‘সিন্ধু বাংলাদেশের সঙ্গে এক হতে চায়’

, ফিচার

আশরাফুল ইসলাম | 2023-11-06 14:10:34

 

(পূর্ব প্রকাশের পর...)

ভারতীয় গণমাধ্যম এমন অনেক বিরল তথ্য জনসমক্ষে এনেছিল যে, নব্য ঔপনিবেশিক পাকিস্তান জান্তাদের অনেক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। খোদ পাকিস্তানে বহু নাগরিকের বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের খবরও প্রকাশ করে ভারতীয় গণমাধ্যম। 

‘মুজিবের কাছে অনুরোধ/সিন্ধু বাংলাদেশের সঙ্গে এক হতে চায়’ শিরোনামে একটি খবর বেশ হইচই ফেলেছিল সেই সময়। ১৫ আগস্ট ১৯৭১ এ যুগান্তরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা এই পাকিস্তান চাই না। যদি পরিস্থিতি পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য করে তাহলে দয়া করে তাহলে দয়া করে আপনি সিন্ধুকে আপনার সঙ্গে রাখবেন, নইলে পাঞ্জাবীর জুলুম ও অত্যাচারে সমগ্র সিন্ধু ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনি যদি পূর্ব বাংলা ও সিন্ধুকে নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠন করেন তাহলে আমরা সানন্দে তা মেনে নেব, এবং পাঞ্জাবী ও মোহাজেরদের পরিবর্তে বাঙালী ভাইদের বুকে তুলে নেব।’


‘বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার আগে সিন্ধু প্রদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে একখানি চিঠিতে এই কথাগুলি লিখেছেন। ঢাকা জিপিও-ও এক কর্মী শরণার্থীর কাছ থেকে উর্দুতে লেখা এই চিঠিখানি আমাদের আগরতলা প্রতিনিধি শ্রীঅনিল ভট্টাচার্য সংগ্রহ করেছেন। পাকিস্তানী পাঞ্জাবী শাসকচক্র কীভাবে সিন্ধুকে শোষণ করে তাকে ধ্বংসের মুখে এনে দিয়েছে তার এক করুণ চিত্র পত্রলেখকগণ এঁকেছেন এই চিঠিতে এবং শেখ মুজিবরের কাছে প্রতিকার প্রার্থনা করেছেন’

ওই প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়, ‘শেখ মুজিবরকে তারা তাঁদের নেতা বলে মেনে নিয়েছেন। এই চিঠিতে তাঁরা জুলফিকার আলী ভুট্টোর মুখো খুলে তাঁর চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো উদ্ঘাটন করে দিয়েছেন। তাঁরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য শেখ মুজিবরের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ভারত কখনো তাদের আক্রমণ করেনি। পাকিস্তানই দু-দুবার ভারত আক্রমণ করেছে। তাঁরা বলেছেন, ভারতের সঙ্গে তাঁদের কোনো শত্রুতা নেই। বরং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলে পাকিস্তানের উন্নতি দ্রুততর হবে। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস, শেখ মুজিবরই পাকিস্তানের অত্যাচারিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন। ৮ মার্চ (১৯৭১) তারিখে শেখ মুজিবরের কাছে উর্দুতে লেখা এই চিঠিখানা আমাদের হস্তগত হয়েছে।’


পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রহসনের বিচার নিয়ে ভারতীয় সংবাদপত্র নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেইসব প্রতিবেদন বিশ্ববাসীর কাছে মুজিব মুক্তি দাবিকে আরও প্রবল করে তুলে।

‘সন্দেহ বাড়ছে তাই প্রশ্ন: মুজিব কী বেঁচে?’ শিরোনামে প্রকাশিত তেমনি একটি প্রতিবেদনে আমরা দেখব ‘লন্ডন, ১৪ আগস্ট-পাক জঙ্গীশাহীর আটকাধীন থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবর রহমানের স্বাভাবিক মৃত্যুও ঘটতে পারে, গত সপ্তাহে ইয়াহিয়া খানের এই বিবৃতির পর এদেশে সন্দেহ ক্রমেই বাড়ছে-‘বঙ্গবন্ধু’ আদৌ বেঁচে আছেন কিনা কিংবা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিনায়ক পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে ইতিপূর্বেই নিহত হয়েছেন?’


ডেইলি টেলিগ্রাফেরও একই প্রশ্ন

আজকের ডেইলি টেলিগ্রাফও সম্পাদকীয় স্তম্ভে একই প্রশ্নে তুলেছেন- শেখ মুজিবর কি মৃত ? মার্চ মাসে গ্রেপ্তারে পর থেকে তাঁর সম্পর্কে আর কিছুই শুনতে পাওয়া যায়নি। মাঝে ইয়াহিয়া শুধু বিবৃতি  দিয়ে বলেছেন-মুজিবকে শাস্তি দেওয়া হবে, সামরিক আদালতে গোপনে তাঁর বিচার হবে, তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, তাতে তাঁর মৃত্যুদ-ই হতে পারে।’-এমন খবরে রণাঙ্গনের মুক্তিফৌজ আরও ব্যগ্র হয়ে উঠেন শৃঙ্খলিত বাংলার স্বাধীনতার জন্য। মুজিব মুক্তির জন্য।   

বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশের পর দেশপুনর্গঠনে তাঁর প্রচেষ্টার প্রতিও ভারতীয় গণমাধ্যমের সমর্থন অব্যাহত ছিল। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের প্রচেষ্টাকে প্রেরণা যুগিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম ‘পাকিস্তানী আদর্শ’ শিরোনামে প্রকাশে প্রকটি প্রতিবেদনে সদ্য স্বাধীন দেশের মূলনীতি তুলে ধরে।


যুগান্তরের ৭ ফেব্রুয়ারির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাবেক পাকিস্তান সরকার যে তিনটি নীতি অনুসরণ করত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ সেসম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ঐ তিনটি নীতি হল: ইসলাম খতরে মে হ্যায় (ইসলাম বিপন্ন), কাশ্মীর ফতে করনে পড়েগা এবং হিন্দুস্তান হামারা দুষমন হ্যায়। ব্রিগেডের সভায় তিনি ঐ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, এরকম আদর্শে কোন সভ্য দেশ চলে না। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে সেদিকে নজর নেই, মানুষের পরনে কাপড় নেই সে কথা বলে না। কেবল বলে হিন্দুস্তান আমাদের দুষমন, হিন্দুরা আমাদের দুষমন। ঐ নীতির প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, হিন্দুরা আমাদের দুষমন হবে কেন? তারা তো আমাদের ভাই।’ (চলবে)

এ সম্পর্কিত আরও খবর