‘অথৈ জলে মাঠঘাট থৈ থৈ, আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?’

, ফিচার

মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 22:05:32

চলে যাওয়ার আগে বর্ষা ঋতু আকাশ-ভাঙা বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিয়েছে চরাচর। শেষ শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ মথিত স্মৃতিতে জাগ্রত হয়েছে বর্ষণের বেদনা। স্মৃতির ভেলায় ভেসে আসছে বাংলার চিরায়ত বর্ষার শাশ্বত রূপ। মনে পড়ছে কাজী নজরুল ইসলামের বর্ষার গান 'অথৈ জলে মাঠঘাট থৈ থৈ, আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?’ আরো মনে পড়ে লোকপ্রিয় সেই গান 'শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না।'

বাংলা সঙ্গীত জগতের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভা নজরুল গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ঋতু নিয়ে প্রচুর গান রচনা করে ঋতুভিত্তিক গানের সংখ্যা বিচারে অগ্রগামী আর তাঁর গানে বর্ষার গানের আধিক্য রয়েছে। নজরুলের গানে আছে কালীদাসের মেঘদূত, রাধা-কৃষ্ণের কাজুরী কিংবা ঝুলনের আংগিকও: ‘যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে, আমার বিরহলিপি লেখা কেয়া-পাতে।'

নজরুলের বর্ষা ঋতুর গানে খেলা করেছে প্রেম ও বিরহ: ‘দোলে বন তমালের’, ‘গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে’, ‘সখী বাঁধো লো বাঁধো’, ‘এলো কৃষ্ণ কানাইয়া’, ‘সোনার হিন্দোলে কিশোর’ এসব গান বর্ষা আর প্রেমের দোলাচলে একাকার। নজরুলের বর্ষার গানগুলোতে এসেছে প্রেমিকা প্রিয়ার অনবদ্য বর্ণনা: ‘আমার প্রিয়ার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে, থির হয়ে আছে মেঘ যে দেশের আকাশে।’ কিংবা ‘মেঘ-ঘন-কুন্তলা’ বা ‘কাঁখে বরষা-জলের ঘাগরি’ বা ‘এলায়ে মেঘ-বেণী, কাল-ফণী, আসিল কি দেব কুমারী’।

বর্ষার প্রকৃতিতে কবি প্রিয়ার সন্ধানে হয়েছেন উতলা: ‘কত বরষায় খুঁজেছি তোমায়, তারায় তারায়।’ আবার পল্লী বালিকার ছবিও এঁকেছেন তিনি প্রেমময় আবহে: ‘কাজল বরণ পল্লী মেয়ে, বৃষ্টি ধারায় বেড়ায় নেয়ে, মেঘের পানে চেয়ে একেলা, মেঘলা সকাল বেলা।’

নজরুলের কিছু কিছু বর্ষার গান লাভ করেছে কিংবদন্তির মর্যাদা: ‘পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে, বলিও আমার পরদেশীরে/সে দেশে যবে বাদল ঝরে, কাঁদে নাকি প্রাণ একেলা ঘরে/বাদল রাতে ডাকিলে পিয়া/উঠে নাকি…হিয়া।’

বেদনায় আপ্লুত হয়েছেন কোনো কোনো গানে: ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে…’। গানটি নিয়ে যুগে যুগে উভয় বাংলায় বহু বিখ্যাত চলচ্চিত্রের কাহিনীতে বরষা, বিরহ, প্রেমের আবহ তৈরি করা হয়েছে। জনপ্রিয় সব শিল্পী এ গানে কণ্ঠ দিয়ে আরো বিখ্যাত হয়েছেন।

নজরুলের বর্ষার গানে প্রেমের পাশাপাশি বিরহও ধরা দিয়েছে সুতীব্র আবহে: ‘ঝুরিবে পূবালী বায় গহন দূর বনে, রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।/বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নীপ শাখে, যমুনা নদী পাড়ে শুনিবে কে যেন ডাকে।’ কিংবা ‘বাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া, নামিল মেঘলা মোর ভাদরিয়া, চল তমাল তলে গাহি কাজরিয়া, চললো গৌরী শ্যামলিয়া।’

বর্ষা, প্রিয়া আর বিরহের দৃশ্য আরও অনেক গানেই এঁকেছেন প্রেমের কবি নজরুল ইসলাম। যেমন ‘অথৈ জলে মাঠঘাট থৈ থৈ, আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?’ কিংবা ‘এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া, ফুটাইয়া যূঁথি-কুন্দ-নীপ-কেয়া, বারিধারে এসো চারিধার ভাসায়ে, বিরহী মনে জ্বালায়ে আশা আলেয়া’। আরও ‘কেমনে রাখি আঁখি বারি, এ ভরা ভাদরে আমারই মরা নদী, উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি।’

অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ (কবি, গল্পকার ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী) একটি গদ্যে লিখেছেন, কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, বর্ষা ঋতু, আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাস নিয়ে নজরুলের প্রায় দেড় শতাধিক গান রয়েছে। এর মধ্যে শ্রেণি-বিভাজনও রয়েছে। যেমন কাজরী ২৩, কাব্য-গীতি ৪১, রাগপ্রধান ২৪, খেয়াল ২৫, ঠুমরি ২, আধুনিক ২৯, ঝুলন ৪, চৈতী ৩ এবং ৪ খানি হিন্দি গান। পুরো বর্ষা ঋতুর দেড় শতাধিক গানের মধ্যে শ্রাবণ মাস নিয়েই রয়েছে নজরুলের অনবদ্য ৬০টি গান।

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুলের বর্ষার গান নিয়ে বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে একটি পূর্ণ একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, যেসব গানের কথা-সুর বৃষ্টি ও বর্ষার সমান্তরালে আকাশ ভেঙে বর্ষণে আর হৃদয় ছোঁয়া স্পন্দনে সঞ্চারিত হয় বাংলা গানের শ্রোতাদের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর