রডোডেনড্রন মানে গোলাপ

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 22:42:34

আদি ও অকৃত্রিম এশিয়ান ফুল হলেও রডোডেনড্রন নামটি ইউরোপীয়। আরও মজার ব্যাপার হলো, রডোডেনড্রন নামটির বাংলা মানে হলো গোলাপ গাছ!

জোসেফ ডালটন হুকার নামে ব্রিটিশি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ব্রিটিশ-বাংলায় এসে হিমালয়ের বুকে খুঁজে পেয়ে এই ফুলকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেন।

রডোডেনড্রন নামটি এসেছে গ্রীক থেকে। শব্দটির অর্থ হলো: "rodon" মানে গোলাপ এবং "dendron" মানে গাছ। অর্থাৎ Rhododendron মানে গোলাপ গাছ। পারস্য আর মধ্য এশিয়ার বিশ্বজয়ী গোলাপ হয় তো জানেই না, হিমালয়ের ভূগোলে রডোডেনড্রন নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও এক গোলাপ!

নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিরসবুজ পুষ্পক বৃক্ষ হওয়ায় রডোডেনড্রন গুল্ম জাতীয় ফুলের রাজা। রডোডেনড্রন বড় বড় পাতাযুক্ত গুল্ম, প্রজাতিভেদে সর্বনিম্ন ৪ ইঞ্চি হতে সর্বোচ্চ ৯৮ ফুট পর্যন্ত উচুঁ হতে পারে। রডোডেনড্রন ফুল সাধারণত গুচ্ছবদ্ধ ভাবে হয়। এতে গোলাকার গুচ্ছবদ্ধ সাদা, গোলাপী, লাল, বেগুনি ইত্যাদি রংয়ের ফুল ফোটে। ফুল ফোটে শীতের শেষ হতে গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত সময়কালে।

আরও পড়ুন: রডোডেনড্রনের পাশে আরেক ডারউইন

বিশ্বজুড়ে রডোডেনড্রনের প্রায় দেড় হাজারটি প্রজাতি রয়েছে। প্রধানত এশিয়ায় জন্ম হলেও বর্তমানে ইউরোপে. উত্তর আমেরিকার অ্যাপলেশিয়ান পর্বতের দক্ষিণে উচ্চভূমির সর্বত্রই রডোডেনড্রন বিস্তৃত।

রডোডেনড্রন গাছের সব অংশই বিষময়। বিশেষত পাতা বিপদজনক। এর ফলে পাকস্থলীর পীড়া, তলপেটে ব্যথা, হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক গতিবৃদ্ধি, কোমা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তদুপরি রডোডেনড্রন ফুলের মধুও বিষাক্ত এবং ভোজ্য নয়। তবে ফুলের তৈলাক্ত পাপড়ি ও পাতার নির্যাস থেকে এক ধরনের মাদকতাময় সুগন্ধী উৎপন্ন হয়।

আধুনিক জগৎ রডোডেনড্রনকে চেনার জন্য যে ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানীর কাছে ঋণী, সেই হুকারের রডোডেনড্রন নোটে লেখা আছে পুষ্পের যথার্থ বন্দনা: ‘‘তার চিরসবুজ পাতার কথাই বলি, বা তার থোকায় থোকায় ফুটে-থাকা ফুলের বাহারের কথাই, প্রাচ্যের এই প্রজাতিটির মতো আর কোনও ফুলের গাছই এত বিস্তৃত, ব্যাপক ভাবে জন্মায় না।’’

পূর্ব আসাম থেকে নেপালের পর্বতমালা অবধি হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অক্লান্ত ঘুরেছিলেন হুকার। খেয়াল করেছিলেন, পূর্ব আসামে রডোডেনড্রন মেলে ৫৪০০ ফুট থেকে ১২০০০ ফুট উচ্চতাতেও। নেপাল সীমান্তে টোংলু পর্বতে ওঠার সময় দেখেছিলেন সারা জায়গাটা রডোডেনড্রনে ছেয়ে আছে। ৭০০০ ফুট উচ্চতায় দেখেছেন, লিলির মতো দেখতে বড় বড় ডালহৌসি রডোডেনড্রনে ভরে আছে ঘন জঙ্গল। মাথার ওপর বিশালকায় ওক গাছগুলো থেকেও ফুল ঝরেছে নিচে, আছে ডিমের মতো দেখতে ম্যাগনোলিয়ার ফুলও।

তবে উদ্ভিদবিজ্ঞানী চার্লস ক্লুস ১৬ শতকে রডোডেনড্রনের একটি প্রজাতি আবিষ্কার করেন। তারপর Rhododendron histrum প্রজাতির রডোডেনড্রন সর্বপ্রথম ১৬৫৬ সালে আল্পস পর্বত থেকে ব্রিটেনে আনা হয় বলে একে লন্ডনে ‘আলপাইন রোজ’ বলে। কিন্তু ব্রিটেন ও ইউরোপে রডোডেনড্রনের বিকাশ ও বিস্তৃতি হুকারের মাধ্যমে হিমালয় অঞ্চলের অসংখ্য প্রজাতির দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছে বলেই সবাই স্বীকার করেন।

আরও পড়ুন: বিশ্বায়নের দূত রডোডেনড্রন

সবচেয়ে বেশি রডোডেনড্রন ফুলের দেখা কোথায় পাওয়া যায়? নেপালে? সিকিমে? ভুটানে? আসামে? মেঘালয়ে? এই প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর পাওয়া ভার। বিশেষজ্ঞরা এ কারণে ফুলটির আদিআবাসস্থল নির্ধারণ করেছেন সমগ্র পূর্ব হিমালয় অঞ্চল। মানে হলো, এই ভৌগোলিক অবস্থানে যতগুলো দেশ বা রাজ্য আছে, সবগুলোই রডোডেনড্রনের আবাস।

মূলত পূর্ব হিমালয়ের অনুচ্চ পর্বত গাত্রে ছবির মতো লেপ্টে আছে রডোডেনড্রনের ঝোপ। রডোডেনড্রন ফুলের বড় বড় গাছগুলো যখন পাহাড়ের গায়ে শাখা-প্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে থাকে, আর তাতে অসংখ্য লাল টকটকে ফুল ফুটে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না কেন সকলেই এই ফুলের বন্দনা করেন।

রবীন্দ্রনাথ অবশ্য শিলং-এর পাহাড়ে রডোডেনড্রন ফুলের দেখা পেয়েছিলেন। জায়গাটি একদা ছিল আসামের অংশ, এখন মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। তবে সামগ্রিকভাবে নিম্ন-হিমালয়ান অঞ্চলভুক্ত।
রডোডেনড্রন ফুল শীতে ফোটে না। পাহাড়ের ফুল রডোডেনড্রনের দেখা মেলে বসন্তের শেষে। অনেকগুলো রং হয় এর। সাধারণত উচ্চতা ভেদে এই ফুলের রঙের তারতম্য দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে গায়ে যে রডোডেনড্রন গুচ্ছের ছড়াছড়ি, সেগুলোর প্রায়-সবই লাল বা গাঢ় কমলা। উচ্চ পাহাড়ের কিছুটা নিচের দিকে উপত্যকায় দেখতে পাওয়া যায় ঈষৎ বেগুনি, হালকা গোলাপি রঙের রডোডেনড্রন।

রডোডেনড্রন নেপালের জাতীয় ফুল এবং আমেরিকার ওয়াশিংটন ও ভারতের সিকিম রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ফুল। হিমালয়ের অপর প্রান্তের চীনও পিছিয়ে নেই রডোডেনড্রন চর্চায়। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের কুইচৌ প্রদেশের বি চিয়ে এলাকায় ১২৫.৮ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে রডোডেনড্রন উদ্যান। এখানে রয়েছে ৪১ জাতের রডোডেনড্রন ফুল এবং এশীয় অঞ্চলের সবগুলো প্রজাতি। প্রাকৃতির রঙিন ফিতার মতো ঝলমল করছে চীনে রডোডেনড্রনের প্রাকৃতিক বাহার।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর