মাঝে একদিন। তারপর ৩ নভেম্বর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ভোটের শেষ বেলায় ট্রাম্পের কপালে অভিযোগ-মিশ্রিত খেতাব জুটলো করোনার 'সুপার স্প্রেডার'! কেলেঙ্কারিতে সমাপ্ত হলো ট্রাম্পের প্রচারণা।
অভিযোগটি গোঁড়ায় রাজনৈতিক হলেও পরে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাম্প সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি একটি নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ভিত্তিতে অভিযোগের কাঠগড়ায় জায়গা পেলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এমনই এক কেলেঙ্কারির কালিমা মুখে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল আরেক রিপাবলিকান প্রার্থী নিক্সনের।
নিক্সনের বিরুদ্ধে ছিল 'ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি'র অভিযোগ। আর ট্রাম্পের ক্ষেত্রে 'করোনা কেলেঙ্কারি'র দুর্নাম, যার নির্বাচনী জনসভার কারণে ৩০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন সাত শতাধিক মার্কিন নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের পরিচালিত একটি নিরপেক্ষ সমীক্ষার ফলাফলে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এমনই গুরুতর অভিযোগটি উত্থাপিত হয়েছে।
গবেষকদের দাবি, যে সব জায়গায় ট্রাম্প জনসভা বা র্যালি করেছেন, সেখানে জীবনের বিনিময়ে মূল্য চোকাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যে সমীক্ষা করেছেন তার শিরেনাম ‘দ্য এফেক্টস অব লার্জ গ্রুপ মিটিংস অন দ্য স্প্রেড অব কোভিড-১৯: দ্য কেস অব ট্রাম্প র্যালিজ’।
দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে ফ্লোরিডা রাজ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার সভার। বিতর্কও তৈরি হয়েছে। দূরত্ববিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সভায় জনস্রোত নিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অথচ পরিস্থিতি এমন যে, গোটা ইউরোপ এবং আমেরিকাতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। দৈনিক সংক্রমণের পরিসংখ্যান বাড়ছে। তার মধ্যে আমেরিকায় নির্বাচন হচ্ছে আর ট্রাম্পের নির্বাচনী সভায় অনিয়ন্ত্রিত ও বিধি-অমান্যমূলক ভিড় দেখে সংক্রমণ সুনামির আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। আর ট্রাম্পকে বলছেন 'করোনার সুপার স্প্রেডার'।
যদিও প্রত্যেক সভায় করোনা মহামারি মোকাবেলা নিয়ে সাফল্যের দাবি করছেন ট্রাম্প। সবাইকে বলছেন, সংক্রমিত হলে চিন্তা নেই, প্রত্যেকে ঠিক হয়ে যাবেন। যেমনটা তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। যদিও বড় জমায়েত সর্বত্র অনুমোদিত নয়, তবুও ট্রাম্প বড় জনসভা করেই যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নিয়ম ভাঙছেন। অনেকেরই মুখে মাস্ক, শারীরিক দূরত্ববিধির বালাই দেখা যাচ্ছে না। যেজন্য গবেষকরা পর্যন্ত দোষারোপ করেছেন ট্রাম্পকে।
সর্বশেষ স্বাস্থ্য বুলেটিনের তথ্যে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কমপক্ষে ৯০ লাখ। মারা গেছেন প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষ। কিন্তু করোনা ভাইরাসের বিষয়টিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গুরুত্বই দেননি। তার অভিযোগ তার বিরোধীরা এই ইস্যুকে তার পিছনে ব্যবহার করছে। তিনি সতর্ক করছেন এই বলে যে, যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বাইডেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে আবারো লকডাউনে পড়তে হবে। কিন্তু আরেকটি লকডাউন সহ্য করার সক্ষমতা নেই যুক্তরাষ্ট্রের।
ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনও ট্রাম্পের সভাগুলোকে 'সুপার স্প্রেডার' বলে কটাক্ষ করেছেন, যা পরে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। তবে তিনি নিজে কম জনসভা করেছেন, ভার্চুয়াল সভা এবং ড্রাইভ-ইন কর্মসূচির উপর জোর দিয়েছেন বেশি। যেখানে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে হর্ন বাজিয়ে জনতা নিজেদের সমর্থন জাহির করছেন।
এদিকে নির্বাচনী প্রচারণার শেষলগ্নে রাজ্যভিত্তিক নির্বাচনগুলোতে দেখা গিয়েছে, বাইডেন ট্রাম্পের থেকে অনেকটা এগিয়ে রয়েছেন। রিপাবলিকানদের সমর্থনকারী রাজ্যগুলোতেও ট্রাম্পের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে বাইডেনের। কোথাও কোথাও আবার খুব কম মার্জিনেও এগিয়ে রয়েছেন বাইডেন।
জনমত জরিপে বাইডেন কাছাকাছি থাকায় ট্রাম্প হতাশা প্রকাশ করেছেন। কারণ, বাইডেনকে তিনি অনেক দুর্বল প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে থাকেন। ট্রাম্প বলেছেন, 'এটা কি আমার ক্ষেত্রে ঘটবে? কিভাবে আমাদের দু’জনের টাই হতে পারে?'
জাতীয় পর্যায়ের সর্বশেষ জরিপেও জো বাইডেন বেশ ভালভাবে এগিয়ে আছেন ট্রাম্পের চেয়ে। কিন্তু সুইংস্টেটগুলোতে তারা কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছেন। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, যদি ট্রাম্প আবার বিজয়ী হতে চান তাহলে তাকে ২০১৬ সালের মতো ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, আইওয়া এবং অ্যারিজোনার মতো রাজ্যগুলোতে জিতে আসতে হবে। তাকে জিততে হবে কমপক্ষে পেনসিলভ্যানিয়া, মিশিগান অথবা উইসকনসিনের মতো রাজ্যে। তিনি যে বিজয়ী হবেন এ বিষয়ে কিছু রিপাবলিকান আশাবাদী। তবে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, যে ৯ কোটি মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন তারা হয়তো ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন।
এরপরেও বিস্ময়কর বিজয় আশা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নাটকীয়তায় ভরপুর নির্বাচনে রোববার (১ নভেম্বর) দু’দিনের ঝটিকা প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। চষে বেড়াচ্ছেন ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটগুলোতে। দৃশ্যত পুনরায় তার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে বলে প্রায় সব জরিপে মনে করা হলেও তিনি সব হিসাব নিকাশকে 'নস্যাৎ' করে ফিরতে চান হোয়াইট হাউজে। জয়ী হলে আবার চার বছর হোয়াইট হাউজের দখল পাবেন তিনি। না হলে, জর্জ এইচডব্লিউ বুশের সময় থেকে এ পর্যন্ত তিনিই হবেন প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রচার মাধ্যমের খবরে প্রকাশ, রোববার ও সোমবার, নির্বাচনের প্রচারণার শেষ বেলায় ১০টি র্যালিতে অংশ নিচ্ছেন ট্রাম্প। দিনে তিনি পাঁচটি র্যালিতে অংশ নিচ্ছেন। আগামী মঙ্গলবার নির্বাচন। সেদিন সমর্থকদের ঘর থেকে বের করে আনতে যতটা সম্ভব প্রভাবিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। রোববার তার র্যালি করার কথা মিশিগান, আইওয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, জর্জিয়া ও ফ্লোরিডায়। সোমবার প্রচারণা চালানোর কথা নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভ্যানিয়া, উইসকনসিন এবং মিশিগানে। সোমবার রাতের শেষ ভাগে মিশিগানে গ্র্যান্ড র্যাপিডসে তার প্রচারণা শেষ হওয়ার কথা। এখানেই তিনি ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। চার বছর আগে অসম্ভাব্য বিজয়ে তিনি মিশিগান, পেনসিলভ্যানিয়া, উইসকনসিন রাজ্যে জয় পেয়েছিলেন। এই তিনটি রাজ্য কয়েক দশক ধরে ছিল ডেমোক্রেটদের ঘাঁটি।
মোটেও বসে নেই প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেনও। শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় মরণপণ লড়ছেন তিনি। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ট্রাম্পের ব্যর্থতাকে নির্বাচনে মূল ইস্যু বানিয়ে চূড়ান্ত প্রচারণায় ব্যস্ত ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন। তিনিও রোববার (১ নভেম্বর) প্রচারণায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। ছিলেন পেনসিলভ্যানিয়াতে। এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পালন করে নির্ধারকের ভূমিকা।
আর মাত্র একদিন পরেই নির্ধারণ হয়ে যাবে হোয়াইট হাউজের মসনদে কে বসবেন। বাইডেন হবেন নতুন প্রেসিডেন্ট নাকি ট্রাম্পই ধরে রাখবেন আসন। জরিপ ও জনমত যদিও বাইডেনের দিবে, তবুও আশঙ্কার মেঘ কাটছে না। গত ২০১৬ সালের নির্বাচনকালে প্রচারণা ও জরিপে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থেকেও হেরে যান ট্রাম্পের কাছে। এবার চিত্রটি কেমন হবে, ফলাফল প্রকাশের আগে কেউই হলফ করে বলতে পারছেন না।