ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রাম-০১

ফ্রেমে বাধাঁনো ছবির মতো জীবন নয় যাদের

  • ড. শাওলী মাহবুব ও সাগর ত্রিপুরা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

২০২৪ সালে বিশ্বের আদিবাসীদের আন্তর্জাতিক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল “Protecting the rights of indigenous peoples in voluntary isolation and initial contact”-বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্নতা এবং প্রাথমিক যোগাযোগে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করা।’

বিশ্বজুড়েই অনেক আদিবাসী-জনগোষ্ঠী মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করা বেছে নিয়েছেন এবং তাদের স্বকীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। পৃথিবীর সুরক্ষার জন্য তাদের এই বিচ্ছিন্নতায় বেঁচে থাকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈচিত্র্য সুরক্ষার জন্যও তা বিশেষভাবে গুরুত্ববহ। প্রাথমিক যোগাযোগে থাকা আদিবাসীরা বনের সেরা রক্ষক। যেখানে ভূমি এবং অঞ্চলগুলির উপর আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে, সেখানে বনগুলোও আদিবাসী সমাজের পাশাপাশি সমৃদ্ধ হয়।

বিজ্ঞাপন

এ বছরের আদিবাসী দিবসে গুরুত্ব পায়, আদিবাসীদের সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় চিন্তা করতে হবে তারা কখন কীভাবে তাদের অধিকার সমুন্নত রেখে বাইরের উন্নয়নকর্মের সাথে যুক্ত হতে চান। মনে রাখা উচিত, কোন ধরণের জোরপূর্বক যোগাযোগ তাদের সাথে করা যাবে না। তাদের সম্মতি ছাড়া অথবা বিনামূল্যে বা জোরপূর্বক পাহাড়ের জমি দখল ও সম্পদ বা খনিজ উত্তোলন, লগিং এবং তাদেরকে অন্যান্য যে কোন ধরনের শোষণ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে তা রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়গুলোকে ধ্বংস করতে পারে এমন প্যাথোজেনগুলোর বিস্তার রোধে কঠোর রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। যে কোন প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের পূর্ণ সম্মতি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সুবিধা-বণ্টনসমূহ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থাপন করতে হবে। স্বেচ্ছায় দূরে থাকা বা অতি দূর্গম এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সাথে মিথষ্ক্রিয়ার জন্য সেইসব বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারীদের বেছে নিতে হবে যারা আগে থেকেই তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন এবং এই সম্প্রদায়ের ভাষা ও রীতিনীতি বোঝেন। এভাবে তাদের পছন্দকে সম্মান করে ধীরে ধীরে এবং নিয়ন্ত্রিত যোগাযোগ করা যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রদায়গুলোকে তাদের জমি এবং সম্পদের ব্যবস্থাপনা এবং সুরক্ষায় সক্রিয় অংশীদার হতে ক্ষমতায়িত করতে হবে। সংবিধানে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জ্ঞান বিনিময়ের উদ্দেশ্যে সম্প্রদায়গুলোকে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, শাসন কাঠামো এবং ঐতিহ্যগত জ্ঞান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সেদেশের সরকার সহায়তা প্রদান করতে পারে।

বিচ্ছিন্ন থাকা সম্প্রদায়গুলো এবং অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে তথ্য বিনিময় এবং সেগুলোর সর্বোত্তম অনুশীলনের সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করাও সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। এছাড়াও সম্প্রদায়গুলোর অধিকার লঙ্ঘন নির্দিষ্ট করার জন্য স্পষ্ট আইনি এবং নীতি কাঠামো স্থাপন করতে হবে। জবাবদিহিতা, প্রতিকার এবং ন্যায়বিচারের জন্য সম্প্রদায়গুলোর জন্য প্রবেশযোগ্য এবং সাংস্কৃতিকভাবে-উপযুক্ত উপায় প্রদান করতে হবে। এই অনুশীলনগুলো মেনে চলার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী, সহযোগিতামূলক এবং অধিকার-ভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োজন, যা স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর এবং স্ব-নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করবে।

বড়থলি ইউনিয়নের অতিদূর্গম গ্রাম পুকুর পাড়ার জীবন

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অতি দূর্গম এলাকায় অথবা সমতলের বিচ্ছিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলো যারা সেই বিশেষ অঞ্চলের দীর্ঘযুগের বাসিন্দা তাদের সাথে যোগাযোগের প্রক্রিয়াসমূহ কী এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়াতেইবা তাদেরকে কীভাবে সংযোজন করা সম্ভব? এই পরিপ্রেক্ষিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের এক গ্রামের গল্প বলা যাক।

বাংলাদেশের সমতলে বাস করা অনেক মানুষের কাছে এ হয়ত নিছক কল্পনাই বলা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেশের পার্বত্য অঞ্চলে এমন কিছু জনপদ রয়েছে, যাদের জীবন মোটেই ফ্রেমে বাধাঁনো ছবির মতো অপার্থিব নয়। রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের অতিদূর্গম অঞ্চলের গ্রাম ‘পুকুর পাড়া’-কে নিয়ে এমন মন্তব্য মোটেই অমূলক হবে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঢাকা থেকে রাঙামাটির দূরত্ব ৩০৬ কিলোমিটার। জেলা সদর থেকে বিলাইছড়ি উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। কিন্তু বিলাইছড়ি থেকে রাইক্ষ্যং নদ হয়ে হাঁটা পথে পুকুর পাড়া গ্রামে যেতে অন্ততঃ ৭ দিনের দূরত্ব।

বিলাইছড়ি উপজেলার চারটি ইউনিয়নের একটি হলো বড়থলি ইউনিয়ন, যার জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এই ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য গ্রামগুলো হলো-শিলছড়ি, রাইমনছড়া, ছালিয়াছড়া, বিলপাড়া, বুরিক্কিয়াছড়া, সাইজাম পাড়া, টাইগার পাড়া , কাইংগছড়া, সাদারীছড়া, সালছড়া, বড়থলি মারমা পাড়া, বড়থলি ত্রিপুরা পাড়া, পুকুর পাড়া, প্রংজাং পাড়া, সুড়হা পাড়া, চারজিং পাড়া, শেপ্রু পাড়া ধুপানিছড়া, হাতিছড়া, এসম ম্রা পাড়া, কেসপাড়া, জারুলছড়ি পাড়া প্রভৃতি। পুকুরপাড়া এলাকাটির ভূ-প্রকৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং বিচিত্রতায় পূর্ণ।

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশস্ত জলপ্রপাত রাইংক্ষ্যং

প্রশাসনিকভাবে পুকুরপাড়া বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের অন্তর্গত হলেও, অবস্থানগত কারণে পুকুরপাড়ার জনগোষ্ঠী বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার উপর নির্ভরশীল। ২০১৫ সালের আগে এই ইউনিয়নটি বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রশাসনিক সুবিধার্থে নতুন ইউনিয়ন বড়থলির সৃষ্টি হয়। বড়থলি ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে ত্রিপুরা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম ও খিয়াং জনগোষ্ঠীর প্রায় পাঁচহাজার জন মানুষের বসবাস। এই ইউনিয়নের ‘ধুপানিছড়া পাড়া’ নামক স্থানেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ত্রিদেশীয় সীমানা খুঁটির (বাংলাদেশ ভারত এবং মায়ানমারের) অবস্থান।

গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যের সম্ভাবনাময় অঞ্চল হওয়া স্বত্ত্বেও এই অঞ্চলটিই দেশের সবচেয়ে দূর্গম এবং অবহেলিত। তাছাড়া পর্যটনের জন্য এটা অপার সম্ভাবনার স্থান। ৩,৩১৪ ফুট উচ্চতার দেশের দ্বিতীয় উচ্চতম পাহাড় ডুমলংও এখানে অবস্থিত। ডুমলং রেং তলাং পর্বতশ্রেণির একটি পাহাড় এবং রাইক্ষ্যং হ্রদের পার্শ্ববর্তী প্রংজাং পাড়ার কাছে এর অবস্থান। একে বেসরকারিভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলে দাবি করা হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং গভীর প্রাকৃতিক হ্রদ রাইক্ষ্যং (সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১১৭০ ফুঁট উঁচুতে) এই ইউনিয়নের পুকুর পাড়া এবং প্রংজাং পাড়ার ভেতর অবস্থিত।

রাইক্ষ্যং হ্রদের পাড়ে পুকুরপাড়ায় বহু বছর ধরে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই হ্রদের পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ বলে সূর্যের আলো, মেঘ, পাহাড়ের রং, আকাশের রঙেই এর রূপ পরিবর্তিত হয়। এই লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকে বিমোহিত করে। লেকের চারপাশে রেং তলাং রেঞ্জের পাহাড়গুলো। এছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশস্ত জলপ্রপাত রাইংক্ষ্যং এবং চ্যাদলাং। (চলবে...)