পরিবেশের ওপর লকডাউনের প্রভাব

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-28 04:16:58

বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু চীন। উহান শহর বিরাণ হয়ে আছে লম্বা সময় ধরে লকডাউনের কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তেমন বাধার সামনে পড়েনি ইতালির মানুষ। সেখানে এখন চলছে ভ্রমণের ওপর সর্বাধিক নিষেধাজ্ঞা। শিল্প-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখর লন্ডনের থিয়েটারগুলো বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে বলা হয়েছে ঘরে থাকার জন্য। বিশ্বব্যাপী এ এক অন্য রকম চিত্র। আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল বন্ধ। সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে মানুষেরা সব বাড়িতে অবস্থান নিয়েছে। কাজ করছে দূরত্ব বজায় রেখে।

এত আয়োজন কেবল করোনাভাইরাস রোধ করার জন্য। ইতোমধ্যে মৃত্যুর হার আশানুরূপ কমেও এসেছে। আর এত পরিবর্তন কিছু অপ্রত্যাশিত ফলাফলও নিয়ে এসেছে। যেহেতু শিল্প-কারখানা, পরিবহন এবং বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে; হঠাৎ নেমে গেছে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের হার। গত বছরের তুলনায় কেবল নিউইয়র্কেই এই নিঃসরণ কমে গেছে ৫০%। অন্য দিকে বছরের শুরুতেই চীনে কমে যায় ২৫%। যেহেতু কারখানাও বন্ধ ছিল তাই কয়লার ব্যবহার কমেছে ৪০ শতাংশ। বাতাসে দূষণের হার কমে গেছে ব্যাপক মাত্রায়। ইউরোপের গবেষণা দেখাচ্ছে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের হ্রাস পাওয়ার খবর। বিশেষ করে উত্তর ইতালি, স্পেন এবং যুক্তরাজ্যে।

শুধু করোনাভাইরাসের মতো অস্তিত্ব সংকটে ফেলা মহামারির মাধ্যমেই এমন দ্রুত পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। চাকুরি হারিয়েছে অনেকেই। ব্যবসা সংকটে পড়ার কারণে লাখো জীবন নিপতিত হয়েছে প্রতিবন্ধকতায়। অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেমে গেছে। নেমে গেছে শেয়ার বাজার। যা গত কয়েক দশক ধরে বে-নজির। একটা বৈশ্বিক মহামারিই চিনিয়ে দিল পরিবেশকে ঠিক কিভাবে দূষিত করে চলছিলাম আমরা।

চীনের পরিবেশে করোনা ভাইরাসের প্রভাব

প্রশ্ন হলো যখন এই মহামারি কেটে গেলে আমরা কি আমাদের পূর্ব অবস্থায় ফিরে যাব? আবার কলকারখানা দিয়ে কালো করব বায়ুমণ্ডল? নাকি বর্তমানে যে হ্রাসমান পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে, তা দীর্ঘস্থায়ী করব? বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণে কেবল যানবাহন ও পরিবহনের অবদানই ২৩ শতাংশ। দুর্ভোগের কারণে মানুষ অবস্থান নিয়েছে বাড়িতে। বন্ধ হয়েছে অযথা ভ্রমণ। ফলে দূষণ কমে এসেছে সর্বনিম্নে। পরিবহনের মধ্যে আবার ড্রাইভিং এবং বিমানচালনা অন্যতম। যথাক্রমে ৭২% এবং ১১%। যতদিন মানুষের জীবন যাত্রা এভাবে চলবে; ততদিন পরিবেশের ওপর প্রভাবটাও থাকবে এমনই।

মহামারির অভিজ্ঞতা
পরিবেশের ওপর দাগ ফেলে যাওয়া মহামারি এটাই প্রথম না। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এরকম প্রাদুর্ভাব কার্বন নিঃসরণকে কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি শিল্পবিপ্লবের আগেও। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুলিয়া পোংগ্রাটজ এ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করে জানিয়েছেন তথ্য। চতুর্দশ শতকে ইউরোপের ব্ল্যাক ডেথ কিংবা ষোড়শ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার গুটি বসন্ত—উভয়েই বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রার ওপর সূক্ষ্ম প্রভাব রেখে গেছে। প্রাচীন বরফ পিণ্ডে ছোট্ট বুদবুদ পরিমাপ করে পাওয়া গিয়েছিল ফলাফল। দুটি মহামারিতেই ব্যাপক হারে প্রাণহানি ঘটেছিল। এর ফলে আগের বসবাসের স্থানগুলো এবং আবাদি ভূমিগুলো পুনরায় বিরাণ হয়ে পড়ে। পরিণত হয় জঙ্গলে। বেড়ে যায় বন্য জন্তুর সংখ্যা এবং কমে যায় বায়ু দূষণ।

মধ্যযুগে ব্ল্যাক ডেথ ছিলো মানব জাতির জন্য ভয়াবহ অভিজ্ঞতা

আজকের মহামারি অবশ্য তেমন মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে না। তবে ভূমি ব্যবহারের বিষয়টা উপেক্ষা করা যায় না। সাম্প্রতিক কালে ২০০৮-৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়ের কথাই ধরা যাক। এক বছরের জন্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল পরিবেশ দূষণ। কারণ বিপুল পরিমাণে কমে গিয়েছিল বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড। পণ্য উৎপাদন, পরিবহন এবং নির্মাণ মিলিয়ে বৈশ্বিক বায়ুমণ্ডলের ১৮.৪% দূষণ ঘটায়। ২০০৮-৯ সালে তা নেমে এসেছিল ১.৩%। তবে ঠিক ২০১০ সালেই অর্থনীতি ঠিক হলে পৃথিবী ফিরে যায় আগের অভ্যাসে।

অভ্যাসের জোর
করোনাভাইরাস পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারে। মানুষকে পরিবেশের পরিস্থিতি এবং দূষণের ভয়াবহতা মনে করিয়ে দিয়ে। গ্রেটা থুনবার্গকে আহবান করা হয়েছিল করোনাভাইরাসের সময়ে কথা বলার জন্য। করোনাপরবর্তী পদক্ষেপ কর্মপ্রণালি কেমন হবে; তা বিশ্বকে সচেতন করা উচিত। জুরিখের এক গবেষণায় দেখা গেছে দারুণ এক ফলাফল। যদি মানুষকে নিজেদের বাইক ও গাড়ি ব্যবহারে বাধা দেওয়া হয়; তদস্থলে বাধ্য করা হয় গণপরিবহন ব্যবহার করার জন্য। তাহলে পরবর্তীকালে তাদের গাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হলেও তার প্রভাব পড়ে না তেমন। প্রায় কাছাকাছি ফলাফল দেখা যায় জাপানের ক্ষেত্রে। যখন মোটরবাইকের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হলো; তখন মানুষ বাধ্য হয়েছে গণপরিবহন ব্যবহার করতে। পরবর্তীতে রাস্তা খুলে দিলেও মানুষ আর পুরনো অভ্যাসে ফিরে যায়নি। গড়ে উঠেছে গণপরিবহন ব্যবহারের নতুন অভ্যস্ততা। অর্থাৎ সময়ের পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী অভ্যাসের দিকে নিতে পারে। করোনাভাইরাসের দিনগুলোতে এ বিষয়গুলো ভেবে দেখার মতো।

সম্মিলিত প্রয়াস
পরিবেশবিজ্ঞানীদের ভাষ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলো পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারে। এতে করে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে আনতে দ্রুততম সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। কেউ চায় না ঠিক এভাবে আমরা বারবার শিক্ষা লাভ করি। চাকুরি ব্যাহত, শিল্প স্থবির, অর্থনীতি নিম্নমুখী, স্বাস্থ্যচিন্তা ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরেও কোভিড-১৯ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল জলবায়ুর প্রতি আমাদের ক্রমবর্ধমান অবিচার। দেখা যাক ভবিষ্যত কী বলে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর