● পর্ব-১ পড়তে ক্লিক করুন
● পর্ব-২ পড়তে ক্লিক করুন
তৈমুর লঙের আকাশে তখন গনগনে মধ্যদুপুর। মধ্য এশিয়ার সমগ্র অঞ্চল, পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপের বড় অংশ তার অধিকারে। বাকি অংশও ভীত-সন্ত্রস্ত। ভাগ্যক্রমে ভারতে ততদিনেও থাবা পড়েনি তৈমুরের। খুব সম্ভবত এ ব্যাপারে তার মনেই পড়েনি বলাটা বেশি যৌক্তিক হবে। কিন্তু সেই অপেক্ষা স্থায়ী বেশিদিন হলো না। শীঘ্রই তৈমুর তৈরি হলেন ভারত অভিযানে।
মোটা দাগে, ভারত আর তৈমুর—উভয়ের জন্যই এই অভিযান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের অপরিমেয় ঐশ্বর্যের গল্প তৈমুরের কানে যেতেও বাকি থাকেনি। যদিও তার আগে চেঙ্গিস খানও ভারতে আসার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন; তথাপি মুলতান এবং পঞ্জাব পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে আর রুচি ধরে রাখতে পারেননি। তৈমুর বোধহয় সেই না হওয়া অভিযানকে পূর্ণতা দিতেই আগমন করলেন।
তখন ভারতের মসনদে মাহমুদ শাহ তুঘলক। শাসক হিসাবে তাকে অযোগ্য বলা হলেও কম বলা হয়ে যাবে। তুঘলক সালতানাতের তখন নড়বড়ে অবস্থা। মাহমুদ শাহের দুর্বলতার জন্য সাম্রাজ্যের ভেতরে কোন্দল জন্ম নিতে থাকে। বিশেষ করে আমীর-উমরাহদের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। রণনিপুণ তৈমুর লঙ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। নাতি পীর মুহম্মদের নেতৃত্বে একদল সৈন্যকে ভারত আক্রমণ করার জন্য পাঠালেন ১৩৯৮ সালে।
পীর মুহম্মদ পাঞ্জাবে প্রবেশ করলেন সিন্ধু পার হয়ে। অবরোধ করলেন মুলতান। ছয় মাস অবরোধের পর পরাজিত হন মুলতানের শাসনকর্তা সারাঙ খান। তার আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে তৈমুরের অধিকারে আসে মুলতান। আর সেই সাথে অধিকারে আসে ব্যাপক ধন সম্পত্তি। কতিপয় সেনানায়কের বিরোধিতা সত্ত্বেও তৈমুর নিজে ভারত আক্রমণ করতে মনস্থ হলেন।
১৩৯৮ সালের ডিসেম্বর মাস। প্রায় ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে দিল্লির উপকণ্ঠে পৌঁছালেন তৈমুর লঙ। মাহমুদ শাহ এবং তার সেনাপতি মাল্লু খান ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রতিরোধে নামেন। রক্তাক্ত যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো মাহমুদ শাহ। তৈমুর দিল্লিতে প্রবেশ করলে জনগণের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া হলো। প্রচুর ধন সম্পদ নেবার মানসিকতায় ক্ষমা করলেন তিনি। কিন্তু শীঘ্রই প্রকাশ পেয়ে গেল তার সৈন্যদের লুটতরাজ। যে যেভাবে পারল জনসাধারণের বাড়ি ঘর লুট করতে লাগল। আস্তে আস্তে জনগণের একাংশ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। আক্রমণ করে বসে তৈমুরের সৈন্যদের ওপর।
এই অপরিণামদর্শী কাজের ফলাফল হলো ভয়াবহ। ক্রোধে উন্মত্ত তৈমুর প্রতিশোধের জন্য নির্বিচারে হত্যা ও অগ্নিসংযোগের আদেশ দিলেন। শুরু হলো ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। পঁচিশ দিন পর্যন্ত চলল লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ। নিহত হলো লক্ষাধিক। দিল্লি পরিণত হলো ধ্বংস্তূপে। প্রভূত ধন সম্পদ নিয়ে তারপরেই নিজের দেশে ফিরলেন তৈমুর। যাবার পথেও বিধ্বস্ত করে গেলেন মিরাট, আগ্রা এবং জম্মু। ভারত ত্যাগের আগে খিজির খানকে লাহোর আর মুলতানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে গেলেন। সুনামির শেষে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে থাকা ভূমির মতো থেতলে থাকল ভারত।
মূলত তৈমুর লঙের আক্রমণের সদূরপ্রসারী ফলাফল হিসাবেই দিল্লিতে তুঘলক বংশের পতন এবং সৈয়দ বংশের উত্থান ঘটে। ভারত ত্যাগ করার আগে এখান থেকে প্রচুর সংখ্যক শিল্পী, স্থপতি এবং কারিগর তৈমুর সাথে করে সমরকন্দ নিয়ে যান; যারা সেখানে শিক্ষা ও সংস্কৃতির নতুন যুগের সূচনা করে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক আর সি মজুমদার তার লেখা ‘এন এডভান্স হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’-তে দাবি করেছেন, “যতবার ভারত বৈদেশিক শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে তৈমুরের আক্রমণই সর্বাপেক্ষা মর্মন্তুদ ঘটনা।”
তৈমুরের বয়স তখন সত্তর পার হয় হয়। এই বয়সে সবাই বিশ্রামে চলে যায় পার্থিব বিষয়াদি থেকে। হয়তো তৈমুরও তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি তা হতে দিল না। মিশর ও সিরিয়ার মামলুক সাম্রাজ্যের সাথে লেগে গেল দ্বন্দ্ব। এই সময়টাতে মামলুকদের মসনদে ছিল মালিক আন নাসির ফারাজ। ফলত, পূর্ব ঐতিহ্য আর গৌরব স্তিমিয়ে পড়তে শুরু করেছে তখন। তৈমুর লঙ সবটা শুনে সমরকন্দ হতে আজারবাইজানের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
বাগদাদের রাজা তখন সুলতান আহমদ। নির্বিচারে বহু সাধারণ লোককে হত্যার জন্য তার বিরুদ্ধে জনগণ ক্ষেপে ওঠে। বিদ্রোহ অদমনীয় হয়ে উঠলে পালিয়ে কারা কুয়ুনলু বংশের কারা ইউসুফের কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন আহমদ। তৈমুর লঙ আজারবাইজান পার হয়ে প্রথমে সিভার্স দূর্গ দখল করেন। তারপর সিরিয়া যাবার পথে অধিকার করেন বাহাসনা দূর্গ। ১৪০০ সালের নভেম্বরের দিকে তার সৈন্যরা আলেপ্পো অবরোধ করল। শাসনকর্তা দামরুদ শাহ বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করলেও দিনশেষে পরাজিত হলেন তৈমুরের প্রশিক্ষিত সৈন্যের কাছে।
এরপরেই অবরোধ করা হলো দামেশক। মামলুক শাসক আন নাসির ফারাজের কানে পানি গেল তৈমুরের তাণ্ডবের গল্প আর নিজের সম্ভাব্য পরিণাম শুনে। তিনি মিশরীয় সৈন্যসহ এগিয়ে এলেন তৈমুরকে বাধাদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরাজয় নিশ্চিত মনে করে শীঘ্রই মিশর ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সিরিয়া বাহিনীই শেষ পর্যন্ত মুখোমুখি হলো তৈমুরের। আত্মসমর্পণ না করার অপরাধে সিরিয়াবাসীর ওপর চলল নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ; যা সিরিয়াবাসী আগে কখনো দেখেনি। ১৪০১ সালে দামেশক বিজয় সমাপ্ত হলে দখল করেন বাগদাদ। তবে মামলুক শাসকের সাথে বোঝাপড়া শেষ হবার আগেই তাকে ফিরে আসতে হয় অটোম্যান শক্তির মোকাবেলা করার জন্য। কারণ খবর আসে, এশিয়া মাইনরে অটোম্যান সুলতান বায়েজিদ সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে।
খুব সম্ভবত তৈমুর লঙের সামরিক ইতিহাসে অটোম্যান অভিযানই সর্বশ্রেষ্ঠ। এশিয়া এবং ইউরোপের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি অটোম্যানরা যখন ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছে; সেই সময়ে ঝড়ের মতো এসে তৈমুর তাদের অহঙ্কার ধুলায় মিশিয়ে দিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে দুই শক্তিমানের এমন নাটকীয় লড়াই অন্যরকম অধ্যায়ের সূচনা করে।
প্রথমত দুজন শাসকই ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তার ওপর তৈমুরের রাজ্য বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য অব্দি। তৈমুর চেঙ্গিস খানের উত্তরাধিকারী হিসাবে এশিয়া মাইনরে নিজের আধিপত্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখতেন। অন্যদিকে বায়েজিদ নিজেকে সেলজুক তুর্কিদের উত্তরসূরী হিসাবে প্রভূত্ব স্থাপন করতে চাইলেন নিজের। ফলে চাপা একটা ঈর্ষা কাজ করছিল উভয়ের মধ্যেই। তার ওপরে, বায়েজিদ বাগদাদের বিদ্রোহী সুলতান আহমদ এবং আজারবাইজানের বিদ্রোহী রাজপুত্র কারা ইউসুফকে আশ্রয় দিয়েছিল; যারা ছিল তৈমুরের শত্রু। আর তৈমুর আশ্রয় দিয়েছিলেন আইডিন ও কাস্তেমুনীরের পলাতক যুবরাজ ও আমীরদের; যারা ছিল বায়েজিদের শত্রু।
তৈমুর পত্র প্রেরণ করলেন—বায়েজিদ যেন তৈমুরের শত্রু আহমদ ও কারা ইউসুফকে ফিরিয়ে দেয়। বায়েজিদ চিঠির জবাবে কেবল তৈমুরের প্রস্তাব নাকচই করল না; তার শত্রু তাহেরতীনকে ফিরিয়ে দেবার জন্য পত্র দিলেন। ক্ষুব্ধ তৈমুর পরের চিঠিতে বায়েজিদের খ্রিস্টান স্ত্রী ডেসপিনার প্রসঙ্গ এনে বায়েজিদের বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ আনেন। জবাবে বায়েজিদও তৈমুরের হেরেম এবং পত্নী নিয়ে কড়া মন্তব্য করেন। এভাবে উভয়পক্ষের চিঠি চালাচালি আস্তে আস্তে এক ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নেয়। তৈমুর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার জন্য।
সিভার্স দূর্গের পতন এবং পুত্র তুঘ্রীলের মৃত্যু বায়েজিদকে ক্ষিপ্ত করে দেয়। তখন তিনি কনস্টান্টিনেপল অবরোধে ব্যস্ত। সেই অবরোধ প্রত্যাহার করেই তৈমুরের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি শুরু হলো। সকল তুর্কি সৈন্য অংশগ্রহণ করল এতে। সার্বিয়ার সম্রাট স্টিফেনের নেতৃত্বে ২০ হাজার সার্বিয়ান ও বলকান অশ্বারোহী যোগ দিল। হাজির হলো গ্রিক ও ওয়ালিচিয়ার সৈন্যরাও। বায়েজিদের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় দুই লাখ। সেনাপতি তিমুরতাশ এবং দুই পুত্র সুলায়মান এবং মুহম্মদ বাহিনী পরিচালনার ভার নিলেন।
১৪০২ সালের ২৮ জুলাই। আঙ্কারার প্রান্তরে দুইপক্ষের মোকাবিলা হলো। ইতিহাসের এই যুদ্ধ আঙ্গোরার যুদ্ধ নামে পরিচিত। তাতার বাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতা আর তৈমুরবাহিনীর দ্রুততার কাছে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তুর্কি বাহিনী। প্রতিপক্ষের অগ্নিগোলকের সামনে টিকতে না পেরে অনেক তুর্কিই পলায়ন শুরু করে দিল। এমনকি সুলতানের পুত্র সুলায়মানও পলায়ন করলেন জীবন বাঁচাতে। শত প্রচেষ্টার পরেও নিজের পরাজয় ঠেকাতে পারেননি বায়েজিদ। বন্দী অবস্থায় হতাশ হয়ে ১৪০৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমগ্র এশিয়া মাইনরে তৈমুরের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো।
আবার মামলুক শাসকের পালা। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তুর্কি সুলতান বায়েজিদের পরিণতি ইতোমধ্যে সকলের জানা হয়ে গেছে। তাই অনুরূপ পরিণতি বরণ করার জন্য কেউ আগ্রহী হলেন না। সময় থাকতেই তাই তৈমুরের দরবারে রাজদূত প্রেরণ করলেন বশ্যতা স্বীকার করে। তৈমুরকে কর প্রদান এবং তার নামে খুৎবা প্রদানেও স্বীকার করলেন মামলুক শাসক মালিক আল নাসির। ফলে মামলুকদের এশিয়া মহাদেশের এলাকাও অন্তর্ভুক্ত হলো তৈমুরের রাজ্যের সাথে।
আঙ্গোরার সাফল্য আর মামলুকদের বশ্যতা তৈমুরকে তুলে দিল অনন্য উচ্চতায়। ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ হেনরি এবং স্পেনের রাজা ষষ্ঠ চার্লস তাকে অভিনন্দন জানালেন। কনস্টান্টিনেপলের শাসক ম্যানুয়েল স্বীকৃত হলেন বার্ষিক কর প্রদানে। তৈমুর এখন ক্লান্ত। বিপুল সম্পদ, সেন্টপল ও পিটারের মূর্তি, ব্রুসার রৌপ্যনির্মিত সিংহদ্বার এবং বাইজান্টাইনের লাইব্রেরি সাথে করে নিয়ে তিন বছর পর সমরকন্দে ফিরে গেলেন বিজয়ীর বেশে।
খুব সম্ভবত বিষয়ের নেশা তৈমুরকে পেয়ে বসেছিল। তাই এত অভিযানের পরেও হঠাৎ চীন বিজয়ের অভিপ্রায় জাগ্রত হলো তার। ১৪০৫ সালে দুই লাখ সৈন্য সমেত অভিযানে বের হলেন। সারাটা জীবন ঘোড়ার পিঠে থেকে থেকে মানুষটা সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারপরেও চীনের দুর্গম পথকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। বরফের ওপর পশমী কাপড় বিছিয়ে তৈরি হলো চলার পথ। অনেক সৈন্য যাত্রাপথে মৃত্যুবরণ করলেন। হার না মানা একরোখা তৈমুর চলতে থাকলেন তবু। অতঃপর ওতবার নামক স্থানে তৈমুর নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
বয়সের ভার, অমানবিক পরিশ্রম আর অতিরিক্ত মদ্যপান তার শরীরকে ভেঙে ফেলেছিল। নানা রকম চেষ্টা করেও তাই বাঁচানো গেল না দিগ্বিজয়ী তৈমুর লঙকে। ১৪০৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি চীন অভিযানের পথেই মৃত্যু হয় তার। মৃত্যু হয় একজন অভিযাত্রীর; যিনি খুব সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নিয়ে বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়কে পরিণত হয়েছিলেন।
এইখানেই আমাদের গল্প শেষ টানলে তৈমুরকে কেবল বিজয়ে তৃষ্ণার্ত এক নৃশংস সাম্রাজ্যবাদী বলে মনে হবে। তাই প্রসঙ্গ টানব তার শিল্পবোধ আর শাসনবিত্তান্তের। তৈমুর অধ্যায়ের সবচেয়ে রহস্যময় দিক। কিন্তু সেই কথা পরের পর্বে।