একদিকে সংঘাত পেরিয়ে যখন নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণ করছেন, তখন অন্যদিকে পণ্ডিতদের কপালে আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার রেখা দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ধসে পড়বে মহা শক্তিধর আমেরিকা।
'আমেরিকার ভবিতব্য' বিষয়ক বিশ্লেষণের দিক থেকে সবার আগে আছেন জাপানি পণ্ডিতগণ। তারা দাবি করেছেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমেরিকার পতন হবে। ঠিক সেভাবেই, যে রূপ পতন হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের।
জাপানের নাগুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কোবায়াসি কোইচি এমন মন্তব্য করেছেন। তার মতে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন হবে। যেভাবে পতন হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। এই পতনকে বিশ্ববাসী নিজের চোখে দেখতে পারবেন বলেই মনে করছেন এই প্রফেসর।
বিশ্বসভ্যতা ইতিহাসে কোনো সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন নতুন কোনো বিষয় নয়। অতীতে বহু অজেয় এবং পরাক্রমশালী রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে তাসের ঘরের মতো।
ইতিহাসে দেখা গেছে, ক্রমান্বয় একটি সভ্যতা বিকশিত হয়ে এক পর্যায়ে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছলে তারপর সভ্যতার অধঃপতন শুরু হয়। অর্থাৎ চরম শিখরে উপনীত হবার মধ্য দিয়ে সভ্যতা লালনকারী জনগোষ্ঠী তাদের বুদ্ধিমত্তা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা তথা যাবতীয় কর্ম প্রচেষ্টা প্রয়োগের মাধ্যমে নিঃশেষিত হয়ে যায়। এমন অবস্থায় তাদের পক্ষে সভ্যতাটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। তখনই সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
তেমন পরিস্থিতিতে সভ্যতার বহিরঙ্গ ও অভ্যন্তরের শক্তির অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে সার্বিক শ্রীহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের অন্তঃদেশীয় ও আন্তঃদেশীয় সমস্যা ও কোন্দল, যা রাষ্ট্রীয় কাঠামো মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়।
এমন ক্ষয়িষ্ণ পরিস্থিতি কিছু দিন থাকার পরই শুরু হয় শীর্ষস্থানীয় সভ্যতার পতন। অবশ্যই প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আবহাওয়া-জলবায়ুতে মারাত্মক পরিবর্তন, নদ-নদীর গতি প্রবাহে পরিবর্তন, বহিঃ আক্রমণ প্রভৃতি কারণেও সভ্যতার পতন ঘটতে পারে। যেমন ঘটে মানবিক বিপর্যয় ও সংঘাতের কারণেও।
বিশ্বসভ্যতার উত্থান-পতনকে কেন্দ্র করে যেসব মতবাদ বা তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানের চর্চায় প্রচলিত রয়েছে, পাঁচটি প্রধান। তবে সবচেয়ে আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য তত্ত্বের জনক বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত ইবনে খালদুন।
ইবনে খালদুন রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিকাশ, উত্থান-পতন, অবক্ষয় প্রভৃতিকে কালিক ক্রমিকতার সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি রাষ্ট্রের আয়ুস্কাল ১২০ বছর নির্ধারণ করে একে ৪০ বছর ব্যাপি তিনটি পর্বে বিভক্ত করেন। প্রথম পর্বে মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে শাসকের প্রতি অনুগত থাকে। দ্বিতীয় পর্বে সূচিত হয় সভ্যতা। এ পর্বে শিথিল হয় আদিম ঐক্যর প্রেরণা। এবং শাসকের কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্যেরও দেখা যায় ফাটল। তৃতীয় পর্বে এসে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায় আদিম ঐক্যবোধ। এবং অনিবার্য হয়ে পড়ে রাষ্ট্রের মৃত্যু তথা সভ্যতার পতন।
সভ্যতার উত্থান-পতন চক্রের পর্যালোচনায় আমেরিকার পরিস্থিতিকে পতনের পথে বলার মতো কারণ দেখা দিয়েছে। বিশেষত, দেশটিতে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর আলোকে পতন ও অবক্ষয়ের আমেরিকার দুর্গতি বিশ্ববাসীর সামনে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে।
এমনই পটভূমিতে জাপানি পণ্ডিত প্রফেসর কোবায়াসি কোইচি আমেরিকার পতন সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে আমেরিকার পতনের। সেগুলো হলো: ১) আমেরিকার বিদেশনীতি, ২) আমেরিকার নাগরিকদের স্বাধীনতা, এবং ৩) আমেরিকায় যন্ত্রের প্রয়োগে আধিক্য।
জাপানি প্রফেসর তার বিশ্লেষণে বলেছেন, আমেরিকায় কিছুদিন আগেই এক কৃষ্ণাঙ্গের ওপর হামলা করে একদল উগ্র শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী। পরবর্তীকালে কৃষ্ণাঙ্গরাও মার্কিন নাগরিকদের ওপর হামলা করে সেই ঘটনার বদলা নেন। ঘটনাটি নিয়ে বেশ শোরগোল পড়েছিল মার্কিন মুলুকে। এই ধরনের দাঙ্গা এর আগেও আমেরিকায় হয়েছে। তবে আগামী দিনে এই ঘটনা আরও বাড়বে। প্রশাসন কার দিকে তাদের সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেবে তার ওপর নির্ভর করবে সেই সময়ের পরিস্থিতি। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থকরা যেভাবে বিদ্রোহ করেছিলেন তা এই ঘটনার নতুন একটি দিক সামনে আনে। বিদ্রোহীদের হাতে যে ধরনের অস্ত্রের হদিস মিলেছে তা অতি উন্নত, বিপজ্জনক এবং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও নাগরিক নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি স্বরূপ।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার পাশাপাশি আমেরিকার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে পরিচালিত একাধিক সামাজিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই মার্কিন দেশে মার্কিনীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। সেদিক থেকে দেখা যায়, কৃষ্ণাঙ্গদের পাশাপাশি অন্য দেশ থেকে আসা বিদেশিরা তাদের আধিক্য বাড়িয়ে চলেছে। এই ধারা চলতে থাকলে আগামী দিনে মার্কিন নাগরিকরা যথেষ্ট চাপের সামনে পড়বেন। তাদেরকে ছাপিয়ে যাবে বিদেশীরা। ফলে মার্কিন রাজনীতি যথেষ্ট পরিমাণে পরিবর্তন হবে। সাদা এবং কালোর এই লড়াইতে শেষ হাসি কে হাসবে সেকথা এখনই বলা না গেলেও অনুমান করা যায়, এই অবস্থা ভয়ঙ্কর রূপ নেবে।
অথচ আমেরিকার প্রকৃত চিত্রটি ছিল ভিন্ন। দেশটি ছিল বিশ্বের সকল দেশ থেকে আগত অভিবাসীদের স্বাগত জানাতে উন্মুখ। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে, বিশ্বের যেকোনও দেশের নাগরিকরা আমেরিকায় গিয়ে কাজ করতে বা থাকতে পছন্দ করতেন। যা ছিল আমেরিকার শক্তি, ঐক্য ও সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি।
কিন্তু ক্রমশ এই ধারার বদল ঘটেছে। খোদ মার্কিন নাগরিকরা এবার বিশ্বের অন্য দেশে গিয়ে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে চাইছেন। সম্প্রদায় ও জাতিগত হিংসার বিষবাষ্প প্রায়ই নাগরিক ও সমাজ জীবনকে রক্তাক্ত করছে। উপরন্তু আমেরিকার বিদেশনীতি আক্রমণাত্মক, যুদ্ধবাজ ও অমানবিক রূপে সমালোচিত হচ্ছে। দেশের ভেতরে ও বাইরে আমেরিকার এহেন অবক্ষয়ের চিত্র দেশটির দুর্বলতা ও পতনের পদচিহ্ন বলে মনে করছেন পণ্ডিতগণ।
ফলে প্রশ্ন ও বিতর্ক উঠেছে এই বলে যে, আগামী ১০ বছরেই কি ভেঙে যাবে আমেরিকা? এটা অনেকটা অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় প্রশ্ন বলে মনে হলেও অসম্ভব নয়। আসিরিয়া, ব্যাবিলন, মায়া, ইনকা, অ্যাজটেক, গ্রিক, রোমান প্রভৃতি মহা পরাক্রমশালী সভ্যতার মতোই নিকট-অতীতে ভেঙে পড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। টাইটানিক জাহাজের যেমন নিমজ্জিত হওয়ার কথা না থাকলেও সেটি ডুবে গিয়েছিল, তেমনিভাবে মহাশক্তিধর রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের পতন অভাবণীয় মনে হলেও মোটেই অসম্ভব নয়।
আমেরিকার ক্ষেত্রে চিত্রটি কেমন হবে, তার উত্তর একমাত্র ভবিষ্যতের গর্ভেই লুকিয়ে আছে। আমেরিকার ভবিষ্যতে পতন নাকি পুনরুত্থান লুক্কায়িত রয়েছে, সেটাই এখন বিশ্ববাসীর দেখার বিষয়।