একটি বছরের বিদায় মানে মহাকালের অতল তরঙ্গে একটি ঢেউ হারিয়ে যাওয়া। জীবন বৃক্ষের পাতার মতো ক্যালেন্ডারের বৈচিত্র্যময় পৃষ্ঠাগুলোর ঝরে যাওয়া। বাংলা ১৪২৬ সালও আজকের সূর্যোদয় ছুঁয়ে সূর্যাস্তের অতলান্তে হারিয়ে যাবে চিরদিনের মতো।
কিন্তু আসলেই হারিয়ে যাবে বছরটি? চলে যাওয়ার সাথে সাথেই মুছে যাবে ১৪২৬ সাল? না, তা মোটেও নয়। ঘটনাপ্রবাহের ঘনঘটায়, স্মৃতিতে, স্মরণে মিশে থাকবে শেষ হয়ে যাওয়া বছরটি।
নজরুলের একটি হৃদয়গ্রাহী গানের মতো বছরের চলে যাওয়াকে 'খেলা'র প্রতীকে চিত্রিত করা যায়। বলা যায়, 'খেলা শেষ হলো, শেষ হয় নাই বেলা/ কাঁদিও না, কাঁদিও না/ তব তরে রেখে গেনু প্রেম আনন্দ মেলা।'
একটি বছরের প্রস্তান নিছক একটি খেলার মতোই, মহাকালের প্রলম্বিত বেলা তাতে শেষ হয়না। যদিও বছরটি প্রেম, আনন্দের স্মৃতিচিহ্ন রেখে যায়, রেখে যায় দুঃখ, বেদনার দহন জ্বালা। ১৪২৬ সালও তেমনি অমোচনীয় অক্ষরে, করোনা বিক্ষত অবয়বে, স্বকীয় ঘটনাক্রম অঙ্কিত করে মহাকালের গভীর গহ্বরে চলে গেলো। রেখে গেলো বহুমাত্রিক ঘটনাময়তার অম্ল-মধুর অভিঘাত।
যে অভিঘাতে বাংলা ১৪২৬ সালের তিন ভাগের এক ভাগ সময়কাল তছনছ হয়ে গেছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে। বছরের পুরো শেষভাগটিই এক অভাবনীয় জনশূন্যতা ও আতঙ্কগ্রস্থ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে পৃথিবী ও পৃথিবীর মানব সম্প্রদায়। যে ভয়াবহতার পরিসমাপ্তি ঘটেনি বছরের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই। চলমান রয়ে গেছে ভীতি জাগানিয়া রেশ।
ফলে উৎসবহীন, সামাজিক দূরত্ব ও সঙ্গরোধের বাস্তবতায় বছরের শেষ দিনটিতে চিরাচরিত নিয়মে ঘটা করে 'চৈত্র সংক্রান্তি' পালনের সুযোগ থাকছে না। অথচ আবহমান বাংলার সংস্কৃতিতে ও চিরায়ত বাঙালি জীবনে 'চৈত্র সংক্রান্তি' অনন্য বর্ণপ্রভায় বিরাজমান।
'চৈত্র সংক্রান্তি' মানে শুধু একটি বছরের বিদায় অনুষ্ঠান নয়, বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক আয়োজনও। গ্রাম-বাংলায় মেলা, গৃহস্থ গৃহে আত্মীয় সমাগম ও উৎসবমুখর পরিবেশ, হাট-বাজারে পুরনো হিসেবে খাতা শেষে নতুনের আবাহনও মিশে আছে 'চৈত্র সংক্রান্তি'র পরতে পরতে।
গ্রামীণ বাংলার ফসল তথা কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে মুঘল সম্রাট আকবর তার আমত্য ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে দিয়ে যে 'ফসলি বছর' প্রবর্তন করেছিলেন, তাতে মিশে আছে পল্লী বাংলার আর্থ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। দেড় হাজার বছর স্পর্শ করতে যাওয়া সেই বঙ্গাব্দ বাংলার, বাঙালির জীবনচর্চার সর্বাঙ্গে মিশে আছে।
১৪২৬ বঙ্গাব্দের শেষে করোনাভাইরাসের কারণে সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে আপতকালিন বাস্তবতায় একটি অনিবার্য ছেদ টানতে হচ্ছে। সমাজ ও সংসারের সর্বত্র ব্যাপ্ত আনুষ্ঠানিকতাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হচ্ছে পরিবার-পরিজন আর গৃহাভ্যন্তরে। বড়ই কষ্টকর, তবু অলঙ্ঘনীয় এই স্বেচ্ছায় সীমত আয়োজন।
ফলে নিঃসঙ্গতায় আচ্ছন্ন পৃথিবীতে অতি-নিঃসঙ্গ আবহে বিদায় নিচ্ছে ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। উৎসব-আয়োজনের বদলে ঘরবন্দী মানুষের একান্ত প্রহরগুলোতে বাজছে বছর শেষের বেদনার সুর। তথাপি শত বিরূপতার মধ্যেও ১৪২৬ সালের শেষ দিনটির শেষ সূর্যালোক পৃথিবীর পুরোটা শরীরে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে আশাবাদের অম্লান স্পর্শ আর বিপন্নতার ঘোরতর সঙ্কুলতায় নিমজ্জিত মানব সম্প্রদায়ের কানে কানে বলে যাচ্ছে উত্তরণের প্রত্যয়দীপ্ত মন্ত্র।