স্মরণকালের মারাত্মক অনিশ্চয়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র!

, আন্তর্জাতিক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 03:03:04

এখনো তেমনভাবে শীত আসেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পড়েনি তুষার কিংবা বরফ। তবু প্রতিটি মার্কিন নাগরিকের চোখে, মুখে, চেহারায় উদ্বেগের ধোঁয়াটে ছাপ। ২০২০ সালে করোনা দংশিত মার্কিন মুলুকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে তৈরি হয়েছে স্মরণকালের সবচেয়ে মারাত্মক অনিশ্চয়তার নাজুক ও ভীতিকর পরিস্থিতি।

নির্বাচনের আগেই ভয়াবহ অনিশ্চয়তার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ ধরেই স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলে বেড়াচ্ছিলেন, 'নির্বাচনের রায় বিপক্ষে গেলে তিনি তা মানবেন না। আদালতের আশ্রয় নেবেন।' মার্কিন গণতন্ত্রে এমন বক্তব্য অভাবণীয়, অকল্পনীয়।

ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করে বহু মার্কিন নাগরিক নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা ও অচলাবস্থার আশঙ্কা করছিলেন। কিন্তু খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টই যে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদলকে বিপন্ন করবেন, এমনটি স্বপ্নেও কেউ ভাবেননি। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে ২০২০ সালের নির্বাচনে তা-ই হলো, যা দেশটির ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি।

এমনকি ভোট গণনার আগেই ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে বসে আছেন আর একাধিক শহরে ট্রাম্প বিরোধী উত্তজনাকর বিক্ষোভ হয়েছে। ট্রাম্পের সমর্থকরাও বসে থাকছেন না। কোথাও কোথাও তারও সরব হচ্ছেন। মোদ্দা কথায়, ভোট-পরবর্তী সঙ্কট আদালতে ও সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে।

এদিকে ভোট-পূর্ব একাধিক জরিপে ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনের এগিয়ে থাকার যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল, তা খানিক সত্য হলেও লড়াই হচ্ছে হাড্ডাহাড্ডি। ট্রাম্পও ভালো রকমে টক্কর দিয়ে চলেছেন। 'ব্যাটেলগ্রাউন্ড' নামে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলো আর ডাকযোগে দেওয়া আগাম ভোট গণনা হলেই জানা যাবে, কে পাচ্ছেন আগামী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের চাবি। পরিস্থিতি এতটাই দোদুল্যমান যে কোনো ভবিষৎবাণী করাও বিপজ্জনক। 

কারণ ভোট গণনাকালে টগবগ করেছে উত্তেজনার পারদ। ভোট শতাংশের বিচারে বোঝা গিয়েছিল বাইডেন এগিয়ে থাকবেন। সে সমীক্ষায় সম্ভবত ভুল নেই। তবে মাত্র এক শতাংশের মত ভোটে এগিয়ে আছেন বাইডেন। কিন্তু যে কোনো নির্বাচনেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলে ভোট শতাংশ আর আসনের সম্পর্ক একেবারে গুলিয়ে যায়। দেশ জুড়ে ভোট শতাংশে অনেক এগিয়ে থাকলেও লাভ নেই, বরং কম ব্যবধানে এক একটি রাজ্য জিতে নিয়ে সেখানকার সব আসন বগলদাবা করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু রাজ্য আছে যেখানে ভোট না হলেও চলে। তারা সব সময়েই হয় রিপাবলিকান অথবা ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকে আছেন। তাদের নিয়ে আলোচনা কম। অন্য দিকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সেইসব রাজ্য, যেখানে সামান্য শতাংশের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। এগুলোই সুইং স্টেট। দোদুল্যমানতার শেষে এরা কোন দিকে ঘেঁষবেন তার ওপরই নির্ভর করবে সামগ্রিক ভোটের ফল।

মজার বিষয় হলো, বেশি ভোট পেলেই কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না। তা হলে গতবার হিলারি ক্লিনটনই ক্ষমতার আসনে বসতেন। কিন্তু সিকি কোটির বেশি ভোট পেয়েও (যা নাকি ২ শতাংশের বেশি) তিনি হারেন আসনের হিসেবে। এ বারেও সেই একই প্রসঙ্গ সামনে চলে এসেছে। ফলে এক-দু’শতাংশের মত ভোটে বাইডেন এগিয়ে থাকলেও তিনি একেবারেই নিশ্চিন্ত নন। কারণ কম ভোট পেয়েও হিসেব করে কয়েকটি রাজ্যে জিতে গেলেই রিপাবলিকানদের পোয়া বারো।

এমন জটিল হিসেবের কারণে তিন-চার শতাংশ ভোটে বাইডেন এগিয়ে থাকলেও আসনের হিসেবে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি চলছে। সেই সঙ্গে খবর পাওয়া যাচ্ছে বেশ কিচ্ছু রাজ্যে ভোট গণনা নিয়ে যথেষ্ট অশান্তি হবে। ভোটের সম্পূর্ণ ফলাফল আসতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে এমন আশঙ্কার ফলেও উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তার পাল্লা ভারি হচ্ছে।

বৈশ্বিক মহামারি কোভিডের প্রচণ্ড হানায় সারা বিশ্বের চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশি নাজেহাল। বেকারত্ব আকাশস্পর্শী। কালো মানুষের প্রতি অবিচারে ফুঁসছে বড় অংশের মানুষ। মার্চ এপ্রিলে সাধারণ করদাতাদের কাছে কিছু ডলার পৌঁছলেও, তারপর থেকে কিন্তু খুব বেশি কিছু ভাবতে পারেনি প্রশাসন। নির্বাচনের আগে হু হু করে বিক্রি বেড়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের। ভোটের আগে জনগণের কাছে কোভিড প্রতিষেধক পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও অপূর্ণ। ফলে সর্বব্যাপী হতাশা আগে থেকেই ভর করে আছে ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে।

তারপরেও বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন এই নির্বাচনে। যা অনেক সময়েই ক্ষমতা বদলের লক্ষণ। তবে হেরে গেলে নির্বাচনী ফলাফল না মেনে নেওয়ার যে রেওয়াজ, তা সাধারণত পিছিয়ে থাকা অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর। এবার সেই ছোঁয়াচ মার্কিন দেশেও লেগেছে। এতটাই বিভাজনের রাজনীতি ঢুকে পড়েছে সে দেশে যে ট্রাম্প হেরে গেলে নাকি হোয়াইট হাউস না ছেড়ে আইনি লড়াইতে নামবেন। বাইডেনও তেমনটাই বলছেন, যা স্মরণকালের মারাত্মক অনিশ্চয়তার নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে বিশ্বের এক নম্বর শক্তিধর দেশটিকে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর