মণিপুরে জাতিগত সংঘাত, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 19:00:44

১. বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবেশী রাজ্য ভারতের মণিপুরের সংঘাতময় পরিস্থিতি কমার লক্ষণ নেই। মণিপুরে কুকি এবং মেইতেইদের ভয়ঙ্কর জাতি দাঙ্গার ৬০তম দিনে (২ জুলাই) এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। আহত হয়েছে পাঁচ জন। নিহতদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বুলেট বিদ্ধ হয়ে। চতুর্থ জনের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানী ইমফল এর সত্তর কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে কুমবিতে। রাতভর গুলির লড়াইয়ে পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছে। তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিদ্রোহীরা মণিপুরের সাপ্লাই লাইন দু নম্বর জাতীয় সড়কের অবরোধও চালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। যুজুধান ইউনিয়ন পিপলস ফ্রন্ট ও কুকি ন্যাশনাল এজেন্সি নিজস্ব কর্তৃত্ব বজায় রাখতে রাজনৈতিক ও সামরিক ফ্রন্টে তৎপর রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত মণিপুর সংক্রান্ত খবরগুলোর ভিত্তিতে আঁচ করা যাচ্ছে।

২. প্রায় দু’মাসের বেশি সময় ধরে উত্তেজনা অব্যাহত ভারতের মণিপুরে। মণিপুর উত্তরপূর্ব ভারতের সাতটি পার্বত্য রাজ্যের একটি, যাদেরকে একত্রে 'সেভেন সিস্টার্স' বলা হয়। অতীতে নাগা, মিজো, বড়ো জাতির সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণে উত্তরপূর্ব ভারতকে বলা হতো জাতিগত সংঘাতে অস্থির, রক্তাক্ত ও উতপ্ত অঞ্চল। মণিপুরের চলমান সন্ত্রাস, রক্তপাত ও অসন্তোষ সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির পুনরুত্থান ঘটাচ্ছে এবং উত্তরপূর্ব ভারতে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে, যা থেকে আশেপাশের অঞ্চলও মুক্ত থাকতে পারবে কিনা, এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, সংঘাতের কেন্দ্রস্থল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সন্নিহিত হওয়ায় এবং বিদ্রোহী জাতিগুলো তিন দেশেই বসবাস ও অবাধে চলাচল করায় তা আঞ্চলিক নিরাপত্তা সমস্যায় রূপান্তরিত হওয়ার বিপদ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিশেষত, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে কুকি সন্ত্রাসীদের একাধিক ঘাঁটির অস্তিত্ব থাকার ফলে নিরাপত্তা বাহিনি অভিযান পরিচালনা করেছে এবং গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার ও কিছু সন্ত্রাসী আটক হয়েছে। তদুপরি, পাহাড়ের চলমান অস্থিতিশীল পরিবেশ এবং বান্দরবানের তিন উপজেলায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটক আসছে না। এবারের ঈদের ছুটিতে পর্যটক বরণে বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়েছিল বান্দরবানের পর্যটন সংশ্লিষ্টরা, পর্যটকদের আকর্ষণে দেওয়া হয়েছিল নানা রকম ছাড়ের অফার। তবে জেলার তিনটি উপজেলায় নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকায় ঈদুল আজহার বন্ধে বান্দরবানে পর্যটকদের অগ্রিম বুকিং ছিলনা বেশিরভাগ হোটেল মোটেল রিসোর্টে। এতে হতাশ জেলার পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে পর্যটন খাতে দৈনিক কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।

এইসব তথ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যার পাশাপাশি আর্থিক সঙ্কটেরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষেত্রে। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর উন্নয়ন ও সম্প্রীতির পথে চলমান পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব বিষয় সুপ্ত হুমকি স্বরূপ এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য আগাম অশনিসংকেতের বার্তাবাহী।

৩. প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের মণিপুর রাজ্যে জাতিগোষ্ঠী সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেমে সেনাও বিক্ষোভের মুখে পড়েছে। দু’মাসের চলমান উত্তেজনা অব্যাহত থাকায় মণিপুরে সফর করেছেন শাসক দল বিজেপি নেতা ও ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এবং অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী। নেতারা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গিয়েছেন এবং মেইতেই, কুকি ও নাগাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মণিপুর পেট্রিয়টিক পার্টি মনে করে, কংগ্রেসের আমলেই মণিপুরের এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। কংগ্রেস সরকারই ১৯৪৯ সালে স্বাধীন মণিপুরকে জোর করে ভারতে অঙ্গীভূত করেছিল। মণিপুরবাসী কখনও সেই একত্রীকরণ মানতে পারেনি বলেই রাজ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা হয়।

মণিপুরের কিছু রাজনৈতিক সংগঠন আরও দাবি করেছে যে, কংগ্রেসই বরাবর কুকিদের ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থে ব্যবহার করেছে এবং পৃথক কুকিল্যান্ডের স্বপ্ন দেখিয়েছে। তার জেরেই বর্তমানে পাহাড় থেকে মেইতেইদের বহিষ্কার করে পৃথক রাজ্যের দাবি তুলছে কুকিরা। তাদের আরও অভিযোগ, কুকি জঙ্গিদের দমন না করে সংঘর্ষবিরতি চুক্তি করার আড়ালে কংগ্রেস সরকার আসলে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নাগা ও মেইতেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছিল।

৪. এদিকে, মণিপুরে কুকিরা পৃথক রাজ্য বা পৃথক প্রশাসনের জন্য যখন সরব, তখনই সেই দাবিতে ইন্ধন জুগিয়ে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলছেন, ১৯৬১ সাল থেকেই তাঁর দল সব জো গোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় আনার জন্য লড়ছে। সরাসরি সব জো-কুকি জনগোষ্ঠীকে একজোট করার কথা বলে জোরাম শাসকদল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএ)-এর সভায় বলেন, আমি প্রতিবেশী মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহকেও জানিয়েছি, এমএনএফের প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল সব জো-কুকিদের একত্রীকরণের উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য, মণিপুরের প্রায় ১২ হাজার জো-কুকি এখন মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন। মণিপুরের কুকি এলাকায় বৃহত্তর মিজোরামের দাবি লেখা দেওয়াল লিখন, পোস্টার চোখে পড়ছে। সেখানকার ১০ জন বিধায়ক একজোট হয়ে পৃথক প্রশাসন দাবি করেছেন। ভারতের কেন্দ্রের তৈরি শান্তি কমিটিকে ইতিমধ্যেই বয়কট করেছে কুকি সংগঠনগুলো। তারা স্পষ্ট জানিয়েছে, পৃথক কুকি এলাকা তথা পৃথক প্রশাসন বাদে তাদের আলোচনার আর কোনও জায়গাই নেই। এই পরিস্থিতিতে জোরাম আগেও কুকিদের একত্রীকরণের কথা বলেছিলেন। প্রতিবাদে আসামের মেইতেইরা মিজোরামের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দিয়েছিল। তখনকার মতো চুপ করে গেলেও দেখা যাচ্ছে জোরাম কুকিদের একত্রীকরণের স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। যদিও তিনি বলেন, “মণিপুরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমার হস্তক্ষেপ করার কোনও জায়গা নেই। কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্যের সমগোষ্ঠীয় ভাইবোনেরা তা চাইতেই পারেন।”

ফলে মণিপুরের সমস্যা যে শুধুমাত্র মণিপুর রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নেই তা বুঝতে অসুবিধা হয়না। আশেপাশের রাজ্যে বসবাসকারী কুকি ও সমগোত্রীয় উপজাতিগুলোর মধ্যেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। এমতাবস্থায়, মণিপুর ও ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী মায়ানমার ও বাংলাদেশে বসবাসীকারী কুকি সম্প্রদায়ের অবস্থান নিঃসন্দেহে অনুমেয়। জাতিগত ও ধর্মীয় অভিন্নতা তথা নব্য-দীক্ষিত খ্রিস্টান পরিচিতি তাদেরকে উগ্র জাতীয়তাবাদী 'কুকিল্যান্ড' আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে একাত্ম করতেই পারে এবং ভারত, মায়ানমান ও বাংলাদেশে বসবাসীকারী জনগোষ্ঠীকে বৃহত্তর কুকি জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায়-সৃষ্ট উগ্রপন্থার মাধ্যমে 'বৃহত্তর কুকিল্যান্ড' আন্দোলনের দিকে সশস্ত্রভাবে ঠেলে দিতে পারে। ফলে বাংলাদেশে কুকিদের সামরিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা এবং প্রশিক্ষণ শিবির ও ঘাঁটি সংক্রান্ত তথ্যগুলোকে সামগ্রিক আঞ্চলিক পরিস্থিতির বাইরে এসে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ কম।

৫. গণমাধ্যমের আরেক খবরে জানা যায়, মণিপুরে বিদ্রোহীদের দ্বারা পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে লুঠ হওয়া অস্ত্র বিক্রির চেষ্টার সময় সেনা ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছে ৭টি অস্ত্র ও ২১৮ রাউন্ড গুলি মেলে। এখন পর্যন্ত লুট হওয়া ৪ হাজারের বেশি অস্ত্রের মধ্যে ১১১০টি অস্ত্র, প্রায় ১৪ হাজার গুলি এবং ২৫০টি বোমা উদ্ধার হয়েছে।

সূত্র বলছে, মণিপুরের গ্রামের দিক থেকে বিনা উস্কানিতে সেনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ভারতীয় সেনার টুইটার হ্যান্ডল ‘স্পিয়ার কর্পস’-এর তরফে জানানো হয়, মণিপুরের হারাওথেল গ্রামে টহল দেওয়ার সময়ে হঠাৎই ভোরের দিকে সেনা আধিকারিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা। সেনার তরফে জানানো হয়েছে, ‘পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি’ এড়াতে পাল্টা গুলি চালায় তারাও। সেনার তরফে এ-ও জানানো হয়, সামরিক তৎপরতার সমান্তরালে বিপুল সংখ্যক উন্মত্ত জনতা ওই এলাকায় জড়ো হয়েছিল। পরে সন্ধ্যার দিকে উন্মত্ত জনতার ভিড় নিয়ন্ত্রণে আনে সেনা।

প্রসঙ্গত, গত ৩ মে মণিপুরের জনজাতি ছাত্র সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’ (এটিএসইউএম)-এর বিক্ষোভ-মিছিল ঘিরে উত্তরপূর্বের ওই রাজ্যে অশান্তির সূত্রপাত। মণিপুর হাই কোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরেই জনজাতি সংগঠনগুলো তার বিরোধিতায় পথে নামে। আর সেই থেকেই মণিপুরে সংঘাতের সূত্রপাত, যার নেতৃত্ব দিচ্ছে কুকি এবং সমগোত্রীয় উপজাতি গোষ্ঠীগুলো। পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলন সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে। সরকারি অস্ত্রভাণ্ডার লুট করা ছাড়াও ভারত-মায়ানমার-বাংলাদেশের সংযোগ ত্রিভুজে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও সহজে অস্ত্রের জোগান পাওয়ার কারণে পরিস্থিতি সশস্ত্র রূপ পেতে বিলম্ব হয়নি।

৬. ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুরের জ্বলন্ত পরিস্থিতি ও সন্ত্রাসের দায় আপাতদৃষ্টিতে কুকি জাতিগোষ্ঠীর দিকেই আঙুল তুলেছে। মণিপুরের এই বিশেষ সহিংস পরিস্থিতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এবং দুটি জাতিগোষ্ঠীর সংঘর্ষের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিক্রিয়া কিরূপ হতে পারে, তা নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞগণ।

অভিযোগ করা হচ্ছে, যখন সহিংসতা শুরু হয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন কর্ণাটকে বিজেপির পক্ষে প্রচার করছিলেন (সেখানে ১০ মে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শাসক দল হেরে যায়)। পরেও তাঁর নীরবতা অব্যাহতই ছিল এবং তিনি জাপান, পাপুয়া নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্যস্ত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার যাওয়ার কথা ছিল; তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনা বাতিল করার পরেও মোদি অস্ট্রেলিয়া যান। সেখানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। অথচ মোদি মণিপুরে মৃত্যু নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেননি বা রাজ্যে খ্রিষ্টানদের গির্জা ধ্বংসের কথাও উল্লেখ করেননি।

মোদির মন্ত্রিসভার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহিংসতা শুরু হওয়ার ২৭ দিন পরে মণিপুর সফর করেন ও ত্রাণের প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর আগে সেখানে দুই দিনের সফরে যান ভারতের সেনাপ্রধান। সহিংসতা তখন আরও ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালে চীনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ এক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মণিপুরে বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এখন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য মণিপুরে আবার সৈন্য পাঠানো হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্ভবত রাজ্যে স্বাভাবিক অবস্থার দ্রুত প্রত্যাবর্তনের আশা করছে, কিন্তু মোদি সরকারের কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া তা অসম্ভব বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞগণ।

৭. সামগ্রিকভাবে ও প্রধানত মণিপুরের সাম্প্রতিক সহিংসতাকে একটি নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর ঐতিহাসিক পটভূমি ও রাজনৈতিক দিকটিকে এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্বকে মোটেও অবজ্ঞা করা সমুচিত নয়। বিশেষত, রাজনীতি যদি বিবদমান জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সেতু নির্মাণের বদলে বিভাজনকে আরও উস্কে দেয়, তাহলে পরিস্থিতির অবনতি ও সহিংসতার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। এই অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র জাতিগত সংঘাতের কারণ হয়েছে। মণিপুরের ক্ষেত্রে কুকিরা রাজনীতিবিদ ও পুলিশকে অবিশ্বাস করে। অস্ত্রাগার লুট করে। সহিংসতা পথে যেতে চায়। তেমন নাজুক ও ভঙ্গুর পরিস্থিতে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হলেও সহজে শান্তি আসেনা। সেনা ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করতেই থাকে, যা আগেভাগে রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। ফলে শুধু মণিপুরই নয়, আশেপাশের ভারতীয় রাজ্যগুলোতেও জাতিগত অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব নিরসনে আলাপ-আলোচনা ও শক্তিশালী রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়। একইভাবে, ভারতের পার্শ্ববর্তী মায়ানমান ও বাংলাদেশের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অটুট রাখার জন্য প্রথমেই সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজনৈতিক শক্তিকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

বিশেষত, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল বলে বেশ স্পর্শকাতর ও বিপদজনক। কারণ, উপজাতিগুলোর অনেক সদস্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বসবাস করায় তাদের স্বজাতীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা ভুলভাবে প্রভাবিত হতে পারেন। যদিও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিগণ শান্তিচুক্তির কাঠামোর মধ্যে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে অধিকার অর্জন করে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি পথে চলেছেন, তথাপি তাদেরকে উস্কানি দিয়ে বিপথগামী করার সুযোগ নেওয়া স্বার্থবাদী গ্রুপের পক্ষে অসম্ভব নয়। এসব বিষয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিরসন হতে পারে। বিশেষত, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে সন্ত্রাসবাদী অপশক্তিকে প্রতিহত করার কাজে।

৮. মণিপুরের জাতিগত সন্ত্রাসের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক। আশেপাশের বিস্তৃত অঞ্চলে এ অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে। মিয়ানমারের চিন জনগোষ্ঠী ও বাংলাদেশের কুকি/বোম এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুকিদের নৃতাত্ত্বিক মিল আছে। সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে শত শত কুকি মায়ানমারে পালিয়ে গেছে। তারা বাংলাদেশেও প্রবেশ করতে পারে।

কুকিদের প্রতি অন্যায় আচরণে প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরামেও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। এ রাজ্যটি ১৯৮৬ সালে মিজো-নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। নাগাল্যান্ড রাজ্যে নাগাদের বিদ্রোহেও তাদের জাতিগত কুকি ভাইদের সহানুভূতি আছে। এটা বিশ্বের চলমান দীর্ঘতম বিদ্রোহগুলোর মধ্যে একটি। সেখানে নাগা জনগণ তাদের নিজস্ব পতাকা ও সংবিধান দাবি করেছে।

গবেষকরা মনে করেন, যদি মণিপুরে পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহ ফিরে আসে এবং এর প্রভাব যদি প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং আসামে পড়ে, তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেখানে পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন করতে হবে। তা হলে সেটা অরুণাচল সীমান্তে চীনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অবস্থানকে কমজোরি করে দেবে। ওদিকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ২০২১ সাল থেকে সেখানে শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী মণিপুরকে শান্ত করতে যত বেশি সময় নেবে, তারা ভারত সীমান্তে তত বেশি দুর্বল থাকবে। ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত অবকাঠামোগত ব্যাপক ফারাক রয়েছে। এমন পরিস্থিতির বহুমাত্রিক প্রভাব মায়ানমার ও বাংলাদেশে অনুভূত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

৯. বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে স্থানীয় বা আঞ্চলিক বিষয় অতিদ্রুত আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করে। ভারতের মণিপুর এবং তৎসংশ্লিষ্ট মায়ানমার ও বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তটরেখায় অবস্থিত হওয়ায় বৃহত্তর ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের প্রান্তিক অংশ। আর ইন্দোপ্যাসিফিকে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ইউরোপীয় শক্তিগুলো নানা মাত্রায় তৎপর। ফলে উত্তরপূর্ব ভারত ও সন্নিকটবর্তী দেশগুলোর ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বশক্তিসমূহের নজর ও আগ্রহের বাইরে নেই। অতএব, এসব অঞ্চলে নিরাপত্তা ঝুঁকি যতই বাড়বে, তারাও ততই নড়েচড়ে উঠবে।

সম্ভবত আঞ্চলিক গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে ২০১৫ সালে ভারত ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ তথা পূর্বদিকে সক্রিয় হওয়ার নীতি ঘোষণা করেছিল। এটা বাণিজ্য, সংস্কৃতি, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ এবং ভৌত অবকাঠামোর মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে কাছের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার ওপর জোর দেয়। কিন্তু অবকাঠামোগত অগ্রগতি সে অনুসারে হয়নি বললেই চলে; বিলম্বিত কিছু প্রকল্প শুধু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সচল হয়েছে। যদি মণিপুরের সহিংসতা রাজ্যের সীমানার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এটি 'অ্যাক্ট ইস্ট' নীতিকে আরও ব্যাহত করবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তাদের মতে, পরোক্ষভাবে নীতিটি মার্কিন ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে জড়িত– যা 'কোয়াড' নামক চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপের আদলে কার্যকর হচ্ছে। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি হল ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ এমন পরিবর্তন আসতে পারে, যা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পরাশক্তিগুলোর পদচারণা বাড়িয়ে নানামুখী ঝুঁকিও সৃষ্টি করতে পারে।

১০. ভারতের উত্তরপূর্বের নাজুক পরিস্থিতি বারুদভর্তি বাক্সের সমতুল্য। মণিপুরের সহিংসতা এতে ভয়ংকর স্ফুলিঙ্গ জোগাতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অতএব ইস্যুটি ভারতীয় রাজনীতির সরাসরি অংশগ্রহণ ও হস্তক্ষেপ দাবি করে। নয়াদিল্লির উচিত, শুধু সামরিক পন্থানুসরণ না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুটিন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঙ্কটের নিরসন ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ভারত যদি দ্রুত মণিপুরে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে না পারেন, তাহলে সীমান্তে চীনের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জের ঝুঁকি আরও বাড়বে এবং কোয়াডের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলব। মণিপুরের মতো প্রত্যন্ত রাজ্যে সহিংসতা ও সংঘর্ষ কোনো সাধারণ নিরাপত্তা সমস্যা নয়। এই ঘটনাবলি দক্ষিণ এশিয়া এবং বিস্তৃত ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনীতিতেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।

এমনই পটভূমিতে পার্শ্ববর্তী মণিপুরের ঘটনাপ্রবাহকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বাংলাদেশকে। ঘটনার কোনও ধরণের প্রভাব মণিপুর-সংলগ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন বিস্তার করতে না পারে, সেজন্য রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে পূর্ণ সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। যখন বাংলাদেশের সামনে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন, তখন শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অধিকতর জরুরি ও অগ্রাধিকারের বিষয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ (সিসিআরএস)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর