বইয়ের রাজ্যে একদিন: সাদা পাতার কালো হরফের ভালোবাসা

, ফিচার

মো. শরিফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:22:42

‘ক্রিং ক্রিং’ শব্দে ছুটে চলা ভ্যান আর পথচারীতে মহাব্যস্ত রাস্তার পাশে তাকিয়ে মন ভরে গেলো। চোখের আরামে নিমিষে উধাও নাগরিক কোলাহলের যাবতীয় যন্ত্রণা। এমন হট্টগোলের মধ্যে যা দেখলাম, তাকে তুলনা করা যায় ঊষর মরুভূমির মধ্যে আরামদায়ক একখণ্ড সবুজ মরুদ্যানের সঙ্গে। চারদিকে শুধু বই আর বই। দোকানের ভেতরে ও বাইরে শুধু বইয়েরই স্তুপ। সঙ্গে থাকা বন্ধুকে বললাম, এই আমায় কোথায় নিয়ে এলি ভাই! বই ছাড়া যে আর কিছু নাই!

বন্ধু হেসে জবাব দিল, লোকে একে ‘বইয়ের রাজ্য’ বলে তাই।

দুপুর বারোটায় প্রথম ক্লাসটা শেষ হওয়ার পর জানতে পারলাম বাকি ক্লাসগুলো ক্যান্সেল। বন্ধু বই কিনবে, তার অনুরোধ রাখতেই এদিকে আসা। ভীষণ বইপ্রেমী কিনা সে।

পুরনো ঢাকার বুড়িগঙ্গা ছোঁয়া ঐতিহাসিক ল্যান্ডস্কেপ সদরঘাটের মোড় ছাড়িয়ে পিকে রায় রোড, ইসলামি টাওয়ার, মান্নান মার্কেট, এ-গলি ও-গলি পেরিয়ে বন্ধু যখন তার কাঙ্ক্ষিত বইয়ের দোকানটির সামনে এসে পৌঁছালো, ততক্ষণে আমার মাথা চক্কর দেওয়ার অবস্থা। প্রতিটি দোকান আর প্রতিটি মানুষ জড়িয়ে আছে বইয়ের সাথে। কেউ হাতে নিয়ে যাচ্ছে কেউবা ছুটছে মাথায় করে। দোকান থেকে দোকানে ছুটে চলছে মানুষ। যতগুলো বইয়ের দোকান দেখলাম, তাতে মনে এক প্রশ্ন জাগলো। আজকাল মানুষ এত বই পড়ে নাকি! কিছুটা হলেও বইয়ের সাথে যারা সম্পর্ক রাখেন, তারা এতক্ষণে বুঝে গেছেন কী নিয়ে কথা বলছি। বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ বইয়ের মলাটে প্রকাশনা বা বিক্রয়কেন্দ্রের জায়গায় লিখা দেশের বৃহৎ বইয়ের মার্কেট, কথা বলছি বাংলাবাজারকে নিয়েই।

পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক আর সদরঘাটের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বাংলাবাজার। এক কথায় যেটাকে বলা যায় বইয়ের রাজ্য। বাংলাবাজার নামটা কীভাবে এসেছে জানি না, তবে নামটা বইয়ের বাজার বা বইবাজার হলে মন্দ হতো না।

আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম মান্নান মার্কেটে। এখানে দাঁড়িয়ে আগে নাকি বুড়িগঙ্গা নদী দেখা যেত। এখন সেটা আড়াল করে দিয়েছে বড় বড় দালান। কিন্তু এই দালান ছিল না শুরুর দিকে। ১৮৬০ সালে ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ ছাপাখানা থেকে ছাপা হয় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক। তখন থেকেই নানান সৃজনশীল মানুষ আর প্রকাশনার উদ্ভব হয় এখানে। একতলা দোতলা কিছু দোকান দিয়েই শুরু হয় বাংলাবাজারের পথচলা। একটি দুটি করে বাড়তে থাকে প্রকাশনা। কলকাতা থেকে আসা কিছু প্রকাশকও প্রকাশনা চালু করেন এখানে। এরপর চাকাটা খুব দ্রুতই ঘুরে।
বাংলাবাজার না আসলেও পাশে থাকা বিউটি বোর্ডিং এ যাওয়া হতো প্রায়ই। একসময় যেটা ছিল লেখক, পাঠক আর প্রকাশকদের আড্ডাস্থল। এটা অবশ্যই স্বীকার করতেই হয় যে আজকের এই বাংলাবাজার গড়ার পিছনে সেই সময়ের সৃজনশীল মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি।

অল্পবয়সী কিছু যুবককে দেখলাম এ-দোকান ও-দোকান ঘুরে বই কিনছে। কেউ ব্যাগ, কেউ দড়ি বেঁধে কেউবা বুকের সাথে লাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বই। কথা বললাম তাদের কয়েক জনের সাথে। একসাথে এতগুলো বই নিয়ে যাওয়া দেখে অবাকই হয়েছিলাম। পরে জানতে পারলাম, ছোটখাটো বিভিন্ন অনলাইন বুকশপের ওনার তারা। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে অর্ডার নেয়। পরে বাংলাবাজার ঘুরে ঘুরে কালেক্ট করে সেসব বই। এরপর প্যাকিং করে পাঠিয়ে দেয় কুরিয়ারে। শুনে খুবই অবাক হলাম। এরা সবাই স্টুডেন্ট। ক্লাস শেষ হলেই ছুটে আসে অর্ডারকৃত বইটি কেনার জন্য। বিনিয়োগ ছাড়া ব্যবসা। খুবই ভালো লাগলো তাদের কথা শুনে। জেনেছি কয়েকজনের শুরুর গল্পও। সেটা নিয়ে আরেকদিন বলব। গলি পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।

৩৬, ৩৭, ৩৮ এভাবে সংখ্যা গুনতে গুনতে দেখা পেলাম ছোট ঝুপড়ির মধ্যে বসা বই বিক্রেতাদের। রাস্তার অপরপাশে চৌকির উপর বইয়ের তাক নিয়ে বসা এই বিক্রেতারা মূলত পুরাতন বই বিক্রয় করে। বাংলাবাজার, যার পুরোটা জুড়ে নতুন বইয়ের গন্ধ ভেসে বেড়ায়, সেখানে তারা বসে আছে পুরাতন বই নিয়ে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। সালাম দিয়ে টুপি পড়া বৃদ্ধ চাচাকে বই বিক্রয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে একটা হাসি দিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। মনটা ভরে গেল সাথে সাথে। তবে ভিন্ন কথা জানালো নতুন বইয়ের দোকানদাররা। কাগজের দাম বৃদ্ধি, আর প্রযুক্তিকে দোষী করে জানালেন, বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে। আগে স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের ভীড় লেগে থাকতো, কিন্তু এখন নতুন পাঠক দেখাই যায় না। যারা আসে তারা হয় লাইব্রেরিয়ান না-হয় পুরাতন পাঠক, কিংবা একাডেমিক বইয়ের খোঁজে আশা শিক্ষার্থী।

বিক্রেতাদের শেষের কথাগুলো উপলব্ধি করলাম। সত্যিই আজকাল আমাদের বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। পাঠ্য বইয়ের মাঝে লুকিয়ে গল্প-উপন্যাস পড়া, টিফিনের টাকা জমিয়ে বই কেনা এগুলো আজকাল শুধু লেখকদের লেখনীতেই দেখা যায়। বাস্তবতায় আমরা বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছি খুব দ্রুত গতিতেই। প্রযুক্তির সহজ লভ্যতায় হয়তো এর জন্য দায়ী, কিংবা আমাদের জেনারেশনটাই এমন! হয়তো প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে আমাদের পাঠাভ্যাস। আমরা ই-বুক আর সাইবার জগতের ভার্চুয়াল স্পেসে মেতে হারাচ্ছি নিমগ্ন পাঠচর্চার শাশ্বত আনন্দ। এতোসব পালাবদল, পরিবর্তন ও রূপান্তরের পরেও মুদ্রিত বই কিন্তু আমাদের অন্তরস্পর্শী ডাক দেয় সাদা পাতার কালো হরফের ভালোবাসায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর