কারাগার: বন্দিমৃত্যু, অব্যবস্থা, সংস্কার

, ফিচার

মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 21:34:25

কারামৃত্যুর প্রকৃত তথ্য জানতে চেয়ে মিডিয়ায় প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা 'আইন ও সালিশ কেন্দ্র'র তথ্যমতে, গত পাঁচ বৎসরে সাড়ে তিন শতাধিক কারাবন্দির মৃত্যু ঘটেছে। মিডিয়ার ভাষ্যানুযায়ী, কারাভ্যন্তরে মৃত্যুর সব ঘটনাই সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত পৌঁছার নিশ্চয়তা নেই। ফলে প্রকৃত তথ্য ও পরিসংখ্যান অধরা থেকে যায় এবং নিশ্চিতভাবেই তা প্রাপ্ত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করা হয়।

বাংলাদেশে কারাবন্দিদের মৃত্যুর প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে আমেরিকার লশন টমসন নামে এক বন্দির কথা। তিনি আটলান্টায় জেলের বন্দি অবস্থায় মারা যান। নির্যাতন ও উদ্দেশ্যমূলক অত্যাচারে নয়, ছারপোকার কামড়ে মৃত্যু হয় তার । আর তাতেই উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেদেশে। মৃতের পরিবার, নাগরিক সমাজ, আমেরিকার বিচারব্যবস্থা, জেল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো তোলপাড় শুরু করে।

এই ঘটনার জেরে বেশ কয়েক জন জেলকর্মী পদত্যাগ করেছেন। জেল সংস্কারের জন্য প্রচুর অর্থ মঞ্জুর করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ৬০০ বন্দিকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পরিবার ও মানবাধিকার কর্মীরা তাতে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের দাবি, ওই জেল বন্ধ করে দিতে হবে, এবং জেলের দায়িত্বে থাকা আধিকারিককে ‘অপরাধী’ ঘোষণা করে শাস্তি দিতে হবে। এই ঘটনা আমেরিকার জেলব্যবস্থা, জেলে মনোরোগীদের অবস্থা, এবং সামগ্রিক ভাবে জেলবন্দি কালো মানুষের অবস্থা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সরকারি তথ্য দেখিয়ে মানবাধিকার কর্মীরা দাবি করছেন, আমেরিকার জেলবন্দিদের মধ্যে রয়েছেন অনেক মনোরোগী। কিন্তু তাঁদের চিকিৎসা হয় না। সরকারি পরিসংখ্যানে আরও বলছে যে, জেলে কালো মানুষের সংখ্যা সাদা চামড়ার মানুষের থেকে পাঁচগুণ বেশি, যদিও জনসংখ্যার মাত্র ১৩-১৪ শতাংশ হল কৃষ্ণাঙ্গ।

আমেরিকার সংখ্যালঘু কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মতোই ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ভাগ্যেও শোচনীয় পরিস্থিতি বিরাজমান কারগারের বন্দিদশায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলমান। অথচ, জেলে মুসলমান বন্দির সংখ্যা ১০,৭৮৯, অর্থাৎ মোট বন্দির ৩৭ শতাংশ। এইসব তথ্য সমাজের দুর্বল, প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোণঠাসা পরিস্থিতি এবং নিপীড়িত অবস্থার পরিচায়ক।

কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলমান সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বিষ্ট আচরণের বাইরের বিশ্বের দেশে কারাগারগুলোর অবস্থা মোটেও ভালো নয়। বন্দিমৃত্য ও নিখোঁজ হওয়া ছাড়াও কারাভ্যন্তরে বিরাজ করছে অমানবিক পরিস্থিতি ও নির্বতনমূলক পরিবেশ। যেমন, সরকারি পরিসংখ্যান (৩১ মার্চ, ২০২৩) অনুযায়ী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে জেলবন্দিদের সংখ্যা ২৮,৬৭৩। যদিও রাজ্যের সমস্ত জেল মিলিয়ে বন্দি রাখার ক্ষমতা ২১,৪৭৬— এটাও একই তারিখের সরকারি পরিসংখ্যান। বাস্তবে জেলগুলোর ধারণক্ষমতা বড় জোর ১৯ হাজার। সেই জায়গায় ২৯ হাজার বন্দি থাকেন। বাংলাদেশেও প্রায়শই কারাগারগুলোতে ধারণ ক্ষমতার বহু বেশি বন্দি বসবাসের খবর প্রকাশিত হয়। যার ফলে নানা রকমের অপরাধ, যৌনরোগ ও মরণ রোগ-ব্যাধির সংক্রমণ বৃদ্ধি পায় কারাগারগুলোতে।

তদুপরি অনেক কারাগারে মহিলাদের জন্য পৃথক স্থান নেই। বন্দি মনোরোগীদের জন্য মানসিক চিকিৎসার ডাক্তার নেই। কোথাও কোথাও সাধারণ চিকিৎসকও নেই প্রয়োজন অনুপাতে। বন্দিদের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী সঠিকভাবে বিলিবণ্টন হয় না। দুর্নীতির থাবায় বন্দিদের মুখের গ্রাসও তসরুপ করার তথ্য প্রকাশ হতে দেখা যায়। বাংলাদেশে এসব নিয়ে সিভিল সোসাইটি ও মানবাধিক সংস্থাগুলো সরব না হলেও ভারতের ক্ষেত্রে একবার খোদ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু জেলে গরিব ও জনজাতি বন্দিদের সংখ্যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। জেল থেকে বন্দিদের মুক্তির চেষ্টা করার কথাও বলেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর কথায় কেউ খুব একটা কর্ণপাত করেছে বলে জানা যায় নি।

আমেরিকার এক জন কৃষ্ণাঙ্গ মনোরোগী বন্দির মৃত্যু নিয়ে যে পরিমাণ হইচই হচ্ছে, আমেরিকার জেল নিয়ে যত তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, তা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অভাবনীয়। যে কোনও ঘটনায় এসব দেশের সরকার বা আমলাতন্ত্র তথ্য চাপতে এত তৎপর, এবং সংবাদমাধ্যম এ সব তথ্য প্রকাশে এত অনীহা দেখায় যে, অবাক হতে হয়। উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে এ রাজ্যের আলিপুর জেল থেকে একজন মহিলা বন্দি নিখোঁজ হন। তাঁকে আর খুঁজে পাওয়াই গেল না। ২০২১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি আলিপুর মহিলা জেলে প্রবল পেটের রোগে বহু বন্দি হাসপাতালে ভর্তি হলেন, এক জনের মৃত্যু হল। কেন এমন ঘটল, জানা গেল না। ২১ মার্চ, ২০২০ দমদম জেলে অন্তত ছ’জন বন্দি পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন, অনেকে আহত হলেন। এমন ভয়ানক ঘটনাতেও কারও শাস্তি হল না। বারুইপুর জেলে সাত দিনের মধ্যে চার জন বন্দিকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল গত বছর জুলাইতে। এই ঘটনাতেও এখনও অবধি কারও শাস্তি হয়নি। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে 'আইন ও সালিশ কেন্দ্র' গত পাঁচ বৎসরে যে সাড়ে তিন শতাধিক কারাবন্দির মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে, তার প্রকৃত কারণ আদৌ জানা যাবে বলে আশা করা যায় না। কারাগারে মৃত্যু ছাড়াও অন্যবিধ অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্নীতির স্বচ্ছ তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আশাও বাস্তবে দুরাশা মাত্র।

কারাগার বা প্রিজন একটি বিচ্ছিন্ন ও বেষ্টিত প্রতিষ্ঠান হলেও তা সমাজেরই অংশ। কারাগার নামক একটি বিশেষ আবাসস্থলে যে আসামীরা অবস্থান করেন, তারা স্ব স্ব সমাজেরই মানুষ, বিভিন্ন জনপদ ও পরিবারের সদস্য এবং রাষ্ট্রেরই নাগরিক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গাউল, জেল, দ্য বিগ হাউজ, দ্য স্ল্যামার অথবা দ্য স্টোনি লোনসাম নামেও কারাগারের পরিচিতি রয়েছে। আইনের বিধানের আওতায় কারাগারে অবস্থিত অপরাধী ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরায় বাঁধাগ্রস্ত হন ও মৌলিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন না। আইনের বিধি মতে কারাগার সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়।

কারাগারের ইংরেজি শব্দ প্রিজন হলেও তা আদিতে প্রাচীন ফরাসী শব্দ প্রিসাউন থেকে উৎপত্তি হয়েছে এবং নানাবিধ সংস্কারের মাধ্যমে নিবর্তনের প্রতিষ্ঠান থেকে সংশোধনকারী সংস্থার রূপ পরিগ্রহ করেছে। বর্তমানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কারাগারে গ্রন্থাগার, ব্যায়ামাগার, ছোট্ট পরিসরে হাসপাতাল, প্রার্থনাগৃহ, ভিজিটিং রুম, রান্নাঘর রয়েছে। ভিজিটিং রুমে আটককৃতের পরিবার এবং আইনজীবিদের পরিদর্শনের জন্য চাপমুক্ত পরিবেশ বিরাজমান ও যথেষ্ট সময় বরাদ্দ থাকে। ১৯৫৫ সালে মানবিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে জাতিসংঘ আদর্শ ক্ষুদ্রতম আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা করেছে। এসব বিষয় বাংলাদেশ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কল্পনাতীত।

আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার বাস্তবতায় কারাগার সকল দেশেই বিদ্যমান। ২০১৬ সালের তথ্য মোতাবেক বৈশ্বিকভাবে কমপক্ষে ১১.২৫ মিলিয়ন লোক কারাগারে আটক রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে যে, এই সংখ্যা বাস্তবে আরো বেশি হতে পারে। অনুমান নির্ভর প্রতিবেদন, বিভিন্ন দেশ থেকে তথ্যের অপর্যাপ্ততা, কর্তৃপক্ষীয় সীমাবদ্ধতাই প্রকৃত তথ্য না-পাওয়ার প্রধান কারণ। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি লোক আটক আছে। ২ মিলিয়নেরও অধিক লোক আমেরিকার জেলগুলোতে রয়েছে। তবে, সেদেশে কারাগারকে অপরাধীদের সংশোধনের ব্যবস্থাও রয়েছে।

তবে, এটা সত্য যে, যতই সংস্কার ও উন্নয়ন করা হোক না কেন, কারাগার আদপে কারাগারই, যা একটি শাস্তিমূলক ক্ষেত্র। সমাজে আইনের শাসন তথা শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমনের জন্য কারাগার অপরিহার্য। কিন্তু কারাবন্দিদেরও মৌলিক মানবাধিকার রয়েছে। বন্দি অবস্থায় মৃত্যু বা নিখোঁজ হওয়া, অমানবিক, অস্বাস্থ্যকর ও বিপদজনক পরিস্থিতিতে বসবাস করা এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য ও সুযোগ না পাওয়া মোটেও কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সুশাসনের স্বার্থেই সমাজে সার্বিক মানবাধিকারের বিস্তারের মতোই কারাগারগুলোর যুগোপযোগী সংস্কার ও কারাবন্দিদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর