শিবনারায়ণ চন্দরপল : আনসাং হিরো



সাফাত জামিল, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
চন্দরপলের ট্রেডমার্ক স্ট্যান্স

চন্দরপলের ট্রেডমার্ক স্ট্যান্স

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। জর্জটাউনে মার্চের এক সকালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি তৎকালীন বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওপেনিংয়ে ১১৩তম টেস্ট খেলতে নামা ডেসমন্ড হেইন্সের সাথে রয়েছেন ৭৩ টেস্ট খেলে ফেলা রিচি রিচার্ডসন। ওপেনিং বোলার—কার্টলি অ্যামব্রোস আর কোর্টনি ওয়ালশ। মিডল অর্ডারে মাত্র ২০ টেস্ট খেলে সত্তরোর্ধ্ব ব্যাটিং গড়ের জিমি অ্যাডামসের সাথে আছেন কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা—গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড টেস্ট স্কোর যার হাতছোঁয়া দূরত্বে।

এত এত ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট গডের মাঝে আর আছেন অভিষেক ম্যাচে নামা ১৯ বছর বয়সী শিবনারায়ণ চন্দরপল—লিকলিকে গড়নের মধ্যে বেশ বেমানান যার জার্সি ও প্যাড। দলে তাঁর অন্তর্ভুক্তি ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতানো কোচ ফিল সিমন্সের বদলি হিসেবে। কারো কারো মতে, গায়ানিজদের সন্তুষ্ট করতেই নাকি নেওয়া হয়েছিল অমন ‘রাজনৈতিক’ সিদ্ধান্ত।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/20/1566284611732.jpg
অভিষেক টেস্টেই চন্দরপল পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি


মজার ব্যাপার হলো, ব্যাটিং স্কিলের চেয়ে তাঁর লেগ-ব্রেক বোলিংই প্রাধান্য পেয়েছিল নির্বাচকদের কাছে। প্রথম ইনিংসে ১৬ ওভার বল করে উইকেটশূন্য চন্দরপল পরবর্তীতে ছয় নম্বরে নেমে অ্যালান ইগলসডেনের বলে পয়েন্টের পেছনে দুর্দান্ত এক কাটে হাঁকান প্রথম বাউন্ডারি। সেদিন ইংল্যান্ডের শক্ত বোলিং অ্যাটাক দুমড়ে-মুচড়ে তরুণ চন্দরপল তুলে নেন নিজের ৬৬ টেস্ট ফিফটির প্রথমটি।

টেন্ডুলকার ও জয়সুরিয়ার পর তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুই দশকেরও বেশি সময় কাটিয়ে অবসরের পথে পা দেওয়া চন্দরপল গড়ে গেছেন রেকর্ডের পর রেকর্ড। ইন্দো-ক্যারিবিয়ান হিসেবে ১০০ টেস্ট খেলা একমাত্র উইন্ডিজ ক্রিকেটার শিবনারায়ণ এই ফরম্যাটে করেছেন এগারো হাজারেরও বেশি রান, সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারীর তালিকায় রয়েছেন আট নম্বরে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/20/1566284663316.jpg
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২০ হাজারেরও বেশি রানের মালিক শিবনারায়ণ


ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় ব্রায়ান লারার ছায়ায় কাটানো চন্দরপল নিজের ১৯তম টেস্টে ভারতের বিপক্ষে দেখা পান প্রথম সেঞ্চুরির। এর ঠিক এক মাস পর সেই ভারতের বিপক্ষেই পেয়ে যান প্রতীক্ষিত ওয়ানডে সেঞ্চুরিটিও।

ধীরগতির ব্যাটিংই ছিল তাঁর মূল স্টাইল। তাই টেস্টের চতুর্থ দ্রুততম সেঞ্চুরির মালিক যে চন্দরপল, তা জেনে যে কেউই অবাক হবেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬৭ বলের সেই বিস্ফোরক ইনিংসের পরপরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৪১৮ রানের রেকর্ড চেজে করেছিলেন ১০৪। ২০০৫ সালে সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে মাত্র দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অধিনায়কত্বের অভিষেকে পান ডবল সেঞ্চুরির স্বাদ। যদিও সেনাপতির গুরুভার ঠিকঠাক বহন করতে না পেরে পরের বছরই ইস্তফা দেন শিবনারায়ণ। তাতে ফলও মিলল হাতেনাতে—ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অপরাজিত দুই সেঞ্চুরিতে স্বরূপে ফেরেন এই বাঁহাতি গ্রেট।

জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় টেস্ট ক্রিকেট খেলেই কাটিয়ে দেওয়া চন্দরপল নিজের জাত চিনিয়েছেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও। তাঁর অনবদ্য পারফরমেন্সে ভর করে ২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতে উইন্ডিজ দল। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হয়েও এ টুর্নামেন্টের ২০০৬ সালের আসরে ওপেনিংয়ে নামেন চন্দরপল, দলকে টেনে নেন ফাইনাল পর্যন্ত।

তবে ক্রিকেটের আদি সংস্করণের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যানকে দুহাত ভরে সাফল্য এনে দিয়েছে ২০০৮ সাল। সেবার ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩ টেস্টে চন্দরপল তোলেন ৪৪২ রান, অর্জন করেন উইজডেন বর্ষসেরা এবং আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটারের মুকুট।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই উইন্ডিজ ক্রিকেটের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি চন্দরপলকে পরিণত করেছে হাল না ছাড়া এক নাবিকে। একই কথা প্রযোজ্য ব্রায়ান লারার ক্ষেত্রেও, তবে একক আধিপত্য সবসময়ই তাঁকে রেখেছে অন্যদের থেকে এক ধাপ উপরে। কিন্তু শিব তাঁর প্রতিভা দিয়ে অন্যান্যদের গড়ে তুলেছেন প্রায় পুরোটা সময়। লারা অবসরে যান ২০০৬ সালে, ওয়ালশ ২০০১, অ্যামব্রোস ২০০০, রিচার্ডসন ১৯৯৫ আর হেইন্স ১৯৯৪ সালে। অন্যদিকে চন্দরপল তাঁর অভিষেকের পর থেকে খেলেছেন প্রায় ১০০ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানের সাথে। এমনকি তাঁদের মধ্য থেকে সেরাদের সেরা ক্রিস গেইল, রামনারেশ সারওয়ানরা এসে চলেও গেছেন। অন্যদেরও সঙ্গ পেয়েছেন খুব কম সময়ের জন্য, যাদের মধ্যে ৪২ জন খেলেছেন মাত্র পাঁচ বা তার চেয়েও কম টেস্ট।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/20/1566284728477.jpg
২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের উচ্ছ্বাস


চন্দরপল নিজেকে রীতিমতো এক সৈনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। হার মেনে নেওয়ার ব্যাপারটি ছিল তার ডিকশনারির বাইরে। বলা বাহুল্য, ইতিহাসের অন্য যে কোনো ব্যাটসম্যানের থেকে সবচেয়ে বেশিবার অপরাজিত থাকার রেকর্ডটা তাঁরই দখলে। অনেকের মতে, তাঁর ঘুমপাড়ানি ব্যাটিং বড়ই নিস্প্রভ, নিস্তেজ। কেউ কেউ তাঁকে স্বার্থপর ভাবতেও দ্বিধা করেন না। তবে চন্দরপল ক্যারিয়ারজুড়ে করে গেছেন তাঁর কাজটিই। দিগভ্রান্ত ব্যাটিংয়ের দিনে ক্রিজে তাঁর উপস্থিতি সবসময় ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বশেষ ভরসা আর ম্যাচ বাঁচানোর সর্বশ্রেষ্ঠ সুযোগ। হেরে যাওয়া ম্যাচে তাঁর থেকে বেশি রান নেই অন্য আর কোনো ব্যাটসম্যানের।

খেলোয়াড়দের কারো শরীরজুড়ে থাকে ট্যাটুর পসরা, কান ফুটিয়ে দুলও পরেন কেউ কেউ। আর শিবের ক্যারিয়ারজুড়ে আলোচনায় ছিল তার দুই চোখের নিচের কালো দাগ। হোক পুরো কালো বর্ণ অথবা নিজ দেশের পতাকা—শুরু থেকেই প্রতিটি ম্যাচে তাঁকে দেখা গেছে এই রূপেই। বিশেষ কোনো স্টাইল নয়, বরং রোদের প্রতিফলন থেকে বাঁচতেই এমন ‘প্যাচ’ ব্যবহার করতেন চন্দরপল। তবে এই প্যাচ ঠিক কতটুকু কার্যকরী, সেটির সপক্ষে এখনো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/20/1566284781042.jpg
রোদের প্রতিফলন থেকে বাঁচতে চোখের নিচে ‘প্যাচ’ ব্যবহার করতেন চন্দরপল


দৃষ্টিনন্দন শটের আহামরি কোনো প্রদর্শনী তেমন দেখা যায়নি তাঁর সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারে। উল্টো দর্শনীয় ছিল ক্রিজে তাঁর বিচিত্র এক কাঁকড়ারূপী ব্যাটিং স্ট্যান্স, যা নিকট অতীতে দেখা যায়নি অন্য কোনো ব্যাটসম্যানের মধ্যে। চন্দরপলের ভাষ্যমতে, বোলারের মুখোমুখি প্রায় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দাঁড়িয়ে তিনি পেতেন দুই চোখের পূর্ণ দর্শন, সাথে দারুণ ভারসাম্য। বন্ধু আর প্রতিবেশিদের বোলিং মোকাবেলায় গায়ানার ছোট্ট গ্রামে কৈশোরেই শিবনারায়ণ আয়ত্ত করেন এই টেকনিক।

তা ঠিক কতটা কার্যকরী ছিল এই স্ট্যান্স? শুরুর দিকে ব্রেট লি’র মতো ফাস্ট বোলাররা ধন্দে পড়ে যেতেন যে ব্যাটসম্যান চন্দরপল আদৌ বল মোকাবেলায় প্রস্তুত ছিলেন কিনা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে শিব দেখিয়ে দিয়েছেন যে প্রথাগত মডেল বা ধরন অনুসরণ না করেও কিভাবে সর্বোচ্চ স্তরের সফলতা অর্জন করা সম্ভব। কখনো মারমুখী, কখনো কচ্ছপগতি—ক্যারিয়ারের প্রারম্ভে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে ব্যাটিং স্টাইলের ভিন্নতা তাঁকে সবসময়ই আলাদা রেখেছে অন্যদের থেকে। তিন-তিনবার ১০০০ মিনিটেরও বেশি সময় অপরাজিত থাকার এবং সবচেয়ে বেশি ১৭টি অপরাজিত টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড তো আর এমনি এমনি গড়েননি!

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/20/1566284840669.jpg
চন্দরপলের ট্রেডমার্ক স্ট্যান্স


উইন্ডিজ ক্রিকেটের ধৈর্যের প্রতিমূর্তি শিবনারায়ণ চন্দরপলের ত্রিশ টেস্ট সেঞ্চুরির শেষটি আসে বাংলাদেশের বিপক্ষে, ২০১৪ সালে। তার ঠিক দুই বছর পরই ৪১ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান আগেই উইন্ডিজ বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়া চন্দরপল।

৭৭ ফার্স্ট-ক্লাস সেঞ্চুরির মালিক চন্দরপল পরবর্তীতে তিন মৌসুম সফলতার সাথে কলপ্যাক চুক্তিতে খেলেছেন ইংলিশ কাউন্টি ক্লাব ল্যাঙ্কাশায়ারে। আর নিজ শহর গায়ানার হয়ে ছেলে ত্যাগনারায়ণ চন্দরপলের সঙ্গে এখনো খেলে যাচ্ছেন ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেট। বল-ব্যাটের লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক আঙিনায় বিশ বছরেরও বেশি সময় কাটানো শিবের ধার যে এতটুকুও কমেনি, তার প্রমাণ আরো একবার পাওয়া গেছে চলতি বছরের এপ্রিলেই। সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে ২০০ রানের দলীয় স্কোরই যেখানে বিশাল ব্যাপার, সেখানে ২৫টি চার আর ১৩ ছক্কায় আইসিসির স্বীকৃতিহীন ঘরোয়া এক টি-টুয়েন্টি লীগে চন্দরপল একাই খেলেছেন ২১০ রানের বিস্ফোরক ইনিংস!

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/20/1566284885858.jpg
ছেলে ত্যাগনারায়ণের সাথে শিব


চটকদার চার-ছক্কার পসরা যদি হয়ে থাকে উইন্ডিজ ক্রিকেট সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, তবে শিবনারায়ণ চন্দরপল সেখানে এমন এক যুগের ধারক ও বাহক—সংকটের সময় যেখানে দলীয় মনোবলে নিহিত ছিল সফলতা। এমন একজন ব্যাটসম্যানের গুণগান গাওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট শব্দমালা খুঁজতে তাই হিমশিম খেতে হয় ক্রিকেটবোদ্ধাদের। ক্যারিয়ারের সোনালি সময়ে শিবনারায়ণ যদি পেতেন চলমান বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মতো কোনো আসর, নিজের শৈল্পিক তুলিতে নিশ্চিতভাবেই রাঙাতেন দলীয় অর্জনের পাল্লা। কেননা ব্যক্তিগত রেকর্ড বা স্বতন্ত্র উজ্জ্বলতা নয়, বরং গোটা ক্যারিয়ারে দলীয় সাফল্যকেই সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন কদিন আগেই ৪৫-এ পা রাখা এই ব্যাটিং জিনিয়াস।

অভিবাদন, হে আনসাং হিরো!

   

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



অভিজিত রায় কৌশিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

আধুনিকতার ছোঁয়ায় কমেছে শ্রমিকের কদর, কমেছে আয়/ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও কৃষি কাজে ও কলকারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রযুক্তি ছোঁয়া বিভিন্ন সেক্টরে আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। তবে পরিবর্তন হয়নি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানে। বরং কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে কমছে তাদের কাজের সংকুলান। কমেছে আয়-রোজগারও।

রাজধানীর গাবতলী ও আমিনবাজার সংলগ্ন তুরাগ নদী। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বালি ও কয়লা ভিত্তিক ব্যবসা। এক সময়ের জনপ্রিয় ও বহু লোকের কর্মসংস্থানের এই ব্যবসাতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। বালু লোডিং-আনলোডিং-এ যান্ত্রিকীকরণের কারণে কাজ হারিয়েছেন শ্রমিক। ফলে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের কদর; প্রসার ঘটেছে উন্নত যন্ত্রাংশের।

কুমিল্লার বাসিন্দা মো. হান্নান। দীর্ঘদিন ধরে গাবতলীতে বালু ও কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। হান্নান জানালেন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তার উপার্জনের প্রভাব ফেলেছে।

যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় বেড়েছে শ্রমিকের কদ/ছবি: নূর এ আলম


এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার বছর এখানে এই কাজ করি। আগে ভালই ইনকাম হতো। এখন আর সেরকম ইনকাম হয় না। আগে এতো মেশিন ছিলো না সব কাজ আমরা করতাম। আর এখন সব মেশিনে করা হয়। শুধু যেগুলো মেশিন দিয়ে করা যায় না সেগুলো আমরা করি।’

তিনি আরও যোগ করেন, তাছাড়া আগে শ্রমিক কম ছিল। তখন মেশিনও ছিলো না। শ্রমিকদের চাহিদা ছিলো। কিন্তু এখন শ্রমিক বেশি, মেশিনও এসেছে। এক মেশিনে অনেক কাজ হয়; তাই চাহিদা কম। ইনকামও কম।

‘আগে দৈনিক দিন ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা ইনকাম করতে পারতাম। আর এখন সারাদিন কষ্ট করে কোন দিন ৫০০ কোন দিন ৬০০ টাকা ইনকাম করি। আবার কোন কোনদিন এর থেকে কমও ইনকাম হয়।’- বলেন এই শ্রমিক।

পাবনার বেড়ার কামরুজ্জামান ২০০৮ সালে ঢাকায় আসেন। টানা ১৬ বছর ধরে গাবতলী বালু ও কয়লার ঘাটে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

কঠোর পরিশ্রমের পর দিনশেষে যে মজুরি পান তা দিয়ে কোন রকমে চলে তাদের সংসার/ছবি: নূর এ আলম

‘এক একটা টালি মেরে ২ টাকা ৪ আনা হিসেবে টাকা পাই। এখন যন্ত্র আসাতে লেবারের কোন কাজ কাম নেই। সব মাল এখন মেশিনে ওঠায়। এজন্য লেবারের কাজ কমে গেছে। টালির এখন আর রেট নেই। কাজ না করেও উপায় নেই কি করবো? ঢাকা শহরে আছি কাম না করলে চলবো ক্যামনে।’- বলেন কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, এখন দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা ইনকাম করতে পারি। আগে ভালোই ইনকাম হতো। কিন্তু এখন ৫০০ টাকা ইনকাম করতেই কষ্ট হয়ে যায়। হবে না আগে যেখানে একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ফেলে।’

মেহনতি এই মানুষটার কাছে শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমাদের সব দিবসই সমান। কাম করলে টাকা, না করলে কোন টাকা নাই। এই জন্য আমাগো কোন ছুটির দিনও নেই। কাম করাই লাগে। এমনও মানুষ আছে ঘুম থেকে উঠে ভোরে কামে আসে। কাম না করলে সংসারই চলে না।

মূল্যস্ফীতি এখন লাগামহীন অবস্থায় আছে বলে মনে করে দেশের অন্যতম বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে শ্রমিকরা/ছবি: নূর এ আলম


তীব্র রোদ ও গরমে মাথায় করে বালু টানছে নাজমা বেগম। তার ও স্বামীর উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে নাজমার।

এই নারী শ্রমিক বলেন, ‘এই গরমে কাজ করা যায় না। সারাদিন কাজ করলেও খুব বেশি ইনকাম হয় না। জিনিসের যা দাম বেড়েছে তাতে। এই ইনকামের টাকায় পরিবার চালানো অনেক কষ্টের। তাই আপনাগো ভাই সারাদিন রিকশা চালায় আর আমি এই কয়লা-বালি টানার কাজ করি।’

আগের মতো আয় নেই জানিয়ে শ্রমজীবী এই নারী বলেন, ‘আগেতো ভালই ইনকাম করতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন বেশিরভাগ মালিক মেশিন দিয়ে মালামাল নামায় তাই আমাদের লাগে না। আর সেভাবে ইনকামও হয় না। এখন কোন দিন ৩০০ টাকা, কোন দিন ৪০০ টাকা ইনকাম করি।’

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি বার্তা২৪.কম বলেন, ‘বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, সে হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়েনি। সব সেক্টরে ন্যূনতম মজুরি অনুযায়ী বেতন-ভাতা না দিলে শ্রমিক বাঁচবে না। বিশেষ করে দিনমজুরদের অবস্থা করুণ। তাদের শ্রমের দামের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবে না।’

;

দাবদাহে দিনমজুররা বঞ্চিত শ্রম অধিকার থেকে

  ‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’



সাদিকুর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

দাবদাহে দিনমজুররা, ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকার আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনের কাছে তুরাগ নদীর তীরে নোঙর করা বালু‌ বহনকারী চারটি লোহার তৈরি বাল্কহেড মধ্যাহ্নের প্রখর রোদে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে প্রায় ১০০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক দলবেঁধে মাথায় করে প্রত্যেকে প্রায় ২৫ কেজি ওজনের ভেজা বালু বাঁশের তৈরি টুকরিতে বহন করে নিয়ে নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে ফেলছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত পরিশ্রম করেও তাদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি।

“অতিরিক্ত গরমে আমাদের ঘাম বাষ্প হয়ে গেছে,” বলেন ৫৮ বছর বয়সী আব্দুল খালেক। তিনি দুই দশক আগে নেত্রকোনা জেলা থেকে ঢাকায় এসে দিনমজুর হয়েছিলেন।

প্রখর রোদে পরিশ্রম করেও শ্রমিকদের মুখ ও‌ শরীর ঘামে ভেজেনি/ছবি: নূর এ আলম


গরমে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমিকরা কাজের ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিকটস্থ এক মসজিদ থেকে আনা বোতলে ভরা পানি‌তে চুমুক দিচ্ছেন।

গত কয়েক বছরের মতো, ২০২৪ এর গ্রীষ্মকাল এমন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু বেশিদিন কর্মহীন হয়ে বাড়িতে বসেও থাকতে পারছেন না। তারা যে বালু খালাস করেন, তার বাজারমূল্য বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি‌। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক দিনমজুর হওয়ায় তাদের কোন শ্রম অধিকারও নেই।

“ঈদের ছুটি শেষে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই বেশির ভাগ কর্মচারী ঢাকায় ফিরেছেন। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে আমিন বাজারে বালু খালাস শুরু হয়। গরম আবহাওয়ার মধ্যে শ্রমিকরা আসেনি,” বললেন শ্রমিকদের সর্দার (আসলে বালুর ঠিকাদারের ম্যানেজার) মশিউর রহমান।

গ্রীষ্মকাল যেন দিনমজুরদের কাছে এক প্রকার জুলুম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে/ছবি: নূর এ আলম


সাধারণত এক বাল্কহেড থেকে সাড়ে নয়শো স্কয়ার ফুট বালু নামাতে ১৫০ জন শ্রমিক দুই দিন সময় নেন, অথচ মশিউর পেয়েছেন প্রয়োজনের এক- চতুর্থাংশ লোকবল।

মশিউরের কথায় মনে পড়ল আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বার্তা। গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ৭ বিলিয়ন কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। চরম তাপপ্রবাহে মানুষের, বিশেষ করে যারা দিনের বেলায় খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন, তাদের কাজের ক্ষমতা কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কর্মঘণ্টার ২.২ শতাংশ বা ৮০ মিলিয়ন নিয়মিত চাকরি ফুরিয়ে যাবে‌ শুধুমাত্র বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে।

এক নারী শ্রমিক মাথায় করে ভেজা বালু বাঁশের টুকরিতে করে  নদীর তীরে একটি নির্ধারিত স্থানে নিচ্ছেন/ছবি: নূর এ আলম


ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ চরম তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে এমনিতেই এখানকার তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা বেশি থাকে।‌ এরপর যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ে তবে অবধারিত ভাবে তাপপ্রবাহ সংক্রান্ত ক্ষতিকর প্রভাব বাড়বে।

২০১৯ সালে আইএলও জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে তাপপ্রবাহে বাংলাদেশ মোট কর্মঘণ্টার ৪.৮৪ শতাংশ হারাবে।

কম মজুরির কর্মই যাদের নিয়তি

জামালপুর থেকে আসা চল্লিশ বছর বয়সী নার্গিস বেগম ১২ বছর আগে আমিন বাজারে খালাসি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময় তাকে ১০ টুকরি বালু খালাসের জন্য ১০ টাকা দেওয়া হত। বর্তমানে সাত টুকরি বালু খালাসের জন্য তিনি একই পরিমাণ মজুরি পেয়ে থাকেন। ১২ বছরে এই পার্থক্য খুবই নগণ্য। অন্যদিকে বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ।

“এক ট্রাক ভর্তি সাদা বালুর (নদী খননে প্রাপ্ত পলি) দাম ছিল ২ হাজার টাকা, যা এখন ৫ হাজার টাকা। গত ১০ বছরে সিলেটের লাল বালুর দাম ৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে,” বলেন শ্রমিক সর্দার মশিউর।

বালুর দাম বেড়েছে বহুগুণ, তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি/ছবি: নূর এ আলম


তাহলে শ্রমিকদের মজুরি কেন বাড়েনি, তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বালুর বাজার এখন অনেক। অনেক ব্যবসায়ী এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। ফলে আমিন বাজারের মহাজনদের (যারা শ্রমিকদের মজুরি দেন) আয় কমে গেছে। যদি তারা ভাল উপার্জন করত তবে শ্রমিকদের ভাল মজুরি দেওয়া হত”; মশিউর তার মহাজনের পক্ষ নিলেন।

লোডিং-আনলোডিং সেক্টরে যান্ত্রিকীকরণেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। এমনকি অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

আমরা যখন শ্রমিকদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমিন বাজার ল্যান্ডিং স্টেশনে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি ক্রেন দেখা গেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল দুই।

“একটি বাল্কহেড থেকে বালু খালাস করতে ১৫০ জন শ্রমিকের দুই দিন সময় লাগতো। সেখানে শুধুমাত্র একজন ক্রেন অপারেটর এবং চার-পাঁচজন শ্রমিক পাঁচ ঘণ্টায় একই কাজ করতে পারে”; শ্রমিক খালেক ব্যাখ্যা দিলেন যন্ত্রায়ন কীভাবে তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলছে।

অসহনীয় আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, খালেকের মতো শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

তুরাগের তীরে কয়লার স্তুপ/ছবি: নূর এ আলম


খালেকের স্ত্রী একজন ঠিকা গৃহকর্মী এবং একমাত্র ছেলে মোসলেম উদ্দিন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু তাদের মজুরি পারিবারিক চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।

শ্রমনীতি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে বেশ কিছু পরিকল্পনা এবং নীতি আছে, যেমন জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নীতি, যেগুলো শ্রমিকের স্বাস্থ্য রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। বিশেষ করে, ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে স্বীকৃতি দেয়া আছে। কারণ, তাপপ্রবাহে মৃত্যুহার বৃদ্ধি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে শ্রমিকরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে তা পরিষ্কার নয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক কোহিনুর মাহমুদ বলেন, দিনমজুরদের নিয়োগকর্তাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা তাপপ্রবাহের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেন।

"দুর্ভাগ্যবশত, নিয়োগকর্তাদের ওপর কোন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, বালু খালাসিদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কোন শ্রম অধিকার নেই”, কোহিনুর বলেন।

তিনি শ্রমিকদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।

;

ছেলেরা খাবার দেয় না, ভিক্ষার থলি হাতে পথে পথে জাহানারা!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাবা, গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না। আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি। মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্ম দেয়া ছেলেরা আমারে কিছুই দেয় না কোনো সময়ই। ঈদেও কিছু দিলো না। তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো। তবুও তারা সুখী হউক’!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি। কর্মে অক্ষম হয়ে ২০ বছর ধরে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়ে ভিক্ষা করছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে শরীর। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে হেঁটে চলেছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে! এই দোকান থেকে ওই দোকান!

জাহানারার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিয়ে হওয়ার দুই বছর পর থেকে টেনেটুনে চলেছিল সংসার তাদের। স্বামী অলস প্রকৃতির ও ভবঘুরে হওয়ায় কোনো সময়ই সংসারে সচ্ছলতা আসেনি।

অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। বয়সের কারণে জাহানাকে মানুষ কাজে নেয় না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করতে শুরু করেন জাহানারা, যা আজ অব্দি চলছে। ২০ বছর পার হতে চললো।

জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই যার যার নিজেদের পরিবার নিয়ে সংসার করছে। কেউই মা-বাবার খোঁজ নেয় না। মেয়েরা মাঝে-মধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয় না জানালেন জাহানারা।

ছেলেরা খাবার দেয় না! ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে পথে ভিক্ষা করেন জাহানারা, ছবি- বার্তা২৪.কম

জাহানারার নামে একটু জমি ছিল। সেটুকুও ছেলেরা লিখে নিয়েছে। বর্তমানে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাবা-মা ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেন হলো বাবা-মায়ের হলো আপন ঠিকানা! বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে আর রাত হলেই শিয়াল ও বন্য প্রাণীর শব্দে রাত কাটে তাদের।

তার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর মাংস খেয়েছেন। এরপর ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনোটাই সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। মাঝে-মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য মাংস তাদের জন্য স্বপ্ন হয়েই আছে। সে কারণে সারাবছর কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন তারা।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন জাহানারা। পাঁচ থেকে ছয়শ টাকা আয় হয়। বয়স্ক ভাতা যা পান, তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সপ্তাহের খাবার খরচ মেটাতে হয়।

বৃদ্ধ জাহানারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি। এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি। মানুষ মাঝে-মধ্যে খাইতে দ্যায়। বাকি দিনগুলো কেমনে যে পার করি, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না কিছু'!

 

 

;

বিলের মাঝে উড়োজাহাজ! দেখতে আসেন সবাই!



ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুর (কাপাসিয়া) থেকে ফিরে: দূর থেকে দেখে হবে, ধানের জমির মাঝে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, এক উড়োজাহাজ। কাছে গেলেই দেখা যাবে, কাগজ দিয়ে তৈরি উড়োজাহাজের আদলে তৈরি একটি ডিজাইন।

ভুল ভাঙবে তখন, যখন ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, আসলে এটি একটি রেস্টুরেন্ট, উড়োজাহাজ নয়! গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নের পূর্ব খামের গ্রামের রফিক নামে এক তরুণ তৈরি করেছিলেন এই ‘বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট’টি।

কয়েক বছর আগে এই রেস্টুরেন্ট-মালিক প্রবাসে চলে গেলে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও এটিকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ছুটে আসেন। উড়োজাহাজ আকৃতির এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, পলিথিন দিয়ে কারুকার্য করে তৈরি করা এটিতে রয়েছে জানালা ও একটি দরজা। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখানে শিশুদের আনাগোনাই বেশি। বড়দের হাত ধরে এসে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তারা।

গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ধানক্ষেতের মাঝে উড়োজাহাজ আকৃতির রেস্তরাঁ । নাম- 'বিমান বিলাশ রেস্টুরেন্ট' , ছবি- বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এটি দেখার জন্য অনেক মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এছাড়াও আশপাশের জায়গাগুলোও বেশ মনোরম। প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। সে কারণে সবসময়ই লোকজন এখানে বেড়িয়ে যান।

প্রথম যখন উড়োজাহাজ আকৃতির এই রেস্টুরেন্টটি তৈরি করা হয়, তখন এটি দেখতে আরো বেশি সুন্দর ছিল। রাতেও মানুষজন আসতেন। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এটি দেখে আসল উড়োজাহাজে চড়ার স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।

;