তেল আবিব: পরবর্তী কয়েক মাসে রাজনীতিবিদেরা পৃথিবীকে নতুন করে তৈরি করবে। এই কয়েক মাসে পৃথিবীটা তরল এবং নমনীয় হয়ে উঠছে। বৈশ্বিক সংহতি এবং সহযোগিতার মাধ্যমে বর্তমান সংকটকে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। যা পরবর্তীতে আরো ঐক্যবদ্ধ এবং সমন্বয়পূর্ণ পৃথিবী নিয়ে আসবে। অবশ্য আমরা জাতীয়তাবাদী একাকিত্ব এবং প্রতিযোগিতাকেও বেছে নিতে পারি। যা খুব সম্ভবত আমাদের সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলবে। বয়ে আনবে বিচ্ছিন্ন এবং শত্রুতাপূর্ণ পৃথিবী।
সার্বিকভাবে নিশ্ছিদ্র নজরদারির শাসন জারি করেও আমরা সংকট মোকাবেলা করতে পারি। অথবা করতে নাগরিক ক্ষমতায়ন এবং বৃহত্তরভাবে সরকারি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মধ্যমে। সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে শক্তিশালী কর্পোরেশনগুলোকে উদ্ধার এবং দুর্বল সাংগঠনিক শ্রমকে ছেড়ে দেবার। অথবা একে নিতে পারে বড় কর্পোরেশনগুলোর লাগাম টেনে ধরা এবং সাংগঠনিক শ্রমকে শক্তিশালী করার সুযোগ হিসাবে। মানবজাতি তার পরিবহন ব্যবস্থাকে পুনর্নিমাণ এবং শক্তির শাখাগুলোতে নজর দিতে পারে। কিংবা নজর দিতে পারে পরিবেশের প্রাধান্যকে বাতাসে ছুড়ে ফেলে সরু অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে। এরকম অজস্র সিদ্ধান্ত আমাদের সামনে আছে বর্তমানে।
এই সংকট রাজনীতিবিদদের হতবাক করে দিয়েছে। তাদের কাছে আগে থেকেই তৈরি করা কোনো পথও নেই। সুতরাং নতুন আদর্শ ও চিন্তার প্রতি তারা উন্মুক্ত। এমনকি সে আদর্শ যদি উন্মাদনাও হয়। কিন্তু একবার যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায়; সেটাই সহনীয় হয়ে উঠবে। আস্তে আস্তে তার ভিন্ন পথ গ্রহণের উপায় কঠিন হতে থাকবে। ২০২১ সালে কারো ক্ষমতায় আসার মানে হলো পার্টি শেষ হয়ে যাবার পর পার্টিতে যোগ দেওয়া। কেবল বাকি থালাবাসন ধোয়ার কাজটা। যতক্ষণ পার্টি চলে; আমাদের নজর কেন্দ্রীভূত এবং সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করতে হবে।
লন্ডন: মহামারিটি পৃথিবীকে খুব অল্প বদলাবে কিংবা আদতে কিছুই বদলাবে না—এটাই আমাদের মনোযোগ হওয়া প্রয়োজন। সবকিছু বদলালেও যেন আসলে সব আগের মতোই থাকে।
খুব সংক্ষেপে এটাই ২০০৮ সালে ঘটেছিল। গোটা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চোখে দেখলে আমরা জিতেছিলাম। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি শান্তি। কিছু অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজ, উচ্চ ব্যাংক পুঁজির শর্তাবলি, সক্রিয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আছে সত্য; কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মেরামত আসেনি। হয়নি বৈশ্বিক বাজার কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
এইবার কেন একই রকম হবে না? ২০০৮ সালে বৈশ্বিক নেতাদের একটা দল প্রস্তুত ছিল। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাজ করছিল স্বদিচ্ছা ও সক্ষমতা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অনুপস্থিত। আমরা জানি কী প্রয়োজন ছিল—স্বাস্থ্যসেবার সঠিক সামগ্রী, ছিমছাম এবং সহানুভূতিশীল সামাজিক নিরাপত্তা, লাভের চেয়ে সমাজকে গুরুত্ব দেওয়া, ব্যবসায় সচল বাজারব্যবস্থা, সরকার এবং বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা বিশেষ লক্ষ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা। সম্ভবত এই সত্যটা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমরা।
আমরা জানি আগের মতোই ব্যবসায় ফেরা ঠিক হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—মানুষ কি সেই নেতাকে নির্বাচন করবে, যে মহামারি পরবর্তী নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করতে সক্ষম? অবস্থাদৃষ্টে প্রশ্নটির উত্তর ‘না’ বলেই অনুনাদ উঠেছে। কিন্তু আমেরিকার আসছে নভেম্বরে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচন কিছুটা আলোর আশ্বাস দেয়।
মিয়ামি: ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন মৌলগত বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু একটা ভ্যাক্সিন বের করা, বিশ্ব অর্থনীতি পুনরায় চালু করা এবং আরো একটা মহামারির আগমনকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন গভীর সহযোগিতা।
বিশ্বসংকটের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমাদের কাছে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আছে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে তথ্য নিয়ে অন্য প্রান্তে বিশ্লেষণ, ভ্যাক্সিন অনুসন্ধান কিংবা স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে প্রয়োগ করা যেতে পারে। কন্টাক্ট ট্রেসিং এপ্লিকেশনগুলো ভবিষ্যতের মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ করতেও পর্যাপ্ত তথ্য দেবে। স্বাস্থ্য পরিষেবা সামগ্রীর সীমিত অবস্থায় থ্রিডি-প্রিন্টিং সামনে আনা যেতে পারে। যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর বিশ্লেষণিক পদ্ধতি সঠিক উপাত্তের সাথে মিলে আমাদের কার্যকর বরাদ্দ সরবরাহে সহযোগিতা করবে।
ভবিষ্যত পৃথিবীতে প্রযুক্তি সক্রিয়করণের মধ্যদিয়ে মহামারি আমাদের আরো দৃঢ় পারস্পরিক সহযোগিতার দিকে নিতে পারে। কিন্তু এটা দৈব নির্ধারিত নয়। দেশগুলোর মধ্যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় আমরা জাতীয় প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছি। সাপ্লাই-চেইনে ঝুঁকি সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছে জরুরি সরবরাহ সীমিত কিংবা বন্ধ করে দিতে। ভাইরাস কতিপয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারকে পরিণত করেছে একনায়কতান্ত্রিকে। ব্যক্তির গোপনীয়তা খর্ব এবং কেন্দ্রীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে। সাময়িক উদ্যোগ পরিণত হতে পারে স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে।
মহামারিতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিদ্যমান বৈষম্য প্রকাশিত হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর সময় ডিজিটাল যোগাযোগে থাকা মানুষগুলো অনেক বেশি সজ্জিত। তাদের সন্তানেরা শিখতে পারে এবং তারাও দূরে থেকে কাজ করতে পারে। তাদের এই টেলিজীবন বিঘ্নিত হয়েছে কিন্তু থেমে যায়নি। অপরদিকে কারো জন্য স্যোশাল ডিসট্যান্স পরিণত হয়েছে অসম্ভবে। তাদের বাধ্য হতে হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জীবিকার মধ্য থেকে যে কোনো একটি বেছে নিতে। টেলিজীবনের অনেক কিছুই টিকে থাকবে। প্রয়োজন প্রতিটা মানুষকে আধুনিক জীবনের মৌলিক ডিজিটাল সেবার নিশ্চয়তায় বৈশ্বিক পরিকল্পনা।
বার্লিন: ভাইরাস হঠাৎ করেই আমাদের নিক্ষেপ করেছে সপ্তদশ শতকে। আমরা এখন বাস করছি অভিজ্ঞতার শূন্য কোঠায়। যেখানে প্রায় সবকিছুই নাগালের বাইরে। যেমনটা ছিল প্রাথমিক যুগের আনুমানিক ১৬৬০ সালের দিকের বৈজ্ঞানিক সমাজে। তাদের জন্য প্রায় সব মৌল সমস্যাগুলোতেও ঐকমত্য উত্তর ছিল না।
হঠাৎ নতুনত্ব এবং অনিশ্চয়তা সাময়িকভাবে আমাদের যেন ছুড়ে ফেলেছে গ্রাউন্ড জিরোতে। সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ, আপাত পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সাধারণভাবে উল্লেখযোগ্য মন্তব্য, অপেক্ষাকৃতভাবে কম প্রকাশিত পিয়ার পর্যালোচিত জার্নাল ইন্টারনেটে গুঞ্জন তুলেছে চিকিৎসক, ভাইরোলজিস্ট, এপিডেমিওলোজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং আগ্রহী জনতার মধ্যে।
চরম বৈজ্ঞানিক অনিশ্চয়তার সময়ে পর্যবেক্ষণের সাথে পরীক্ষার সম্পর্ক থাকে খুব দুর্বল। বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান সীমাবদ্ধ হয় নিজের মধ্যেই। যথার্থ একটা ঘটনা, ব্যত্যয়, প্যাটার্ন এবং পারস্পরিক সম্পর্কগুলো—প্রতিটি ক্লিনিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের সমাধানের সূত্র খোঁজাকে পোক্ত করে।
স্কটল্যান্ড: সবচেয়ে বাস্তবধর্মী এবং ব্যয়বহুলসহ সকল স্বাস্থ্যবিধানকে হাজির করা হয়েছে ভাইরাসের সামনে। যদি কিছু না করা হয়; রোগ ছড়িয়ে যাবে আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার শহরগুলোতে। ছড়াবে এমনসব জনপদের মাঝে যাদের রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি, ভেন্টিলেটরস্ এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নেই।
যেখানে সামাজিক দূরত্ব এমনকি হাত ধোঁয়া নিশ্চিত করাটাও কঠিন। কোভিড-১৯ সেখানে টিকে থাকবে এবং বাকি পৃথিবীকে পুনরায় নতুন শক্তিতে আক্রমণ করবে। দীর্ঘস্থায়ী হবে সংকট।
লস এঞ্জেলস: আস্তে আস্তে এবং নিখুঁতভাবে তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের অধিকার। আমাদের সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ এবং নয়া বিধিবিধানের সৃষ্টি আদতে বিপর্যয়বাদী পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য। নাওমি ক্লেইন খুব মুন্সিয়ানার সাথে একে বর্ণনা করেছেন। বিপর্যয়বাদী পুঁজিবাদ আরো বড় পরিসরে জনগণ, গণতন্ত্র এবং শ্রমিক শ্রেণির ওপরে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ, সম্পদ এবং ক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়। আমরা যদি সার্বিক মঙ্গলের স্বার্থগুলোতে সচেতন, মনোযোগী এবং সোচ্চার না হই; তবে কোভিড-১৯-এর জবাব সেভাবেই আসবে।
এটা গ্রহণযোগ্য না যে, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশটা সার্বিক অসহযোগিতার মূল্য দেবে। মহামারিতে আফ্রিকান আমেরিকানদের মৃত্যুহার শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের তুলনায় বেশি। কারণ আমাদের দরিদ্রতা, চাকুরি-নির্ভর স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং সংস্থানহীন জনগোষ্ঠী। যদিও আমাদের শহুরে প্রতিবেশিরাই প্রবল সম্পদে পূর্ণ। মজুদের সঠিক বিন্যাস না করে সবাইকে যার যার মতো চলতে দেওয়াটা অগ্রহণযোগ্য। কোভিড-১৯ এবং আর যে সকল মহামারি সামনে আছে; তাতে সকলেই ঝুঁকির মুখে। এই মহামারি আমাদের চিরন্তন ব্যবস্থার জন্য বিচার দিবস। এই হিসাব-নিকাশ পুরাতনকে বহাল রাখা কিংবা সংস্কার করার মাধ্যমে।