চেঙ্গিস খান : রহস্যময় এক বিশ্ববিজেতা

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 21:18:34

তিনি নিজেকে যতটা উচ্চতায় নিতে পেরেছিলেন; প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের কোনো একক ব্যক্তির পক্ষেই তা সম্ভব হয়নি। নিজের গোত্রের প্রতি উদারতা, অনুসারীদের জন্য ভালোবাসা কিংবা শত্রুর প্রতি নৃশংসতা; সমস্তই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। হয়েছেন নিন্দিত এবং নন্দিত। কিন্তু তারপরেও এক অনির্বচনীয় রহস্য তাকে কেন্দ্র করে। চেঙ্গিস খান—অনুসারীদের কাছে ঈশ্বরের দূত হিসাবে বিবেচিত ইতিহাসের এক প্রলয়ঙ্কর চরিত্র।

তার আগমনের আগে এবং পরে পৃথিবীর ফারাক ছিল আকাশ পাতাল। চেঙ্গিস খান বিখ্যাত মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। জন্ম ১১৬২ সালে এবং মৃত্যু ১২২৭ সালে। তিনি ও তার বাহিনী সাম্রাজ্যের পরিধি এতটাই বৃদ্ধি করেন, রোমান শাসনকর্তারা চারশত বছরেও যা করতে পারেনি। হিন্দুধর্মে দেবতাদের অবতারবাদের ধারণা আছে। সেদিক থেকে দেখলে চেঙ্গিসকে অপদেবতার অবতার বলা যায়। ঐতিহাসিকরা তাকে “ঈশ্বরের অভিশাপ” বলে অভিহিত করেন। মঙ্গোলিয়ার ক্ষুদ্র এক গোত্রে জন্ম নিয়ে তিনি তৎকালীন পৃথিবীর নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়েছিলনে।

কিছু শৈশব

চেঙ্গিস খানের বাল্য নাম তেমুচিন। নামের অর্থ ইস্পাত। বাস্তবিক অর্থেই তার প্রমাণ দেখিয়েছেন। পিতা ইসুকাই ছিলেন বোরিজিন নামের এক মোঙ্গল যাযাবর গোত্রের প্রধান। অন্যান্য স্থায়ী কিংবা কৃষিনির্ভর গোত্রের মতো যাদের থিতু হবার খায়েশ ছিল না। তারচেয়ে ঢের পছন্দ ছিল শিকার এবং লুটপাট করা। তৎকালে একে অসভ্যতা বলে দেখার কোনো যুক্তি নেই। বরং বিশুদ্ধ বৈধ এবং পুরুষোচিত কাজ বলেই গণ্য হতো।

চেঙ্গিস খানের আগে যাযাবর তাতাররা ছিল বিক্ষিপ্ত


তারও আগের ঘটনা। হেলুন নামের এক কুমারী কন্যাকে বিয়ে দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। যাযাবরদের বিয়ে, এক গাদা ঘোড়সওয়ার আর বেশ মালসামান সাথেই। বিপত্তি ঘটল পথে। বরযাত্রীর সুখযাত্রাকে পণ্ড করে দিয়ে নববধূকে উঠিয়ে আনলেন এক যাযাবর নেতা। তাকে দিলেন নিজের দ্বিতীয় স্ত্রীর সম্মান। সেই সংসারের দ্বিতীয় সন্তানই তিমুচিন। জন্মের সময় হাতে রক্ততিল থাকার কারণে মনে করা হয় ছেলে বয়সকালে বড় যোদ্ধা হবে। সেই বিশ্বাস পূরণ হতে দেরি হয়নি।

দুর্দিন ও গোত্রীয় দ্বন্দ্ব

তেমুচিনের বয়স তখন নয় বছর। পিতার বন্ধু ও প্রতিবেশি গোত্রের কোনো উৎসবে যোগ দেওয়া হয় সবাই মিলে। তার আগে কাজের জন্যই সেখানে তেমুচিনকে থাকতে হয়েছে বেশকিছু বছর। সেখানেই বোরতাই নামের এক বালিকা—পার্শ্ববর্তী গোত্রনেতার কন্যার সাথে বিয়ে হয় তার। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় ঘটে বিপত্তি। বিদ্রোহীদের হাতে বিষপানে মৃত্যু হয় তেমুচিনের পিতা ইসুকাইয়ের। উঠিয়ে নেওয়া হলো স্ত্রী বোরতাইকে। বিদ্রোহীরা বালক তেমুচিনকে অপসারণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছিল।

ওয়াং খানের দরবারে বালক তেমুচিন


তেমুচিনের পরিবারে তখন দুরবস্থা চলছে। দীর্ঘদিন ধরে শিকড়, ফল কিংবা মাছ খেয়ে কোনোমতে দিন গুজরান করছে। কিন্তু শিকারি বিড়াল শৈশবেই চেনা যায় বলে একটা কথা আছে। তেমুচিন তার পিতার বন্ধু কেরাইট গোত্রের অধিপতি ওয়াং খানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ওয়াং খান সম্মত হলে সৈন্য সাজিয়ে রওনা দিলেন বিদ্রোহী মেরকাইট গোত্রের মোকাবেলায়।

সাফল্য এবং উত্থান

প্রশ্ন বোরতাইয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং নিজ বংশের সম্মান রক্ষা—দুটোই। তেমুচিন ওয়াং খানের সাহায্য নিয়ে মেরকাইটদের সফলভাবে পদানত করেন। এই বিজয় তার পরবর্তী সাফল্যের পথ অনেকটাই সুগম করে দেয়। বংশের প্রায় হতাশ মানুষগুলো তাকে কেন্দ্র করে আবার একত্রিত হতে থাকে। তারপর তেমুচিন মনোযোগ দিলেন পিতৃশত্রু তাতার গোত্রের দিকে। এবং পরাজিত করলেন শোচনীয়ভাবে।

জামুকার বিরুদ্ধে বিজয় তাকে গোত্রের ভরসায় পরিণত করে


জামুকা নামের প্রভাবশালী এক গোত্রপতি তেমুচিনের উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। তাই, মেরকাইট, নাইমান এবং আরো কয়েকটি বিদ্রোহী গোত্রকে একত্রিত করে জোট গঠন করেন তেমুচিনের বিরুদ্ধে। দুই বাহিনী মুখোমুখি হলো ১২০৪ সালে। জামুকা পরাজিত এবং বন্দী হলো, পরে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে মোঙ্গল জাতির ওপর তেমুচিনের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। ১২০৬ সালে কারাকোরামে কুরিলতাই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে তিনি চেঙ্গিস খান উপাধি গ্রহণ করেন। রাজধানীর মর্যাদা পায় কারাকোরাম।

চীনের বিরুদ্ধে জয়যাত্রা

একসময়ের গৌরবে ভরা চীন তখন স্তিমিয়ে পড়েছে অনেকাংশেই। উত্তরে চীন এবং দক্ষিণে সাঙ বংশ রাজত্ব করত। চেঙ্গিস খান সবার আগে সাঙ বংশকেই লক্ষ্যবস্তু করে আক্রমণ করলেন। ১২১১ সালের এই অভিযানে বিশাল অংশ তার অধিকৃত হয়। ১২১৪ সালে চীন বংশের রাজধানী পিকিং অবরোধ করলে রাজা ভীত হয়ে পাঠায় সন্ধিপ্রস্তাব। সেই সাথে দেওয়া হয় অঢেল অর্থ, মণিমুক্তা এবং উপঢৌকন। উপহার এবং নবপরিণীতা চীনা রাজকুমারিকে নিয়ে সেই দফায় ফিরে এলেও মন ঘুরতে দেরি হয়নি। ১২১৫ সালে চেঙ্গিস খান আবার পিকিং অবরোধ করে এ পর্যায়ে দখল করে নেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি শত্রু পক্ষের ওপর একক আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়


এদিকে দেখা দেয় অন্য সমস্যা। তাতার নেতা গুরখান বিদ্রোহ করে বসে চেঙ্গিস খানের বিরুদ্ধে। কারাকিতাইয়ের এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য তিনি সেনাপতি জেবিকে প্রেরণ করেন। গুরখান পরাজিত ও নিহত হলে গোটা অঞ্চলে চেঙ্গিসের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

খাওয়ারিজম শাহের সাথে দ্বন্দ্ব

খাওয়ারিজমের শাসক তখন মুহম্মদ শাহ। বাগদাদ কেন্দ্রিক মুসলিম খিলাফতের পতনের সুযোগে মুহম্মদ শাহ মধ্য এশিয়ায় সুবিশাল এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। চেঙ্গিস খানের সাথে তার দ্বন্দ্বের কারণ মূলত উভয়ের উচ্চাভিলাস এবং আত্মাভিমান। মোঙ্গল দূত হত্যা করার কারণেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ ঘোষণা করেন চেঙ্গিস খান। ১২১৯ সালে চালানো এই সুবিশাল অভিযানে হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রচুর। ছয় মাসের অবরোধের পর নিয়ন্ত্রণে আসে উস। ধীরে ধীরে দখল প্রতিষ্ঠিত হয় বোখারা, হিরাত, বলখ, খোজান্দ, তাসখন্দ, সমরখন্দ প্রভৃতি স্থানগুলো। ঐতিহাসিক গীবনের মতে, এই চার বছরে যে পরিমাণ ধ্বংস হয়েছে, তা পাঁচশত বছরেও পুনর্গঠন করা যায়নি।

প্রত্যেকটা নগরী তছনছ হয়ে যায় তাদের তাণ্ডবে


মুহম্মদ শাহ পালিয়ে জীবন যাপনের এক পর্যায়ে ১২২০ সালে মারা যান। মৃত্যুর পর তার স্থান দখল করেন পুত্র জালালউদ্দীন। দক্ষ এবং চৌকস যোদ্ধা ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকবার মোঙ্গল বাহিনীকে পরাজিতও করেছিলেন। কিন্তু দিনশেষে ১২২১ সালের দিকে পিতার ভাগ্য বরণ করতে হয়। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে ১২৩১ সালে আততায়ীর হাতে তার মৃত্যু হয়।

শেষের দিনগুলো

ততদিনে চেঙ্গিস এশিয়ার প্রায় পুরো অংশ দখল করে ফেলেছে। দুই সেনাপতি জেবি এবং সেবুতি গিয়ে দখল করেন উত্তর-পশ্চিম পারস্য। তারপর সেনাপতিরা রাশিয়ার দিকে অগ্রসর হয় এবং খিবা অধিকার করে। ১২২৫ সালে চেঙ্গিস খান ফিরে আসেন দেশে। কিছুদিন পরেই চীনের সাঙ সাম্রাজ্যের অংশে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সারাজীবন ঘোড়ার পিঠে বসে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তারপরেও বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এই রওনাই তার পরবারের উদ্দেশ্যে রওনায় পরিণত হয়। ১২২৭ সালে চীন পৌঁছানোর পূর্বেই প্রাণত্যাগ করেন এই প্রতাপশালী পুরুষ।

শাসন ও আইনব্যবস্থাতেও তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য


চেঙ্গিস খান কেবল তার সময়ের না; বরং গোটা ইতিহাসের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক। তার সামরিক দক্ষতার কারণেই মোঙ্গল বাহিনী এক অপরাজেয় শক্তিতে পরিণত হয়। পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম ধরে মোঙ্গল বাহিনী এশিয়া এবং ইউরোপের রাজাদের জন্য ত্রাস হিসাবে গণ্য হতে থাকে। প্রশাসক হিসাবেও তার খ্যাতি ব্যাপক। চীনা প্রশাসক ইয়েলু চুৎসাইয়ের তত্ত্বাবধানে প্রশাসনকে ঢেলে সাজান, সৃষ্টি করেন গোয়েন্দা এবং বিচার বিভাগ। ধর্মের দিক থেকে তাকে সহনশীল বলেই গণ্য করা হয়। পূর্বতন চীনা শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে প্রভাবিত হয়ে নিজের রাজ্যকেও চালিত করেন সেই পথে। তার প্রবর্তিত আইনবিধান পরিচিত ‘উলাঙ্গ ইয়াছা’ নামে। 

মৃত্যুর পূর্বে তার রাজ্য বিস্তৃত ছিল কাস্পিয়ান থেকে প্রশান্ত মহাসাগর অব্দি


চেঙ্গিস খানের চারপুত্র—চাগতাই, ওগোতাই, জুসি এবং টুলি। পিতার মৃত্যুর পর তারা পূর্ববর্তী বেগেই জয় করতে থাকে একের পর এক রাজ্য। মুসলিম বিশ্বের ভিত্তিভূমি বাগদাদের পতন ঘটে ১২৫৮ সালে হালাকু খানের হাতে। তিনি ছিলেন চেঙ্গিসের নাতি। ছোট্ট একটা গোত্রের অধিপতির পুত্র হিসাবে জন্মগ্রহণ করে চেঙ্গিস খান নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তর সাম্রাজ্যের অধিপতিতে। তার রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর