ইরানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদেঘের সরকারকে ১৯৫৩ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত করার সামরিক অভ্যুত্থানটির কলকাঠি নেড়েছিল যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট। এ অভ্যুত্থান ইরানে গণতন্ত্রের যাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ডেভিড ওয়েন।
ওই সামরিক অভ্যুত্থানের ৭০তম বার্ষিকীতে মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডেভিড ওয়েন বলেন, ‘ইরানে ১৯৫৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬ এর ভূমিকা কী ছিল, তা এখন স্বীকার করা উচিত। এতে করে ইরানি তরুণদের চলমান গণাতান্ত্রিক আন্দোলন লাভবান হবে। আর বিশ্বে যুক্তরাজ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে আমি যেসব ভুল করেছি তা আমি ইতোমধ্যে স্বীকার করেছি।’
তিনি জানান, শাহ পরিবারকে হটিয়ে ১৯৫১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু জনবান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মোসাদেঘ সরকার। এসব উদ্যোগের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা, ভূমি সংস্কার, ধনীদের ওপর উচ্চ করারোপ, বিভিন্ন শিল্পের জাতীয়করণ অন্যতম।
সংস্কার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো-পাসিয়ান অয়েল কোম্পানিও (বর্তমানে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম বা বিপি) জাতীয়করণ করা হয়। এতে করে অসন্তুষ্ট হন যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিল।
ক্ষিপ্ত চার্চিল সরকার সামরিক অভ্যুত্থানের তৎপরতা শুরু করেন। মোসাদেঘকে উৎখাত করতে ‘অপারেশন বুট’ নামের একটা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি শুরু করে যুক্তরাজ্যে গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬।
এমআই৬ সঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সহযোগিতা চায়। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান প্রশাসন চার্চিলের যুক্তি-তর্কে আশ্বস্ত হতে পারেনি। তাছাড়া মোসাদেঘ সরকারকে কমিউনিস্টবিরোধী বড় শক্তি মনে করত ট্রুম্যান সরকার। তাই এমআই৬ এর সঙ্গে মিলে তখন অভ্যুত্থান করতে সম্মত হয়নি সিআইএ।
কিন্তু, ডোয়াইট আইজেনহাওয়ার ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সিআইএর অবস্থান দ্রুত বদলাতে থাকে। তারা ইরানে অভ্যুত্থান করতে সম্মত হয়। নতুন অপারেশনের কোডনাম দেওয়া হয় ‘এজ্যাক্স’।
ওই বছরের ১৫ আগস্ট এজ্যাক্স বাস্তবায়ন করা হয়। মোসাদেঘকে বন্দি করা হয়। প্রথমে তাকে জেলে রাখা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি গৃহবন্দি থাকেন।
মোসাদেঘ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ক্ষমতায় ফিরেন রেজা শাহ পাহলভি। শাহের সময় দেশটির বিভিন্ন খনিজ সম্পদে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরানি জনগণের দুর্দশা বাড়তে থাকতে। স্বৈরাচারীর শাসনের ফলে ইরানে ক্ষোভ বাড়তে থাকে, যা এক সময় চরমপন্থার দিকে চলে যায়। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯ সালে দেশটিতে ইসলামিক বিপ্লব হয়।
লর্ড ডেভিড ওয়েন গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘ইরানে যে মোল্লারা ক্ষমতায় আসতে পারে তা নিয়ে ১৯৭৮ সালের শরতে এক টিভি সাক্ষাৎকারে আমি স্পষ্ট করে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, শাহ ইরানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, অর্থনৈতিক দুর্দশা বাড়াচ্ছে। মোল্লারা তা আরও গভীর হবে। অসুস্থ শাহকেও আমি একই কথা বলেছিলাম। তাকে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য অনুরোধ করেছিলাম।’
১৯৫৩ সালে ইরানের সামরিক অভ্যুত্থানে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা ২০১৩ সালে স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তখন ওই সংক্রান্ত অনেক গোপন নথি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেশটি।