বিশ্বায়নের দূত রডোডেনড্রন
বর্তমানের মতো সুতীব্র বেগে বিশ্বায়ন তখনো শুরু হয় নি। তবে ইউরোপে রেনেসাঁ-রিফর্মেশন-শিল্প বিপ্লব হওয়ায় পূর্ববর্তী আমলের পালের বদলে দ্রুতগামী জাহাজ নিয়ে বণিক ও ঔপনিবেশিক শক্তি এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার নানা দেশ দখলে ব্যস্ত। তখনকার সেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্রান্তিকালের মধ্যেও ভারতবর্ষের পূর্ব হিমালয়ান অঞ্চলের নামগোত্রহীন একটি পার্বত্য ফুল চলে গেল ইউরোপের ঘরে ঘরে, এমন কি মহারানির বাগানে। সে ফুলের নাম রডোডেনড্রন।
নাম শুনলে মনে হবে ইউরোপীয় কোনও ফুল। কিন্তু একেবারেই উপমহাদেশীয় ফুল রডোডেনড্রন। চুপিসারে শতবর্ষ আগেই আদি বিশ্বায়নের দূত হয়ে এশিয়ার এক নিভৃত কোণ থেকে গিয়ে পুরো ইউরোপ জয় করলো। রাজকীয় বাগান থেকে নাগরিকের বাসগৃহ পযন্ত উচ্ছলিত হলো এই ফুলের গুচ্ছে, গন্ধে, বর্ণে। রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসুর লেখা ছাড়িয়ে স্থান পেলো জেমস জয়েসের ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘ইউলিসিস’-এর পাতায়।
ইংল্যান্ডের উইন্ডসর গ্রেট পার্ক এবং অন্যান্য বিশ্ববিখ্যাত উদ্যানে রডোডেনড্রনের মন মাতানো সমারোহ ইউরোপের এক পরিচিত ছবি হয়ে দাঁড়াল। অথচ অযত্নে অবহেলায় হিমালয়ের পার্বত্য ধুলায় মুখ লুকিয়ে ছিল রডোডেনড্রন। বিলাতের এক তরুণ উদ্ভিদবিজ্ঞানী জোসেফ ডালটন হুকার প্রেমে পড়লেন এই ফুলের। ইংল্যান্ড থেকে সবাই যখন ব্রিটিশ-বাংলায় আসছেন সম্পদের লোভে, জোসেফ ডালটন হুকার তখন সন্ধান করছেন প্রকৃতির রূপ ও রস এবং জীববৈচিত্র। তাঁর হাত ধরে এশিয়ার এই পাহাড়ি ফুলের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপে এবং সেই সূত্রে বিশ্বের সর্বত্র। দার্জিলিং, সিকিম, নেপাল, আসাম, মেঘালয়, ভুটানের পথে পথে ছড়িয়ে আছে যে ফুল, সে ফুল আজ ইউরোপের অভিজাত সম্ভ্রান্ত পুষ্পের অন্যতম।
শিল্পে, সাহিত্যে, প্রেমে, আবেগে, গানে, কবিতায় রডোডেনড্রনের মতো অন্য কোনও ফুল স্থান করে নিতে পারে নি। উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে হিমালয়ের স্মৃতি বলতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা আর রডোডেনড্রন। জীবনের কোনও এক অংশে দার্জিলিঙ-কাঞ্চনজঙ্ঘায় ভ্রমণ স্মৃতিতে রডোডেনড্রনের রঙিন উচ্ছ্বাস অনেককেই নস্টালজিক করে। স্মৃতি ও অতীত ঝাপসা হলেও ঔজ্জ্বল্য হারায় না বহুবর্ণা ও বহু বাহারের প্রেমমথিত রডোডেনড্রন গুচ্ছ।
রবীন্দ্রনাথ যেন এ ফুলের যথার্থ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অপরূপ করে রেখেছেন ‘শেষের কবিতা’য় উদ্ধৃত পংক্তিকে: “প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে অরুণকিরণে তুচ্ছ/উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ।” অমিত রয় আর কেটি মিত্তিরের আল্ট্রা-মর্ডান প্রেমের পরশ জাগিয়ে দিয়ে রডোডেনড্রন এখনও অনেকের মধ্যে নিয়ে আসে হারানো প্রেমের স্মৃতিকাতর আকুতি।
ব্যক্তি মানুষের মতো সামাজিত মানবমণ্ডলীও রডোডেনড্রনের প্রেমে মগ্ন। নেপালের জাতীয় ফুল আর সিকিমের রাষ্ট্রীয় ফুলের জায়গাটি তাই রডোডেনড্রন ছাড়া অন্য কোনও পুষ্পই দখল করতে পারে নি। ইরান, মধ্য এশিয়া এবং বিশ্বের কোনও কোনও দেশে যেমন গোলাপ রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত পযায়ে সমাদৃত এবং উৎসব মুখরিত হয়, রডোডেনড্রনও তেমনিভাবে পূর্ব হিমালয়ান অঞ্চলের লোকসমাজে সমাদৃত ও উদযাপিত হয়। প্রতি বসন্তে সিকিমে আয়োজিত হয় ‘রডোডেনড্রন উৎসব’। উৎসবে সমবেত হয় বৃহত্তর হিমালয়ান জনগোষ্ঠী। সঙ্গে থাকে শত শত রঙ, বাহার ও প্রজাতির রডোডেনড্রন। পুষ্পালোকের সেই নন্দন-কাননে ভিড় জমায় বিশ্বের হাজার হাজার পযটক।
ফুলকে ভালোবেসে এমন আয়োজন ও সমারোহ পৃথিবীতে আর কয়টি হতে পেরেছে, যেমনটি হচ্ছে নিজের জন্মস্থান ও বিশ্বের উদ্যানে উদ্যানে রডোডেনড্রনকে কেন্দ্র করে। চীনে রয়েছে শতাধিক মাইল বিস্তৃত রডোডেনড্রন উদ্যান। বাণিজ্য, রাজনীতি, যোগাযোগ, সামরিক চিৎকারের সমকালীন বিশ্বায়নের পাশেই সংস্কৃতি ও প্রকৃতির মেলবন্ধন রচনা করার অপরাজেয় শক্তি ‘বিশ্বায়নের আদি দূত রডোডেনড্রন’ ছাড়া আর কে দেখাতে পেরেছে!