ভ্রমণ স্বর্গরাজ্যে ‘সস্তায় খাটছেন’ বাংলাদেশিরা!

, প্রবাসী

মানসুরা চামেলী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 09:09:48

মালদ্বীপ ঘুরে: হুলুমালে দ্বীপ, হোয়াইট বিচে একা দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছিলাম। পাশ দিয়ে একজন যেতেই ‘এক্সকিউস মি, প্লিজ টেক এ পিকচার....’। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলেন; ছবি তোলা শেষে জানা গেল যার কাছে ছবি তুলে নিলাম তিনি আমার স্বদেশি বাংলাদেশি।

মালদ্বীপের কোনো একটা আইল্যান্ডে গেলেন, মুদি দোকানে যাবেন, সুপার শপে, কাঁচা বাজার- যেখানেই যাবেন বাংলাদেশি কর্মীর দেখা পাবেন। মালেতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে ডাব কাটছেন বা সড়কে হাঁটতে গিয়ে কারো সঙ্গে টক্কর খেলেন- একটু আলাপ হলে বুঝবেন তিনিও বাংলাদেশি।

মালদ্বীপে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ।

মালদ্বীপের ১২’শ দ্বীপের বসবাসযোগ্য ২০০ দ্বীপেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বৈধ এবং অবৈধ বা অনিয়মিত বাংলাদেশি কর্মীরা। মালদ্বীপ সরকারের সবশেষ জরিপের তথ্যানুসারে- দেশটিতে সাড়ে পাঁচ লাখের কিছু বেশি জনসংখ্যা। ওদিকে বাংলাদেশ হাইকমিশন, মালদ্বীপের তথ্যে জানা যায়- মালদ্বীপে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ। তবে এর মধ্যে ৫০ হাজারই অবৈধ বা অনিয়মিত। আর এই অনিয়মিত শ্রমিকরাই দিন-রাত সস্তায় খাটছেন ভ্রমণ স্বর্গরাজ্য মালদ্বীপে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন তারা। বেতন-ভাতা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে নিয়মিত কর্মীদেরও।

আরও পড়ুন: জল ডুবুডুবু নীল দেশ মালদ্বীপ!

মালদ্বীপে অবস্থানরত বাংলাদেশি কর্মীরা জানান, মালদ্বীপে নিয়মিত-অনিয়মিত সব বাংলাদেশি শ্রমিকদের মজুরি কম দেওয়া হয়। বিশেষ করে করোনাকালে এখানে বঞ্ছনার সীমা ছিল না। প্রচুর কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। অনেকেই ফিরে গেছেন দেশে। কেউ কেউ মুখ বুজে টিকে থাকার লড়াই এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন।

এখন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করে মাসে বাংলাদেশি ২০ হাজার টাকা পান।

এমন একজন শ্রমিক ফায়েজুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ফায়েজুল পরিবারের স্বচ্ছল জীবনের আশায় প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে মালদ্বীপে আসেন। আইল্যান্ড এক্সপার্ট নামে একটা কোম্পানিতে ৪০ হাজার টাকায় (বাংলাদেশি) কাজ শুরু করেন। কিন্তু কয়েক মাস ভালো যাওয়ার পর হঠাৎ করেই বেতন বন্ধ করে দেয় কোম্পানিটি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ালে থাই কোম্পানিটি বাংলাদেশি ১০০ শ্রমিকসহ ৭০০ কর্মীর বেতন না দিয়ে বন্ধ করে দেয়।

আরও পড়ুন: নীলাকাশ থেকে নেমেই নীল জলের অভ্যর্থনা!

এরপর থেকে ফায়েজুলের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বহু কষ্টে স্টেশনারির দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। এখন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করে মাসে বাংলাদেশি ২০ হাজার টাকা পান।

শুধু আমি একা নই, এখানে অনেক বাংলাদেশি কষ্টে আছেন।

ফায়েজুল বার্তা২৪.কমকে বলেন, বহু কষ্টে ছিলাম। যারা নিয়ে এসেছিলো তারা প্রতারণা করেছে। বাংলাদেশে থাকতে যে বেতনের প্রতিশ্রুতি দেয় এখানে এসে অনেক কম সেটা। শুধু আমি একা নই, এখানে অনেক বাংলাদেশি কষ্টে আছেন।

জুয়েল (ছদ্মনাম) নামে এক কর্মী জানান, এখানে বাংলাদেশিরা অনিয়মিত হওয়ার কারণে সবচেয়ে সস্তা শ্রমিক বাংলাদেশিরা। এখানে অনিয়মিত শ্রমিকরা অনেক ছোট ছোট কাজও করছেন। কেউ কেউ দৈনিক লেবার হিসেবেও কাজ করছেন। এতে যারা মাসিক বেতনে চাকরি করেন তাদের থেকেও ভালো উপার্জন করতে পারেন।

এদিকে বাংলাদেশ হাইকমিশন মনে করেন মালদ্বীপের পর্যটনের বিকাশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেক অবদান। দেশটিতে মোট প্রবাসী কর্মীর ৭০ ভাগই বাংলাদেশি। এত কম বেতনে অন্য কোনো দেশের শ্রমিক পাওয়া যায় না। এ কারণে কোম্পানিগুলো চায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে। কিন্তু মালদ্বীপ সরকারের নীতির কারণে এটা হচ্ছে না।

এক বছর আগে দ্বীপরাষ্ট্রটির সরকার অবৈধ নাগরিকদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিয় এক সভায় মালদ্বীপে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়ার এডমিরাল নাজমুল হাসান বলেন, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এক বছরের জন্য বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিক নেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ করেছিল মালদ্বীপ সরকার। তবে সময়সীমা পার হলেও এখনও বাংলাদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হচ্ছে না। তবে যেমন নার্স, ডাক্তারসহ কিছু দক্ষ শ্রমিক মালদ্বীপ নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এক বছর আগে দ্বীপরাষ্ট্রটির সরকার অবৈধ নাগরিকদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ওই সময় প্রায় ৪০ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশি কর্মী নিবন্ধিত হয়েছেন। তবে প্রক্রিয়া এখনও শেষ না হওয়ায় তারা বৈধতা পাননি। আমরা এই কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছি। আশা করছি খুব দ্রুত আবারও নিবন্ধনের এই প্রক্রিয়া শুরু হবে।

মালদ্বীপে হতে পারে বাংলাদেশের জন্য বড় শ্রম বাজার- বলে জানান প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ কমিউনিটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর সাইফুল ইসলাম।

তিনি বার্তা২৪.কম বলেন, সরকারের আন্তরিক চেষ্টা থাকলে মালদ্বীপ হবে বাংলাদেশের বড় শ্রম বাজার। এখানে বাংলাদেশিদের অনেক চাহিদা। বৈধভাবে নিলেও বাংলাদেশি কর্মীদের তারা কম বেতন পাবেন। মালদ্বীপ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ সরকারের উচিত মালদ্বীপে অনিয়মিত বাংলাদেশি কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো।

প্রধানমন্ত্রীর সফর, বাংলাদেশিদের প্রত্যাশা

সম্প্রতি মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিম বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। শোনা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরকে কেন্দ্র করে ভাইস প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপ সফরের গুঞ্জন শুরু হতে আশায় বুক বাঁধছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। এই সফরের মাধ্যমে নতুন করে ওয়ার্ক পারমিট চালু হবে।

প্রধানমন্ত্রীর সফরের চূড়ান্ত দিন-তারিখ এখনও ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত রিয়ার এডমিরাল নাজমুল হাসান। তবে প্রধানমন্ত্রীর সফরে ওয়ার্ক পারমিটের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে প্রাধান্য পাবে বলে জানান রাষ্ট্রদূতও।

রিয়ার এডমিরাল নাজমুল হাসান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে আশা করছি, তার মধ্যে প্রথমত হল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন। বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ কর্মী আনার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করবেন। নতুন শ্রমিক আনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও অনিয়মিত শ্রমিকদের নিয়মিতকরণের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী যখন সরাসরি এদেশের রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করবেন, তখন তারা নিশ্চয়ই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে।

এদিকে রাষ্ট্রদূত জানান, খুব শিগগিরই মালদ্বীপে থাকা বাংলাদেশি কর্মীদের টাকা পাঠানোর বিষয়টি সুরাহ করতে বাংলাদেশের একটি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এখানে আমাদের নিজস্ব একটা ব্যাংক থাকলে কর্মীদের অনেক সুবিধা হবে। তারা লাভবান হবে। অর্থ পাঠানোর খরচও কমে যাবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর