মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে আগাম ভোটদান। ৭ কোটিরও বেশি ভোট ইতিমধ্যেই পড়েছে। ৩ নভেম্বরের ভোট শেষ হলেই শুরু হবে চূড়ান্ত ভোটগণনা। সামনে আসবে মানুষের রায়: ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি জো বাইডেন, কে যাচ্ছেন হোয়াইট হাউসে? প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে এখন চলছে উত্তেজনার শেষ প্রহর।
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নানাবিধ কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক। বাইডেন জিতলে তিনিই হবেন দেশের প্রবীণতম প্রেসিডেন্ট। তার সঙ্গী কমলা হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট হলে, সেটাও হবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু দেশের প্রথম মহিলা বলে নয়, কমলার ভারতীয় পরিচয় তথা শ্বেতাঙ্গ না-হওয়াটাও উল্লেখযোগ্য বিষয়। আর যদি ট্রাম্পই জিতে যান, তা হলে তিনিই হবেন ইমপিচমেন্টের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি জনপ্রিয়তার নিরিখে অনেকখানি পিছিয়ে থেকেও পুনর্নির্বাচিত হলেন। নানা রকমের ঘটনা ও দুর্ঘটনার ঘোলাজল তাই আবর্তিত হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে।
গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের বিষয়টি বেশ জটিল। কত জটিল ও অনিশ্চিত, টের পাওয়া গিয়েছিল বিগত ২০১৬ সালের নির্বাচনে। তখন পপুলার ভোটে হেরেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ট্রাম্প। ক্ষমতায় থেকেও বাস্তব ক্ষেত্রে তিনি তার কথা ও কাজের মাধ্যমে 'অজনপ্রিয়' উপাধি লাভ করেছেন। নির্বাচনী জনমত জরিপেও তার 'অজনপ্রিয়' থাকার প্রতিফলন দেখা গেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেট প্রার্থীর চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছেন রিপাবলিকান প্রার্থী, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
২০১৬ সালের 'প্রশ্নবিদ্ধ' নির্বাচনে জিতে গত চার বছরে বিতর্ক-কুতর্ক আরো বাড়িয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনিই সম্ভবত একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি লাগাতার আক্রমণ করে চলেছেন নাগরিক অধিকার, জনকল্যাণ, গণতন্ত্র, ভিন্নমতী ও অভিবাসীদের। এগুলোই শেষ নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে পরিবেশ রক্ষা, এমনকি চলতি অতিমারির আবহেও কী ভাবে বিজ্ঞানের উপরে চরম আক্রমণ শানাতে হয়, তা-ও নিকৃষ্টভাবে প্রমাণ করেছে রগচটা নামে পরিচিত ট্রাম্প।
বিশ্ব পুঁজিবাদের নেতা, অন্যতম ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র দেশে-বিদেশে নানা সমস্যায়ও পড়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও নাজেহাল হয়েছে অতি ধনবান ও অতি উন্নত দেশটি। মার্কিন দেশে করোনায় ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। ১ কোটি আক্রান্ত হওয়াটাও সময়ের অপেক্ষা, যে সংখ্যাটি পুরো ইউরোপ মহাদেশের আক্রান্তের সমান এবং ভারতে আক্রান্তের সংখ্যার চেয়ে কিছুটা কম। সারা বিশ্বে সাড়ে চার কোটির কিছু বেশি আক্রান্তের সিংহভাগই ট্রাম্প শাসিত মার্কিন দেশের নাগরিক।
সর্বমহল থেকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ এই যে, আগাগোড়া অদক্ষতা আর ঔদাসীন্যে যেভাবে করোনা মহামারির ‘মোকাবিলা’ হয়েছে, তাতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যাটা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণা বলা হয়েছে, 'যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হলে, সবাই মাস্ক পরলে, গোড়া থেকেই র্যাপিড টেস্টের বন্দোবস্ত হলে এবং সর্বোপরি সুযোগ্য নেতৃত্ব থাকলে এই মৃত্যুর অন্তত ৯০ শতাংশ এড়ানো যেত।'
শুধু করোনায় মৃত্যু বা আক্রান্তের আধিক্যই নয়, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, স্বাস্থ্য সেবায় ভারসাম্যহীনতা, সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধিও অব্যাহত ট্রাম্প শাসনে। মার্কিন সমাজের দরিদ্র অংশটাকে আরো জীর্ণ ও বিপন্ন করেছে বর্তমান সরকার। যদিও ট্রাম্প দাবি করেন, 'তার আমলেই সেরা অর্থনীতির মুখ দেখেছে আমেরিকা।' কিন্তু তথ্যই বলছে, প্রাক্-করোনা সময়ে আমেরিকার জিডিপি ওবামা আমলের মতোই— গড়পড়তা ২.৫ শতাংশ। ট্রাম্প এ-ও দাবি করেন, মহামারির আগে পর্যন্ত তার আমলেই দেশের বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন। কিন্তু ওবামা আমল থেকেই যে এই হার কমছিল, সেটা ভুলেও উল্লেখ করেন না তিনি। কৃষ্ণাঙ্গ-উন্নয়ন নিয়ে ট্রাম্পের দাবিও অসার। কারণ, কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকগণই করোনাকালে অর্থনৈতিক ভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও চাকরিচ্যুৎ। এসব তথ্য এখন সামনে চলে আসছে নির্বাচনের প্রাক্কালে।
ভোট উত্তেজনার শেষলগ্নে অভিযোগের আরো অনেক তীর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিগত চার বছরের প্রশাসনকালে ট্রাম্প একটা সাংস্কৃতিক যুদ্ধও চালিয়ে গিয়েছেন। নিজের সমর্থন-ভিত্তি ধরে রাখতে মন্ত্র দিয়েছেন ‘আমেরিকা বনাম ওরা’। অভিবাসন থেকে শুরু করে গর্ভপাতের অধিকার, আগ্নেয়াস্ত্র আইন ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে বিতর্কিত প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন। উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন অতি কট্টর ও উগ্রপন্থী শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীকে। এমনও আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, ভোটের ফল নিজের মনের মতো না-হলে ট্রাম্প এ বার এদেরই অস্ত্র করতে পারেন, যা হবে গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্য চরম অশনিসঙ্কেত।