(পূর্ব প্রকাশের পর)
যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অতি দূর্গম এই এলাকায় অবস্থিত পুকুরপাড়া এবং আশপাশের অঞ্চলগুলো বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, অর্থনৈতিক সুবিধা, ব্যবসা বাণিজ্য এবং সকল মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এখানকার প্রধান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কার্যাবলি জুম চাষকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। ঘরবাড়িগুলো সাধারণত: পাহাড়ি উঁচু জায়গাতেই নির্মিত হয় এবং বেশিরভাগ ঘরবাড়ি বাঁশ, বেত, ছন এবং কাঠ দিয়ে পরিবেশ উপযোগী করে নির্মিত। ঘরবাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে ম্রো, ত্রিপুরা, মার্মা, খেয়াং এবং খুমি সম্প্রদায় একই আদল অনুসরণ করে থাকে।
উপার্জনের জন্য এরা সবাই জুম চাষের উপর নির্ভরশীল হলেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে বাগান চাষের উপরও ঝুঁকছেন। জুম চাষ বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় হয়। যেমন- জানুয়ারি-মার্চ মাস হলো জুম কাটার সময়। এসময় কাঁচা জঙ্গলকে কেটে শুকানো হয় এরপর মার্চ-মে মাসে শুকানো জঙ্গলটিকে চাষের উপযোগী করার জন্য পোড়ানো হয়। পরবর্তীতে পোড়ানো জুমটিকে পরিস্কার করে মে-জুন মাসে এক বছরের জন্য ধান, ভুট্টা, তিল, হলুদ, কাকন চাল, মারফা (শশা) এবং অন্যান্য শাক সবজি রোপণ করা হয়। রোপণের পরবর্তী সময়ে ধান এবং অন্যান্য রোপণকৃত শস্যগুলোকে দ্রুত বৃদ্ধি করার জন্য ২/৩ বার পরিষ্কার করা হয় জুমকে। এরপর আগস্ট-অক্টোবর মাসে ধান কাটার মৌসুম চলে।
মূলত: এই সময়গুলোতে পাহাড়িরা জুমের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকে এবং জুমকেন্দ্রিক জীবন করে। গ্রাম ছেড়ে অনেকেই এসময় দূরে টং ঘরে (এটি একধরনের জুমে নির্মিত ঘর যা জুমে থাকাকালীন জুমিয়ারা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে) গিয়ে ২/১ মাস অথবা কয়েকদিনের জন্য থাকে, যাতে তারা নিবিড়ভাবে কাজ করতে পারে এবং পশু-পাখির আক্রমণ থেকে জুমকে রক্ষা করতে পারে। শুকনো মৌসুমের জুমের উৎপাদিত ফসলাদি এবং অন্যান্য তরকারি পাহাড়িরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে বর্ষা এবং অন্যান্য ব্যস্ততম সময়ে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। দূর্গম হওয়ার কারণে বাজারে নিত্যপণ্য এই অঞ্চলের মানুষেরা মাসের এক দিন অথবা সপ্তাহের বাজারদিনে সংগ্রহ করে থাকে। গ্রামের লোকজন দলবেঁধে দু’একদিনের হাঁটা পথ অতিক্রম করে বাজার করতে যায়।
স্থানীয় বাজারে এসে সবাই পাহাড়িদের থাকার হোটেল, যেগুলোকে ত্রিপুরারা ‘বাঁদালী’ বলে, সেখানে অবস্থান করে। তবে স্থানীয় পাহাড়িদের এই হোটেলে থাকার চিত্রটি একটু আলাদা। শহরের আবাসিক বা অনাবাসিক হোটেলগুলোর বিপরীত চিত্র এখানে দেখা যায়। এসব স্থানীয় হোটেলে থাকতে হলে নিজ উদ্যোগেই পরিমাণমতো ভাগের চাল, (কেনা হোক বা বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হোক) হোটেল মালিকের কাছে জমা দিতে হয়।
তবে চালের পরিবর্তে চালের বাজারমূল্যের পরিমাণ টাকাও জমা দেয়া যায়। তরকারির জন্য স্থানীয় বাজারের মূল্য অনুসারে পেট প্রতি ৫০/৬০ টাকা মালিককে দিতে হয়। এভাবে আদিবাসীরা গ্রাম থেকে দিনে এসে বাজারে রাত্রি যাপন করে ভোরবেলা বা পরদিন সকালে সপ্তাহের বা মাসের বাজার করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যেসব পণ্য জুম থেকে উৎপন্ন হয় না অথবা নিজেরা উৎপাদন করতে পারেনা সেগুলোই পাহাড়িরা বাজার থেকে কিনে নিয়ে যায়।
বাজার থেকে তারা লবণ, নাপ্পি (শিদোল)/শুটকি, তেল, সাবান ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে থাকে। অপরদিকে বিক্রি করার জন্য জুমজাত কৃষি পণ্য তারা বাজারে নিয়ে যায়। জুম চাষের উপর অতিনির্ভরতার কারণে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ততো উন্নত নয়। তবে যারা গবাদিপশু যেমন-গরু, গয়াল, ছাগল, শুকর ইত্যাদি পালন করে থাকেন তাদের অর্থনৈতিক দিক বেশ ভালো। গরু বা গয়াল বিস্তীর্ণ পাহাড়ি জঙ্গলে ছেড়ে দিলে নিজেদের মতো করে খাবার গ্রহণ করে। কোন নির্দিষ্ট প্রয়োজনে মালিক জঙ্গল থেকে এগুলোকে ধরে এনে বিক্রি করে। যাদের গরু অথবা গয়াল আছে তাঁরাই মূলত সন্তানদের শহরে পড়ালেখা করাতে সক্ষম।
জুম চাষের মাধ্যমে আয়কৃত টাকা সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্য খরচ যথেষ্ট না হওয়ায় অনেকেই সšতানদের শহরে পড়ালেখা করার জন্য পাঠাতে পারেন না। আবার অনেক পিতামাতার সচেতনতার অভাবে শহরে এসে শিক্ষার্থীরা ৭ম, ৮ম ও ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার পর ঝরে পড়ে। কিন্তু এরা পরবর্তীতে গ্রামে এসেও জুম চাষে মনোনিবেশ করতে পারেন না। ফলে তারা শহরে অভিবাসিত হয়ে পোশাক শিল্পে কাজ নেয়। কারণ পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে শিক্ষাগত যোগ্যতার তেমন প্রয়োজন হয় না।
আরও পড়ুন: ফ্রেমে বাধাঁনো ছবির মতো জীবন নয় যাদের
পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে বান্দরবান সদরের জাদিপাড়ায় ফাতেমা রাণী গির্জা প্রতিষ্ঠিত হলে এর মাধ্যমে শিক্ষার প্রাথমিক প্রসার ঘটে। চার্চটি বান্দরবানের দরিদ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষার সুযোগ প্রদানের জন্য হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করে। ফলে স্থানীয় মারমা, ত্রিপুরা, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো এবং অন্যান্য পাহাড়িদের মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে ত্রিপুরা গ্রামগুলোতে চার্চের অধীনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং নামমাত্র বেতনে গ্রামের বেকার যুবক-যুবতীদের শিক্ষক নিয়োগ করে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে। এছাড়াও বড়থলিসহ বিলাইছড়ি সংলগ্ন বান্দরবানের অন্যান্য উপজেলা যেমন থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি, আলিকদম, লামা ইত্যাদি জায়গাগুলোতে চার্চের অধীনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা-প্রদান করা হয়।
পাশাপাশি যে গ্রামগুলো বাংলাদেশ আর্মি ক্যাম্পের অধীন, সেগুলোতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নামমাত্র বেতনে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। দূর্গম অঞ্চলগুলোতে ত্রিপুরা, বম, মারমা, খুমি এবং খেয়াংদের মধ্যে যেসব পিতামাতা শিক্ষা সচেতন তাঁরা তাদের সন্তানদের স্থানীয় চার্চ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্কুলে ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণিতে পড়িয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা বা বরিশাল জেলা শহরে শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তারা বিনামূল্যে বা কম দামে অথবা পরিচিত অনাথালয় ও আশ্রম ইত্যাদি স্থানে স্বল্প খরচে থাকতে পারে। এভাবেই এখানকার বেশিরভাগ শিশুরা ছোটবেলা থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য নিজের গ্রাম পরিবার ছেড়ে শহরে আসে।
বিলাইছড়ি উপজেলার সাক্ষরতার হার ২৬.৭০% এবং এ উপজেলায় ১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১টি মাদ্রাসা থাকলেও, ২০১৫ সালে বড়থলি ইউনিয়নে নতুন ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হওয়ার পরও কোনো সরকারি-বেসরকারি (মিশন পরিচালিত প্রাইমারি স্কুল বাদে) প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া সরকারি স্কুল না থাকার কারণে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে গ্রামের ছেলেমেয়েদের সীমাহীন দূর্ভোগ পোহাতে হয়।
উপজেলা সদর বিলাইছড়ি হলেও পুকুরপাড়া থেকে বিলাইছড়ি উপজেলা সদরে যেতে হাঁটা পথে কম করে হলেও ৭ দিন লাগে। এর চাইতে পার্শ্ববর্তী বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা পুকুরপাড়া এলাকা থেকে কাছে এবং তা মাত্র এক দিনের হাঁটা পথ। একারণে পরীক্ষার্থীরা বিলাইছড়িতে অবস্থিত স্কুলগুলোর পরিবর্তে রুমা উপজেলাতে সমাপনী স্কুল পরীক্ষা দেয়।
এপর্যন্ত পুকুরপাড়া থেকে এবং এই বড়থলি ইউনিয়ন থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন দুই জন, স্নাতকে অধ্যয়নরত রয়েছেন পাঁচ জন এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন দুই জন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন, সরকারি মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ছেন একজন এবং নার্সিংয়ে দুইজন পড়ােেশানা করছেন। অনেক গ্রামে এখনও এসএসসি বা এইচএসসি পড়ুয়া শিক্ষার্থী নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও দূর্গম কারণে এলাকায় কোন সরকারি প্রাথমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই । (চলবে...)