্যাপার ঘটলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠে খোলা উঠানের মতো একটা জায়গা, দেখে মনে হচ্ছে জলের পুল হিসাবে ব্যবহার হতো। লাগোয়া কয়েকটি ঘর রয়েছে, হাম্মামখানা বা স্নানের ঘর নিশ্চয়ই। আমরা ঢুকেছি সেই কক্ষে, শুধু আমরাই রয়েছি, তার মধ্যে কালো মেঘ চিঁড়ে অঝোরে বৃষ্টি। কেল্লার ফাঁকে ফাঁকে কুঠুরিতে লোকে আশ্রয় নিচ্ছে, আমরা বসে রয়েছি বাদশার স্নান ঘরে, পা ঝুলিয়ে বসেছি আপাতদৃষ্টিতে যেটা জলের পুল মনে হয়েছে।

অবিস্মরণীয় অনুভূতি, সাদা মার্বেলে বৃষ্টি পড়ছে, কালো হয়ে এসেছে চারিদিক, জনশূন্য। নিজেকে একুশ শতকের কেউ মনেই হচ্ছেনা। বৃষ্টি থামলো কিচ্ছুক্ষণ পর। হোটেলে ফিরলাম, সকালে গেলাম তাজমহল।

তাজমহল যেহেতু বহুল চর্চিত, তাই সংক্ষেপে লিখলেই ভালো। মুনস্টোন দেখে অবাক হয়েছি, আলো ঠিকরে পড়ছে, মনে হলো লোহাতপ্ত শিকে যেমন নিয়ন আলো ঠিকরে বেরোয় সেরকম কিছু। তাজমহলের একেবারে পেছনে যমুনা ভেসে চলেছে। ওখানে দাঁড়িয়ে ভাষা হারালাম। এর অবশ্য একটা কারণ আছে। কিছু বছর যাবৎ রাধাকৃষ্ণ নিয়ে মেতে আছি।  একেবারেই ধর্মের অনুভূতি নয় , স্রেফ প্রেম, উপকথা আর গানকে ভালোবেসে। এমফিলে গীত গোবিন্দ থেকে ভানুসিংহের পদাবলী পড়ার সুবাদে রাধাকৃষ্ণ নিয়ে বেশ একটা অবসেশন তৈরি হয়েছে, যমুনার কথা বাংলার কবিগান থেকে যাত্রা বা লোক সঙ্গীতে ছড়িয়ে রয়েছে। কানে বাজছে সাহানা বাজপেয়ীর গান 'আমি না গেলাম যমুনার জলে না তুলিলাম জল'।  সুনীলে গঙ্গোপাধ্যায়ের রাধাকৃষ্ণ মনে পড়ে যাচ্ছে। যমুনার সামনে দাঁড়িয়ে আমার পাগল হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

ফিরলাম হোটেলে, ব্যাগপত্তর গুছিয়ে এবার যাবো জয়পুর।

সম্প্রীতি চক্রবর্তী, পিএইচডি গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর