কোভিড নিয়ে মুখোমুখি সমকালীন বুদ্ধিজীবী (২য় পর্ব)

, ফিচার

অনুবাদ ও গ্রন্থনা: আহমেদ দীন রুমি | 2023-08-31 23:06:02

মহামারিতে বেড়েই চলছে মৃত্যুর মিছিল। চীনের উহান থেকে যে যাত্রার শুরু হয়েছিল, তা এশিয়া ও ইউরোপকে ছাপিয়ে ল্যাটিন আমেরিকাকেও নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। ঠিক এই সময়ে করোনার প্রভাব এবং পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন সমকালের বুদ্ধিজীবীরা। আজ থাকছে তার দ্বিতীয় কিস্তি।


কোভিড নিয়ে মুখোমুখি সমকালীন বুদ্ধিজীবী (১ম পর্ব)

ব্রিস্টল: মহামারির আগে বৈশ্বিক কাঠামো ছিল চরম রকম ভঙ্গুর। ভাইরাস যদি নাও দেখা দিত; কতিপয় কারণে অর্থনৈতিক ধস কিংবা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ঘটনাগুলোর ধাক্কা আছড়ে পড়ত। মহামারিতে পাশ্চাত্যের আধিপত্য হ্রাস, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিচ্ছিন্নতা ত্বরান্বিত হয়েছে। আসলে মৌলগতভাবেই দুনিয়ার অবস্থা বদলে গেছে। যদি চীন এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে জন-নিয়ন্ত্রণের জন্য নজরদারি বৃদ্ধির ইস্যুটাকেও গণ্য করা হয়; তবে বাস্তব যোগাযোগ থেকে সরে এসে ভার্চুয়াল যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ—সব মিলিয়ে অনিবার্যভাবে বদল ঘটেছে পটভূমি।

জন গ্রে
এমিরিটাস অধ্যাপক, লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স

প্রোগ্রেসিভ লিবারেলিজমের মতো সাম্প্রতিককালের কোনো চিন্তাই অতীতের নস্টালজিয়ায় ভুগছে না। অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃস্থ—উভয় ক্ষেত্রেই লিবারেল প্রজেক্ট হলো স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। অন্তত অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবার পূর্ব অব্দি। ভাইরাসের বয়ে আনা পয়গাম হলো—ভুলে যাও। হোক ভালো কিংবা মন্দ; সে পৃথিবী চিরতরেই চলে গেছে। চীন, রাশিয়া এবং ভারতের নেতারা বিষয়টা ধরতে পেরেছেন। পশ্চিমা নেতারা যাই করবেন, থাকবেন পর্যবেক্ষণে।


মিলান: আমাদের জেনারেশন যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এটা এমন যুদ্ধ, যেখানে ডাক্তারেরা থাকে ফ্রন্টলাইনে আর সেনাবাহিনী পেছনে কফিন বহনের জন্য। আমাদের নায়কেরা প্রতিদিন যুদ্ধ করছে। অনুরূপ দলত্যাগীরা ট্রেঞ্চ থেকে নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের যুদ্ধের পরিস্থিতি জানানোর জন্য খবর আসে। অনেক ফ্যাক্টরি এই যুদ্ধের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহে রত। আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় অবদান হতে পারে ঘরে অবস্থান করা; যাতে সংক্রমণ ঘটতে না পারে।

ডেভিড ক্যাসালিজ্জো
ফাইভ স্টার মুভমেন্টের পুরোধা ব্যক্তিত্ব

নতুন যুগে প্রবেশ করেছি আমরা। যা কিছুকে অসম্ভব মনে করা হতো; তা এখন খুব স্বাভাবিক। গোটা ব্যবস্থায় ঝাঁকি দিয়ে শুরু হচ্ছে নয়া অর্থনীতির যুগ। যেমনটা হয়েছিল প্লেগের সময়ে। মধ্যযুগের পোপতান্ত্রিকতার ব্যর্থতায় মানুষ মনোযোগ দিয়েছিল বিজ্ঞাননির্ভরতার দিকে। আমরা আবিষ্কার করলাম এমন সব জায়গাও; ম্যাপে যেখানে ড্রাগনের কথা বলা থাকত। আবিষ্কার করলাম আমাদের চিন্তার চেয়েও বেশি কিছু।

এই মহামারি সমাজে নতুন ঝাঁকি। যেখানেই অসম্ভবকে দেখছি; যেখানেই ড্রাগনের আখ্যান প্রচলিত—তা এখন আবিষ্কার করার সময়।


ক্যামব্রিজ: কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা করছে, মহামারি কী কী পরিবর্তন ঘটাবে। বাকিরা দেখছে, কী পরিবর্তন হওয়া উচিত। ভবিষ্যদ্বাণী আর প্রায়োগিক আলোচনা ভিন্ন ব্যাপার। এই স্বাভাবিকতার সংজ্ঞায়ন ভবিষ্যতে ভালো কিছু বয়ে আনবে না। বিশ্বায়ন আমাদের কতিপয়কে অগাধ সম্পদশালী করেছে। গড় আয় বৃদ্ধি, বৃহত্তর বৈষম্য এবং আর সেই সাথে জটিল অর্থনৈতিক সরবরাহ। বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং মহামারি তো আছেই। একে কি স্বাভাবিক বলা যায়?

ওনোরা ও’ নেইল
এমিরেটাস অধ্যাপক, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়

এক্সপোজার বাড়িয়ে দিতে পারে ব্যক্তিমালিকানাধীন পণ্য, মুনাফা এবং ব্যয়। কিন্তু বাজারকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় জনগণকে প্রয়োজন অনুপাতে পণ্য দেওয়া সম্ভব না। দেওয়া সম্ভব না স্বাস্থ্য ও পরিবেশের নিরাপত্তা। জনগণের সম্পদ তদারকিতে আইনের শাসন ও যথার্থ ব্যবস্থাপনার মতো অনেক ধরনের প্রশ্নই উঠতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সরকার এবং জনগণ—উভয়পক্ষের সক্রিয়তা। 

ভবিষ্যতে কেমন স্বাভাবিকতা হবে, সেই বাণী দেবার চেষ্টা না করে আমাদের উচিত ভবিষ্যতের জন্য কাজ করা। যেন জনগণের জানমাল এবং মানুষের ভবিষ্যত নিরাপদ হয়।


লস এঞ্জেলস্: নতুন শিক্ষাগুলোর মধ্যে প্রধান হলো জাতীয় পরিচয়ের বৃদ্ধি। বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের বৈশ্বিক পরিচিতি নিয়েই নামা উচিত। কিন্তু মানুষ তা মোটেও করছে না।

জ্যারেড ডায়মন্ড
‘গানস্, জার্মস্ এন্ড স্টিল’ গ্রন্থের লেখক

বর্তমান সংকট অন্তত এটুকু বুঝিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীর সকলেই এক নৌকার যাত্রী। বুঝতে পারছি কোভিড-১৯ আসলে জলবায়ু পরিবর্তন, পারমাণবিক অস্ত্র এবং বৈষম্যের মতোই সকলের জন্য সমস্যা।


বেইজিং: প্রাচীন চীনের খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতাব্দীর কোনো সময়ে জি চেন নামে এক সফল শাসক ছিলেন চেং রাজ্যে। একদিন রাজ্যের কর্মকর্তারা পরামর্শ দিলেন স্কুলগুলো ধ্বংস করে দিতে। কারণ, মানুষগুলো স্কুলে জমায়েত হয়েই রাজার সমালোচনা করে। কিন্তু রাজা ভাবলেন, মুক্ত আলোচনা রাজাকে জনগণের হাবভাব বুঝতে সহযোগিতা করবে। সুতরাং তাদের পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করলেন। স্কুল চলতে থাকল।

লি জিংলিন
অধ্যাপক, বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়

জি চেনের সিদ্ধান্তটা ছিল কনফুশিয়াসের রাষ্ট্রদর্শনের মতো। কনফুশিয়াস তাকে বদান্যতার জন্য উল্লেখ করেছেন। রাজনীতির লক্ষ্য কেবল রাজনীতি না; রাজনীতির লক্ষ্য মানুষের জীবন। জনগণের ইচ্ছাকে ধারণ করতে পারার ক্ষমতাই তাকে রাজনৈতিক বৈধতা প্রদান করে। আর মানুষের ইচ্ছা বুঝতে হলে, মানুষকে পুরোপুরিভাবে বলতে দিতে হবে। বদান্য সরকারের জন্য কনফুশিয়াসের জ্ঞান কোভিড পরবর্তী রাষ্ট্রচিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।


নিউইয়র্ক সিটি: যখন অনেক দেশেই আনুষ্ঠানিকভাবে আকাশ, বন্দর ও সীমান্তগুলোতে অভিবাসন কমানোতে উদগ্রীব; তখনও বৈশ্বিক মহামারি নতুন করে অভিবাসনের ঢেউ আনতে পারে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসন।

ডাম্বিসা মোয়ো
অর্থনীতিবিদ

আজ বিশ্বব্যাপী ৭ কোটিরও বেশি মানুষ শরণার্থী এবং বাস্তুহীন জীবন পার করছে। বিশাল সংখ্যক মানুষ নিম্ন অর্থনৈতিক পরিবেশ, ভঙ্গুর জীবনমান এবং ধ্বংসাত্মক জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করছে। বৈশ্বিক মহামারিটি আরো একবার দেখিয়ে দিচ্ছে গরিব দেশগুলোর চিকিৎসাব্যবস্থা কতটা শোচনীয় এবং তাদের জনগণ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।


লস এঞ্জেলস্: স্বাস্থ্যব্যবস্থার ইতিহাসের কোভিড-১৯ একটা দুঃস্বপ্ন। একই সাথে বিজ্ঞানীদের জন্য স্বপ্ন। এটি পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিজ্ঞানীদের পারস্পারিক সহযোগিতার সুযোগ করে দিয়েছে।

প্যাট্রিক সুন-শিয়ং
সার্জন এবং লস এঞ্জল টাইমস্-এর প্রধান

আগেকার দিনে এর নজির বিরল। তারা বুঝেছে, “চিকিৎসা অনুসন্ধানে, ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে আমরা সকলেই এক সারিতে। আমাকে তোমার যতটুকু প্রয়োজন; তোমাকে আমারও ততটুকু।”

এ সম্পর্কিত আরও খবর