আমিই তো বাবা

, ফিচার

মোসলেম উদ্দিন | 2023-08-31 01:39:17

দেড় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি; তাই বাবা যে কেমন, বাবার ভালোবাসা কেমন হয়! তা কোন দিন উপলদ্ধি করতে পারিনি। শৈশব-কৈশোরে আশে-পাশে বন্ধুদের বাবাদের দেখে, বাবার অভাব মিস করতাম! মনে হত আমার যদি বাবা থাকত তাহলে কেমন হত!

তবে এখন আমি একজন বাবা! দুটি মেয়ের জন্য নিজের সর্বোচ্চ উজার করে দিয়ে শান্তি পাই। তাদের ঘিরে আমার বেঁচে থাকা। তাদের মুখে হাসি ফোটানোই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। শত কল্পনা-জল্পনা তাদের নিয়ে। তাদের মুখে হাসি আমার স্বার্থকতা। সবাই তাদের ছেড়ে গেছে কিন্তু আমি যাইনি। কেননা আমি যে বাবা। যে দশ মাস, দশ দিন গর্ভে রেখে ছিলো, সেও তো ফাঁকি দিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে গেছে।

দুইটি মেয়ের মুখ দেখলে জগতের সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাই। ক্ষুধা লাগলে ভাল-মন্দ, আত্মীয়-স্বজন ভাই-বোন প্রতিবেশিসহ সবকিছুকে বিরক্ত মনে হয়। কিন্তু এমন সময় দুই মেয়ে যদি কাছে ছুটে আসে বা কোলে উঠে, তখন ক্ষুধা বা বিরক্ত পালিয়ে যায়। ক্লান্ত শরীর শান্ত হয়ে যায়। তাদের হাসি মুখ আর কোমল হাতের ছোঁয়ায় ভিতরে কি যেন এক অনুভতি কাজ করে। কোলে তুলে নিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলে পৃথিবীর সব ভুলে যাই। এখন মনে হয় এটাই তো বাবার প্রকৃত রূপ।

প্রতিদিন কোন না কোন প্রোগ্রামে যাই। অনেকেই ভালো কিছু খাবার খেতে দেয়। তখন দুটি চাঁদের মতো মুখ আমার সামনে ভেসে উঠে। খেতে পারি না। মন বলে এই খাবারটুকু যদি নিয়ে গিয়ে তাদের মুখে তুলে দিতে পারতাম? না খেয়ে প্যাকেট করে ছুটে আসি বাড়িতে। মীম-রুকু মা খাবার নিয়ে এসেছি। নিজ হাতে যখন তাদের খাবার খুলে খাওয়ায় তখন কিযে তৃপ্তি বোঝাতে পারবো না।

রুকুর বয়স তিন বছর মীমের বয়স আট বছর রেখেই চলে গেলেন তাদের মা না ফেরার দেশে। কাঁধে পড়লো সকল দায়িত্ব। একটি রাত তাদের ছেড়ে বাহিরে থাকিনি। তাদের যে মা নেই। আমিই মা, আমি যে বাবা। এইতো দুই বছর আগে। বন্ধুদের সাথে সুন্দরবন দেখতে যাবো, রাত ৯ টায় জয়পুরহাট রেলস্টেশনে সীমান্ত ট্রেনে উঠলাম। ভেসে উঠলো দুটি মাসুম বাচ্চার মুখ। বন্ধুদের কাউকে না বলে ট্রেন থেকে নেমে ছুটতে থাকলাম আমার বাচ্চাদের কাছে। মা নেই, আমিই তো ওদের সব। আমি যে তাদের একমাত্র ভরসা।

রাত দুইটা রুকুর শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। শরীর পুড়ে যাচ্ছে, তীব্র জ্বরে মেয়ে আমার ভুল বকছে। এতো রাত কি করি, ছোট বাচ্চা সব ঔষুধ তো খাওয়ানো যাবে না। মাথায় পানি আর গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছে দিচ্ছি। কিছুতেই মেয়ের জ্বর নামছে না।নিরূপায় হয়ে বাচ্চাকে বুকে নিয়ে সেই গভীর রাতে ছুটে বের হলাম ডাক্তার বা ঔষুধের দোকানের সন্ধানে। বাজে রাত তিনটা, পুরো শহর বাচ্চাকে বুকে নিয়ে ঘুরছি। ওতো রাতে কি আর এসব পাওয়া যায়। দিশা হারিয়ে এক ডাক্তারে বাড়ির দরজায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। দরজা ধাক্কা দিয়ে, অনেক ডাকাডাকি করে তাকে ঘুম থেকে তুললাম। অনুরোধ করে বাচ্চার চিকিৎসা নিলাম। জ্বর কমলো, বুকের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো মেয়ে। আর আমার বুকে ফিলে এলো স্বস্তি।

তাদের সফলতা, আমার স্বার্থকতা। ৫ম শ্রেণির ফল প্রকাশ। মীম, বাবা আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। ৮ম শ্রেণীর ফল প্রকাশ। মীম, বাবা আমি আবারও জিপিএ-৫ পেয়েছি। একের পর এক মেয়ের সফলতা দেখে নিজেকে একজন গর্বিত আর অহংকারী বাবা মনে করছি। দুনিয়ার সকল স্বার্থকতা মনে হচ্ছে আমার এই কুঁড়ে ঘরে বাসা বাঁধছে।

লেখক: মোসলেম উদ্দিন, সাংবাদিক, হিলি (দিনাজপুর)

এ সম্পর্কিত আরও খবর