শীতে ঘুরে আসুন নীলাদ্রি লেক

, ফিচার

ওসমান জাফর, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 22:03:21

শীতকাল মানে বেরিয়ে পড়ার হিড়িক, শীতকাল মানে বেড়িয়ে আসার হিড়িক। মন আনচান করে দূরে কোথাও ঘুরে আসি, যার অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জাগতিক ক্লান্তি মুছে দিয়ে মনকে করবে চাঙ্গা। জীবনকে করবে আরো উৎফুল্লময় ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। তো, এ শীতে ঘুরে আসতে পারেন—নীলাদ্রি।

নীলাদ্রি কী ও কোথায়
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার টেকেরহাদে নীলাদ্রি লেক অবস্থিত। প্রকৃত নাম শহীদ সিরাজ লেক, যদিও লোকে নীলাদ্রি নামে চেনে। নীলাদ্রি লেক মূলত চুনাপাথরের পরিত্যক্ত লাইমস্টোন লেক। নীল স্বচ্ছ জলের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের কারণে এটি ‘নীলাদ্রি’ নামে পরিচিত।

নীলাদ্রি লেকে কেন যাবেন
নীলাদ্রি লেককে অনেক পর্যটক ‘বাঙলার কাশ্মির’ বলে অভিহিত করে। নীলাদ্রি লেক হচ্ছে অনেকগুলো টিলা, পাহাড়ের সমারোহ যার একপাশে রয়েছে নীল জলের স্বচ্ছ লেক, আবার স্বচ্ছ জলের মাঝখানেও রয়েছে ছোট ছোট ঢিলা। অদূরে ভারত সীমান্তে সুউচ্চ সুবিশাল সবুজ পাহাড়। স্বর্গীয় সৌন্দর্যের সুরমা যেন। যেখান থেকে ভেসে আসছে পাহাড়ের ওপর জন্মানো গাছের পাতার সাথে হাওয়ার মিতালি সুরসঙ্গীত। নীলাদ্রি লেকের জলে অবগাহন করামাত্র আপনি ভুলে যাবেন ভ্রমণ ও জাগতিক ক্লান্তিসকল। মনে হবে, সারাদিন এখানেই জলে অবগাহন করি। তবে মনে রাখবেন, বেশিক্ষণ জলে অবগাহন করলে সর্দি লেগে যেতে পারে। পাহাড়-টিলা আর লেকের স্বচ্ছ জলের প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনার প্রাণে আনবে অনাবিল শান্তির মৌসুম।

নীলাদ্রি বা শহীদ সিরাজ লেক

নীলাদ্রি লেকে যেতে শুকনো মৌসুমে আপনাকে উঠতে হবে বাইকে। যাওয়ার পথে আপনি অনুভব করবেন গ্রামীণ পরিবেশ ও সংস্কৃতির স্বাদ। মাটির রাস্তার দুপাশে সারি সারি সবুজ গাছ-গাছালি। রাস্তার অদূরে সুবিশাল সবুজ পাহাড় চোখ জুড়াবে আপনার। রাস্তার পাশে সুবিশাল বিস্তীর্ণ মাঠে পাকা ধান কাটা হয়ে গেছে, কোথাও কাটা হচ্ছে, কোথাও বা এখনো কাটা হয়নি। পাকা ধানের ওপর মুক্তোর মতোন শিশির বিন্দু। তাতে চিকচিক করছে শীতের নরোম রোদ্দুর।

কৃষকেরা আঁটিবাঁধা ধান মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে ধানের বস্তা, ধানের আঁটি, খড়। মহিষের গাড়িও দেখতে পাবেন। হলুদ পাকা ধানের মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে মহিষ, গরুর পাল, ছাগলের পাল। যেতে যাত্রা বিরতি দিতে হবে। কারণ সময় লাগবে প্রায় চার ঘণ্টা। মহেষখোলায় যাত্রাবিরতি নিয়ে সস্তায় কমলা খেতে পারেন কিংবা এককাপ চা।

নীলাদ্রি লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আপনি নৌকা পাবেন। জলে অবগাহনের সময় পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের পাহাড়ের ওপর জন্মানো কলাপাতার সাথে বাতাসের সম্মিলিত সুরসঙ্গীত শুনতে পাবেন। জলে নামার আগে চাইলে শীতের নরোম রোদ পোহাতে পারেন। নীলাদ্রি লেকের পাশে রয়েছে সিমেন্টের তৈরি বসার জায়গা। সেখানে বসেও সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। পাশেই রয়েছে চায়ের টঙ দোকান। এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে উপভোগ করতে পারেন অপার্থিক সৌন্দর্য। জলের তেষ্টা পেলে ধারেকাছেই কিনতে পাবেন ডাব।

বিস্তীর্ণ মাঠে পাকা ধান

নীলাদ্রির পাশে রয়েছে রেল স্টেশনের পুরানো জংধরা ইঞ্জিন-বগি, যা দিয়ে একসময় পাথর নেওয়া হতো। এখানে দাঁড়িয়ে আপনি চাইলে ছবিও তুলে নিতে পারেন। অবশ্য ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার জন্য দক্ষ ফটোগ্রাফার সেখানে পাওয়া যায়। ফটো প্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা। নীলাদ্রি গেলে আপনি চাইলে টাঙ্গুয়ার হাওড়, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগানও দেখে আসতে পারেন। এক ঢিলে চার পাখির মামলা। তবে হাতে বেশি সময় নিয়ে যেতে হবে। যাতে সব ঘুরে আসা যায়। সেজন্য সকাল সকাল পৌঁছলেই ভালো হয়।

চাইলে ট্রলারে চেপেও নীলাদ্রি যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ট্রলারেই রাত্রিযাপন করতে হবে। ট্রলারে থাকা-খাওয়া ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে। শীতের রাতে জোৎস্ন্যার আলো নদীর জলে স্বর্গীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। নদীর জলের ওপর কুয়াশার চাদর ভেসে আসছে, চারপাশ কুয়াশায় ঘিরে আছে—এ এক মোহনীয় দৃশ্য। তবে, ট্রলারে করে গেলে একইসাথে টাঙ্গুয়ার হাওড় আর নীলাদ্রি দুটোই দেখতে পারবেন।

নীলাদ্রি লেকে কিভাবে যাবেন
রুট প্ল্যান–১
প্রতিদিন ঢাকার সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে মামুন ও শ্যামলী পরিবহনের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এবং মহাখালী থেকে ছেড়ে যায় এনা পরিবহনের বাস। নন-এসি বাসে জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ৫৫০ টাকা আর সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। সুনামগঞ্জ শহরের নতুন ব্রিজ এলাকা থেকে টেকেরঘাট যাবার জন্য মোটর সাইকেল ভাড়া পাবেন। রিজার্ভ নিলে মোটরসাইকেল ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। যাত্রা পথে যাদুকাটা নদী পার হওয়ার সময় জনপ্রতি ৫ টাকা এবং মোটর সাইকেলের জন্য ১০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।

সুনামগঞ্জ থেকে মোটর সাইকেলে লাউড়ের গড় পর্যন্ত আসতে ভাড়া লাগবে ২০০ টাকা। সেখান থেকে যাদুকাটা নদী পার হয়ে বারিক্কা টিলা থেকে ১২০ টাকা ভাড়ায় টেকেরঘাট যাবার মোটর সাইকেল পাবেন। উল্লেখ্য, মোটরসাইকেল রিজার্ভ কিংবা ভাড়ার ক্ষেত্রে দুইজন ধরা হয়েছে।

নীলাদ্রি লেকে বাইকে যাওয়ার পথ

রুট প্ল্যান-২
ঢাকা থেকে হাওর এক্সপ্রেস নামক একটি আন্তঃনগর ট্রেন রাত ১১টায় যাত্রা করে সকালবেলা মোহনগঞ্জ পৌঁছায়। এই ট্রেনে ২০০ টাকা ভাড়ার মধ্যেও আপনি যেতে পারবেন। মোহনগঞ্জ নেমে সেখান থেকে যেতে হবে মধ্যনগর, সময় লাগবে ১ ঘণ্টা। মধ্যনগর (পিপরা কান্দা ঘাট) থেকে বর্ষাকালে ট্রলার, স্পিডবোট বা নৌকা দিয়ে টেকেরঘাট যাওয়া যায়। আবার নেত্রকোনা থেকেও সরাসরি নৌকা বা ট্রলার ভাড়া করে টেকেরঘাট যাওয়া যায়। তবে শীতকালে নেত্রকোনা থেকে টেকেরঘাট যেতে মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়।

রুট প্ল্যান-৩
বর্ষাকালে আপনি ভিন্ন পথেও যেতে পারবেন। সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে টেকেরঘাট যেতে পারবেন নৌকায়। সুনামগঞ্জ নেমে সুরমা নদীর উপর নির্মিত বড় ব্রিজের কাছে লেগুনা/ সিএনজি/ বাইক করে তাহিরপুরে সহজেই যাওয়া যায়। তাহিরপুরে নৌকা ঘাট থেকে সাইজ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী নৌকা ভাড়া করে নিন। টাঙ্গুয়ার হাওর দেখে টেকেরঘাট যাবেন—এই বলে নৌকা ভাড়া করুন।

ভ্রমণ পরিকল্পনা
নীলাদ্রী লেক, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, বারেক টিলা এবং টাঙ্গুয়ার হাওরের দূরত্ব কাছাকাছি হওয়ায় আপনি চাইলে সময় ভাগ করে পছন্দের জায়গাগুলো দেখে ফেলতে পারবেন। সাধারণত বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণ বেশি উপভোগ্য তাই বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ নীলাদ্রী লেক, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, বারেক টিলা ভ্রমণ করতে ভ্রমণ গাইডের টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ পরিকল্পনা দেখে নিতে পারেন।

প্রাণ জুড়াবে আচমকা পাহাড়-টিলা

এছাড়া শুকনা মৌসুমে কিংবা একদিনে নীলাদ্রী লেক, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, বারেক টিলা দেখতে চাইলে সুনামগঞ্জ শহর থেকে মোটর বাইক রিজার্ভ নিয়ে বারেক টিলা, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান হয়ে নীলাদ্রী লেক ঘুরে আবার সুনামগঞ্জ ফিরে আসতে পারবেন। এক্ষেত্রে সিজনভেদে মোটরবাইক ভাড়া লাগবে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা এবং প্রতিটি বাইকে দুইজন ভ্রমণ করতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন
বড়ছড়া বাজারে পাবেন বেশ কয়েকটি গেস্ট হাউজ। এই সব গেস্ট হাউজে ২০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে রুম পাবেন। তাহিরপুর বাজারেও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। নীলাদ্রি লেকের কাছে বছরাতে নীলাদ্রি আবাসিক গেস্ট হাউজ রয়েছে। সেখানে ৪০০ টাকায় এক রুম পাওয়া যায়। এছাড়া, পুরাতন চুনা পাথরের কারখানার গেস্ট হাউজেও রাত কাটাতে পারবেন।

লেকের পাশে বেঞ্চিতে বসার ব্যবস্থা

কোথায় খাবেন
নীলাদ্রির কাছে জয়বাংলা বাজারে অল্প টাকায় ভালো মানের খাবারের হোটেল পাবেন। মাছভর্তা, হরেক রকম হাওড়ের মাছের তরকারি, হাঁসের মাংস সচরাচর অল্প টাকায় মেলে। শামীম মিয়ার ভাতের হোটেল সেখানকার নামকরা ভাতের হোটেল। বারিক্কা টিলাতেও সাধারণ মানের দেশিয় খাবারের হোটেল রয়েছে। এছাড়া বড়ছড়া বাজার কিংবা যাদুকাটার পাশের টেকেরঘাটের ছোট বাজারে খাবার জন্য মোটামুটি মানের হোটেল পাবেন। 


আরো পড়ুন ➥ হেমন্তের অল্প শীতে ঘুরে আসুন শ্রীমঙ্গল

এ সম্পর্কিত আরও খবর