শুভ জন্মদিন, ল্যান্স ক্লুজনার

, ফিচার

সাফাত জামিল, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-28 02:31:49

ক্রিকেট ইতিহাসে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়া বাঘা বাঘা অলরাউন্ডারদের তালিকায় ল্যান্স ক্লুজনারকে চট করে খুঁজে পাওয়াটা একটু কঠিনই হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় নিজ শহর ডারবানে জন্ম নেওয়া সমসাময়িক আরেক গ্রেট শন পোলক যেখানে তাঁর থেকে এগিয়ে থাকবেন বহু ধাপ। তবু সবার ভিড়ে লড়াকু এক জাত অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা ক্লুজনার সবসময় ছিলেন মারকুটে উদ্ভাবনীমূলক ব্যাটিংয়ের এক দর্শনীয় বিজ্ঞাপন হয়ে।

১৯৭১ সালের আজকের দিনে নাটাল প্রদেশে জন্ম নেওয়া এই দক্ষিণ আফ্রিকান জুলু ভাষায় দারুণ পারদর্শিতার জন্য পান ‘জুলু’ ডাকনাম। একদিনের ক্রিকেটে ৪১ ব্যাটিং গড় ও ২৯ বোলিং গড় নিয়ে সর্বকালের প্রতিষ্ঠিত প্রোটিয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম অবস্থানে আছেন তিনি। ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেটেও বিস্তার করেছিলেন সমান আধিপত্য—৪৩ ব্যাটিং গড় ও ৩০ বোলিং গড়ের পরিসংখ্যান সে কথাই বলে।

নাটাল প্রদেশের প্রতিনিধিত্বকারী ঘরোয়া দল নাশুয়া ডলফিনসের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্যারিয়ার শুরু করেন ক্লুজনার। এই ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের হয়ে ১৯৯১ থেকে টানা ২০০৪ পর্যন্ত খেলেছেন ক্লুজনার। পোলক আর ডোনাল্ডের দুর্ধর্ষ বোলিং লাইনআপে অভিষিক্ত হন ১৯৯৬ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার ভারত সফরের দ্বিতীয় টেস্টে। কলকাতার সে ম্যাচের প্রথম ইনিংসে মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের ব্যাটে বেধড়ক মার খান বোলার ক্লুজনার। ভারতের হয়ে টেস্টে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ার পথে জুলুর টানা পাঁচ বলে বাউন্ডারি হাঁকান আজহারউদ্দিন। তবে মিডিয়াম পেসের ক্লুজনার নিজের জাত চেনান দ্বিতীয় ইনিংসেই। ৬৪ রান দিয়ে একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে অভিষেক টেস্টে সেবার একাই ভারতের আট-আটটি উইকেট তুলে নেন ল্যান্স ক্লুজনার। বলা বাহুল্য, এই ৮-৬৪ ছিল তাঁর ক্যারিয়ার-সেরা বোলিং ফিগার।

আরো পড়ুন ➥ শুভ জন্মদিন, মিস্টার ফিফটি

সে বছরের ১৯ জানুয়ারি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন ক্লুজনার। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সাদামাটা সেই অভিষেকে উইকেটশূন্য থাকেন বোলার ক্লুজনার, ব্যাট হাতে ৪ ওভার খেলে রানের খাতা খোলার আগেই ফেরেন ড্রেসিংরুমে।

অভিষেক টেস্টেই ৮ উইকেট পান জুলু


অমন শুরুর পরও একদিনের ক্রিকেটেই সব স্মরণীয় পারফর্মেন্সের জন্য তাঁকে মনে রেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। ওডিআই ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ১৯৯৮ সালে গোড়ালির চোটে ছিটকে পড়েন ইংল্যান্ড সফর থেকে। আহত বাঘের মতো ফুঁসতে থাকা ক্লুজনার দেশে ফিরে দ্রুতগতির পেস বোলিং ছেড়ে কাজ শুরু করেন নিজের ব্যাটিং টেকনিক নিয়ে। মূলত ডেথ ওভারের বোলিং মোকাবেলায় পারদর্শী হতে ক্লুজনার নেটে বোলিং মেশিন তাক করতেন ইয়র্কার স্পটে, আর সামনের দিকে দৈনিক সজোরে পেটাতেন ৫০০ থেকে ৬০০ বল। অমন একমুখী মানসিকতার ট্রেনিংয়ের ইতিহাস নেই আর কোনো ব্যাটসম্যানের। এছাড়াও রেঞ্জ হিটিং অর্থাৎ মাঝমাঠ বরাবর ছক্কা পেটানোর চর্চা প্রথম শুরু করেন ক্লুজনারই।

অমন সাধনার ফল ক্লুজনার পেয়েছেন গোটা ক্যারিয়ারজুড়েই। তবে তাঁর সেরাটা নিঃসন্দেহে টের পাওয়া গেছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ আসরে। প্রায় দেড় কেজি ওজনের ব্যাটকে তরবারীর সমান উচ্চতায় নিয়ে চালানো বাঁহাতি লোয়ার-অর্ডার ব্যাটসম্যান ও ক্রিজের বেশ বাইরে থেকে বল ছোঁড়া ডানহাতি মিডিয়াম-ফাস্ট ল্যান্স ক্লুজনার পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। ৯ ম্যাচে ৪ বার ম্যাচসেরার পুরস্কার পান, যার মধ্যে ৩টি এসেছিল টানা তিন ম্যাচে!

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে টেন্ডুলকার, দ্রাবিড় ও আজহারউদ্দিনের গুরুত্বপূর্ণ উইকেটগুলো নিয়ে বরাদ্দ ১০ ওভার শেষ করেন ক্লুজনার। আর ম্যাচের শেষ দিকে ৪ বলে ৩ বাউন্ডারিতে নিশ্চিত করেন দলের জয়। পরের ম্যাচে ক্লুজনারের ব্যাটের ধার আরো ভালোভাবে টের পায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন শ্রীলংকা। ১১৫ রানে সাত উইকেট হারিয়ে বসা সাউথ আফ্রিকা ক্লুজনারের আগমনের পর হারায় আরো একটি উইকেট। লঙ্কান গতি আর বাউন্সে দিশেহারা ব্যাটিং লাইনআপ প্রাণ ফিরে পায় ক্লুজনারের ভারী উইলোতে। দুই টেলএন্ডারকে নিয়ে স্কোরবোর্ডে যোগ করেন ৭৭ রান, যেখানে মাত্র ৪৫ বলে তাঁর অবদান ৫৫। অপরাজিত সেই ইনিংসে ৫টি চারের পাশাপাশি দুবার বল আছড়ে ফেলেন মাঠের বাইরে। বল হাতে যথারীতি ৩ উইকেট—এবার মাত্র ২১ রান খরচে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে তরুণ ল্যান্স ক্লুজনার


স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচেও দেখা মেলে ‘ক্লুজনার-শো’র। আরো একবার ম্যাচসেরা হবার পথে অপরাজিত ৪৮ রানের পাশাপাশি মাত্র ১৬ রান খরচে পান একটি উইকেট। হ্যাটট্রিক ম্যাচসেরার পুরস্কার লাভ করা ক্লুজনার কেনিয়ার বিরুদ্ধে দেখা পান পাঁচ উইকেটের। দুর্দান্ত ফর্মে এগোতে থাকা প্রোটিয়ারা অপ্রত্যাশিত হোঁচট খায় জিম্বাবুয়ের কাছে। ৯ নম্বরে না নেমে আরেকটু উপরে থেকে শুরু করলে রান তাড়ায় সে যাত্রায় হয়তো সফলই হতেন ক্লুজনার। সুপার সিক্স ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আবারও কোণঠাসা দক্ষিণ আফ্রিকার হাল ধরেন আটে নম্বরে নামা ক্লুজনার, জ্যাক ক্যালিসের বিদায়ের আগে স্কোরবোর্ডে যোগ করেন ৪১। ওয়াসিম আকরাম, শোয়েব আখতারদের মতো স্পিডস্টারদের মোকাবেলা করে জেতার সমীকরণ দাঁড়ায় শেষ পাঁচ ওভারে ৪৪।

ল্যান্স ক্লুজনারের লাগল মোটে ২৪ বল। সব মিলিয়ে ৪১ বলে অপরাজিত ৪৬ করে মাঠ ছাড়েন আরো একবার ম্যাচসেরার পুরস্কার পাওয়া তরুণ জুলু। অধিনায়ক হ্যানসি ক্রনিয়ের বাহবাও পান ম্যাচশেষে—“আমরা নিজেদের যত বেশি বিপদের মধ্যে ফেলি, সে যেন তত বেশি প্রস্তুত থাকে দলকে উদ্ধার করে ম্যাচ জেতাতে।”

ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ল্যান্স ক্লুজনার


মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখেন নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। তিন নম্বরে নামা ক্লুজনার মাত্র ৪ রানে আউট হন। আগের ১০ ওডিআইতে মোট ৪০০ রান করে অপরাজিত থেকে প্রথমবারের মতো আউট হওয়া ক্লুজনার অবশ্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নিয়ে জয়ের ধারায় রাখেন দলকে। সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রোটিয়ারা হোঁচট খেলেও ব্যাটে-বলে কম চেষ্টা করেননি ল্যান্স।

দুই দল আবারও মুখোমুখি হয় সেমিফাইনালে। অস্ট্রেলিয়ার ২১৩ রানের জবাবে ১৭৫ তুলতেই ৬ উইকেট হারিয়ে বসে দক্ষিণ আফ্রিকা। শন পোলক আউট হবার আগে ক্লুজনারের সাথে যোগ করেন আট রান। শেষ ৪ ওভারে চাই ৩০—এমন সমীকরণে এগোতে থাকা ক্লুজনারের দল হারায় আরো দুই উইকেট। ৮ বলে ১৬—এসময় ম্যাকগ্রার দুই বলে সাত তুলে নেন ল্যান্স। শেষ ওভারের প্রথম ২ বলে দুই বাউন্ডারিতে স্কোর লেভেল করা ক্লুজনারের সাথে ভুল বোঝাবুঝিতে চতুর্থ বলে রান আউট অ্যালান ডোনাল্ড। ফাইনালের স্বপ্নভঙ্গে বিহ্বল ক্লুজনার অনবদ্য প্রদর্শনীর পুরস্কার হিসেবে জিতে নেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফি।

সেমিফাইনালের সেই রান-আউট আর অস্ট্রেলিয়ার উদযাপন


ঘনঘন পাওয়া ইনজুরি বোলিংয়ে গতি কমাতে বাধ্য করে ২০০০ উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার ক্লুজনারকে। তাই ব্যাটসম্যানদের ধন্দে ফেলতে তিনি রপ্ত করেন অন্যান্য টেকনিক, যার মধ্যে অন্যতম ছিল অফ-কাটার। ২০০০-০১ সালের উইন্ডিজ আর ২০০১-০২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় থেকেই ফর্মে ভাটা পড়তে থাকে তাঁর। কিছু সময়ের জন্য দলে জায়গা হারানো ক্লুজনার ফিরে আসেন ২০০৩ বিশ্বকাপ দলে। নিজের প্রিয় টুর্নামেন্টে অতীতের সুখস্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও খুব একটা সফলতা পাননি। ফলশ্রুতিতে জায়গা হারান পরবর্তী ইংল্যান্ড সফরের দলে। ২০০৩-০৪ সালে তাঁর প্রত্যাবর্তনও খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন মেনে নিয়ে ইনজুরির কাছে হার মানা ক্লুজনার অবসরের ঘোষণা দেন ২০০৪ সালে।

আরো পড়ুন শিবনারায়ণ চন্দরপল : আনসাং হিরো

বেসবল-স্টাইল ব্যাকলিফট আর অতিমানবীয় পাওয়ার হিটিংয়ে ২২০ টেস্ট-ওয়ানডে মিলিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার রানের মালিক ক্লুজনারের উদ্ভাবনী ব্যাটিং প্রতিভা নিয়ে সংশয় ছিল না কখনোই। ইনজুরির ধকল কাটিয়ে ফিরতে পারলে গতির নৈপুণ্যে বল হাতেও নিঃসন্দেহে গড়তেন অসংখ্য রেকর্ড। খেলোয়াড়ি জীবনে মিডিয়ার মুখোমুখি হতে খুব একটা পছন্দ করতেন না, তবে নীরবতা ভাঙলে নিজের মতামতে রাখতেন বিচক্ষণতার ভাব।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে ২০০৪ সালে বিদায় জানান এই গ্রেট


নর্দাম্পটনশায়ারে বেশ কিছুদিন খেলা এই অলরাউন্ডার পরবর্তী সময়ে হাই-প্রোফাইল সাইনিং হিসেবে ২০০৭ মৌসুমে নাম লেখান ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে। কলকাতা টাইগার্সের হয়ে দারুণ সাফল্য পাওয়া এই প্রোটিয়া গ্রেট ২০০৯ সালে কোচিংয়ের সাথে যুক্ত হতে মনস্থির করেন। সাউথ আফ্রিকান বোর্ডের তত্ত্বাবধানে লেভেল-থ্রি কোর্স সম্পন্ন করলে বিসিবি তাঁকে বাংলাদেশ দলের বোলিং কোচ হিসেবে যুক্ত হবার আহ্বান জানায়। তবে স্ত্রীসহ বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস সম্ভব হবে না জানিয়ে তাতে সাড়া দেননি ক্লুজনার। ২০১২-১৬ মৌসুম পর্যন্ত ঘরোয়া দল ডলফিনসের কোচের দায়িত্ব পালন করা ক্লুজনার পরে জিম্বাবুয়ে দলের বোলিং কোচ হিসেবে যোগ দেন। ইউরো টি-টুয়েন্টি স্ল্যাম টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী আসরে গ্লাসগো জায়ান্টসের হেড কোচ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার, পরবর্তীতে গোটা টুর্নামেন্টই বাতিল হয়। তবে এ মাসেই শুরু হতে যাওয়া ভারত সিরিজের দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টুয়েন্টি দলের সহকারী ব্যাটিং কোচ হিসেবে ক্লুজনারের নাম ঘোষণা করেছে বোর্ড।

৪৮-এ পা রাখতে যাওয়া এই ফিনিশারের প্রতি রইল জন্মদিনের অসংখ্য শুভেচ্ছা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর