বন্যপ্রাণীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পর্যটকের উচ্ছিষ্ট খাবার

, ফিচার

বিভোর বিশ্বাস, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট | 2023-09-01 13:18:59

গতকাল ৩ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে পালিত হয়েছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। বিশেষ কোনো দিবস ঘিরে এসব সভা-শোভাযাত্রা তাৎক্ষণিকভাবে নেয়া নানা প্রকল্প আদৌ কি বন্যপ্রাণীদের উপকারে আসে? সে প্রশ্ন থেকেই যায় – সচেতন মহলে।

সিলেট বিভাগের সমৃদ্ধ বন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। দৈনিক সীমাহীন পর্যটকের পদভারে মুখর হয়ে গেছে সংরক্ষিত এই উদ্যান। পর্যটকদের ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট কৃত্রিম খাবারে আসক্ত হয়ে পড়ছে এক শ্রেণির বন্যপ্রাণীরা। এই খাবারের টানেই তারা আসে। কেউ একা; আবার কেউ দলগতভাবে। মনের আনন্দে খেয়ে যায়। তাতে করে তারা বনের প্রাকৃতিক খাবারের দিকে না গিয়ে একেবারে সহজে পাওয়া খাবারের দিকেই অগ্রসর এবং নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বেশি।

লাউয়াছড়ায় কৃত্রিম খাবারে অভ্যস্ত সিংহ বানর। ছবি: বার্তা২৪.কম

গাছে উৎপন্ন প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি এখন কৃত্রিম খাবারের দিকে অগ্রসর হয়ে পড়েছে এখানকার বন্যপ্রাণীরা। গাছে ঝুলে থাকা খাদ্য ছাড়াও তাদের আগ্রহ এখন মাটিতে ফেলে দেয়া খাবারগুলোর প্রতি। এর ফলে জীববৈচিত্র্যের খাদ্যশৃঙ্খল হচ্ছে বাঁধাগ্রস্থ। বাড়ছে বন্যপ্রাণীকে ঘিরে মানুষের মাঝে ছোঁয়াচে বা সংক্রামক ব্যাধির শঙ্কা।

লাউয়াছড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, একটি সিংহ বানর (Northern Pig-tailed Macaque) পর্যটকদের ফেলে দেয়া ডাবের পরিত্যক্ত অংশটি হাতে ধরে নিয়ে ডাবের ভেতরের তুলতুলে নরম অংশটি খেতে ব্যস্ত। শুধু বানরই নয়, বুনো শুকরেরাও (Eurasian Wild Boar) সদলবলে পর্যটকের উচ্ছিষ্ট খাবারের খোঁজে হানা দেয়।

এছাড়াও একটি দলছুট কোটা বানর (Rhesus Macaque) আরো কয়েকটি কোটা বানর মানুষের সংস্পর্শে থেকে থেকে প্রায় ‘গৃহপালিত’ হয়ে গেছে। ওরা আর বনের গাছে গাছে বিচরণকরা বানরদের সাথে মিশতে পারছে না। স্থানীয় মানুষসহ ট্যুরিস্টরা যা খাবার দিচ্ছে তাই মনের আনন্দে খেয়ে নিচ্ছে।

এমন দৃশ্য শুধু লাউয়াছড়াতেই নয়। দেশের বিভিন্ন সংরক্ষিত বনে এমন বিচিত্র দৃশ্যের দেখা মেলে। প্রতিদিন শত শত পর্যটক ভেতরে প্রবেশের ফলে বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ আবাসস্থল বাঁধাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে।

বিট কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রায়ই লাউয়াছড়ার গেইট সংলগ্ন আশেপাশে সন্ধ্যার সাথে সাথে বনোশুকরের দল নেমে আসে। পর্যটকেরা সারাদিন যে খাবার খেয়ে অবশিষ্ট অংশগুলো ফেলে দেয়, ওরা এসে এগুলোতে ভাগ বসায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. কামরুল হাসান বলেন, মানুষের সংখ্যা বাড়ার ফলে এই বানরগুলো সব সময় অপরচুমিস্টিক (সুযোগসন্ধানী)। দেখা যায়, ইজিফুড (সহজলভ্য খাবার) যদি পায় তাহলে সেখানে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়। যেমন ধরেন- ট্যুরিস্টদের (পর্যটক) কেউ ডাব খেয়ে ফেলে রাখছে। তারা এসে সহজে প্রতিদিন যদি ওই ডাবগুলো পায় তাহলে তারা ওই খাবারটির উপর অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

রোগজীবাণুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক পর্যটনকেন্দ্রের সামনে অনেক সময় পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইচ্ছে করেই বন্যপ্রাণীদের খাবার দেয়া হয়। যেমন- বানর বা এ জাতীয় প্রাণী যেন সবসময় এখানে থাকে, যাতে ট্যুরিস্টরা এসে দেখবে। কিন্তু এর ফলে মূলত দুটি সমস্যা হবে। প্রথমটি হলো, বানরটিও সহজলভ্য বা কৃত্রিম খাবারটির উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে যাবে। দ্বিতীয়টি হলো, একই সাথে মানুষের সাথে তাদের সংস্পর্শতা বাড়বে এবং তাতে করে রোগজীবাণু ছড়ানোর সুযোগও তত বাড়বে। যেটা বানরের জন্যও ক্ষতি; মানুষের জন্যও ক্ষতি।

প্রফেসর ড. কামরুল বলেন, এজন্য ট্যুরিস্ট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা বলছি না যে, লাউয়াছড়াসহ সংরক্ষিত বনগুলোতে ট্যুরিস্ট আসবে না। কিন্তু ট্যুরিস্ট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। লাউয়াছড়ার ট্যুরিস্ট এখন আনকন্ট্রোলড ওয়েতে (অনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি) চলে গেছে। দৈনিক যত খুশি তত ট্যুরিস্ট যাচ্ছে। এটি যেকোনো ভাবেই হোক কন্ট্রোল করতে হবে যে, নির্দিষ্ট পরিমাণের অতিরিক্ত ট্যুরিস্ট অ্যলাউ (গ্রহণ) করা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, একটি চিরসবুজ বনের ভেতর দিয়ে যত ট্যুরিস্ট যায়, তারা যে যেখান দিয়ে পারে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তার ফলে যেটা হয় সেটা হলো বন্যপ্রাণীদের ডিসটার্বেন্স (বিরক্তি) অনেক বেশি হয়। যেমন- এরা ঠিক মতো খাবার খেতে পারে না। ছোটগাছ নষ্ট হচ্ছে, ফলের গাছ নষ্ট হচ্ছে। এ সবকিছুই ট্যুরিস্টের কারণে।

বনের বন্যপ্রাণীদের কথা বিবেচনায় রেখে বনের ভেতরের যদি একটিও ফলে গাছ থাকে তাহলে সেই ফলের গাছটিকে সুরক্ষিতভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে; নয়তো বন্যপ্রাণীরা খাবে কি বলে জানান বন্যপ্রাণী গবেষক ড. কামরুল হাসান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর