ইরান-পাকিস্তানের উত্তেজনা সীমান্তের বিবাদ মধ্যপ্রাচ্যের নয়

মধ্যপ্রাচ্য, আন্তর্জাতিক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2024-01-19 22:37:55

পাল্টাপাল্টি হামলা ঘিরে গত কয়েকদিন ধরে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি চলছে পাকিস্তান-ইরানের মধ্যে। উভয় পক্ষের সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে কূটনৈতিক অচলাবস্থা শুরু হয়েছে। ইরানের হামলার মধ্য দিয়েই মূলত এর শুরু তবে সেই উত্তেজনা কিছুটা কমার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে ইতিবাচক বার্তা বিনিময় করেছে দেশ দুটি। উভয়দেশের পাল্টাপাল্টি হামলার পরে সবাই ধারণা করেছিলো এই উত্তেজনা মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধাবস্থার আগুনে ঘি ঢালবে। তবে দুই দেশের সহাবস্থানের ইঙ্গিত এই উত্তেজনা কমার বার্তাই দিচ্ছে। 

ইরান মঙ্গলবার দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানে কট্টরপন্থী সুন্নি মুসলিম জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে এই অঞ্চলের চারপাশে শকওয়েভ পাঠিয়েছে। দুই দিন পরে, পাকিস্তান প্রতিশোধ হিসাবে আক্রমণ করে বলেছিল যে এটি ইরানের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি ছিল। ১৯৮০-৮৮ ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এটি ইরানের মাটিতে যুদ্ধবিমান দ্বারা প্রথম বিমান হামলা। পাকিস্তান ও ইরান দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ৯০০ কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে।

মঙ্গলবারের (১৬ জানুয়ারি) স্ট্রাইক ছিল পাকিস্তানের সুন্নি জঙ্গি জইশ আল-আদল গ্রুপের উপর ইরানের সবচেয়ে কঠিন আন্তঃসীমান্ত হামলার মধ্যে একটি। ইরান বলছে ইসলামিক স্টেটের সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। জইশের অনেক সদস্য পূর্বে জান্দাল্লাহ নামে পরিচিত একটি অধুনালুপ্ত জঙ্গি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা ইসলামিক স্টেটের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিল।

অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ছড়িয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ আরও গভীর করেছে এই পদক্ষেপ। ইয়েমেন থেকে লেবানন পর্যন্ত ইরান-মিত্র হুথিরা গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে লোহিত সাগরে জাহাজীকরণ সহ মার্কিন ও ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা শুরু করেছে।

ইরান ইরাক এবং সিরিয়ায় হামলা শুরু করার একদিন পরেও বলেছিল যে যথাক্রমে ইসরায়েলি গুপ্তচরবৃত্তি এবং ইসলামিক স্টেট অপারেশনকে লক্ষ্য করে তারা হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে আঘাত হানা সেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে, প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এবং ইসলামি জঙ্গিরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে, পাকিস্তান ও ইরানের কর্মকর্তারা প্রায়ই একে অপরের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ করে।

ইরাক, সিরিয়া ও পাকিস্তানে ইরানের সব হামলার পেছনেই ছিল নিজেদের মাটিতে বা নিজেদের স্বার্থ আক্রান্ত হওয়ার জেরে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা।

গত মঙ্গলবার তেহরান সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা জানায়, যা ছিল গত ৩ জানুয়ারিতে ইরানের প্রভাবশালী নেতা কাসেম সুলেইমানির মৃত্যুবার্ষিকীর ভিড়ে আত্মঘাতী হামলার প্রতিশোধ। সেই হামলার দায় স্বীকার করেছিল ইসলামিক স্টেট। এর জেরেই মূলত ইরানের এই দেশে দেশে হামলার সিদ্ধান্ত।

অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সেনা কর্মকর্তা ওয়েসলি ক্লার্ক বলেন, ইরান মধ্যপ্রাচ্যের নেতা হিসেবে তার ভূমিকাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ইরানের হামলা ঘিরে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক টানাপোড়েন। এর মধ্যে ইসলামাবাদে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে পাকিস্তান। জবাবে তেহরানে পাকিস্তানের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করেছে ইরান। আশপাশের দেশেও এর প্রভাব পড়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা এমন একটি বিষয়, যা দুই দেশের জন্যই উদ্বেগের। আরও বলা হয়েছে যে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান অটুট রয়েছে। আর ভারত বুঝতে পারছে, যে ঘটনা ঘটেছে, দেশগুলো তা করেছে নিজেদের আত্মরক্ষার্থে। চীন দুই দেশকে সংযম দেখাতে ও উত্তেজনা কমাতে বলেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কাজ করছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাট মিলার সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলেছেন।

বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নিঃশেষ করার কথা বলে নিজেদেরকে যেভাবে পরস্পরের স্থায়ী শত্রুতে পরিণত করে চলেছে ইরান ও পাকিস্তান, তার শেষটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা অজানা। পরস্পরের মধ্যে বৈরীতা আরো বাড়বে কি-না, সে সম্পর্কেও কেবল এই দুই দেশই ভালো বলতে পারবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উভয় দেশই মুখে যা বলছে, তার চেয়ে করে দেখাচ্ছে বেশি! একটি করে হামলার ঘটনা ঘটছে এবং সেই হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই অন্য পক্ষের মাটিতে আছড়ে পড়ছে বোমার আঘাত।

পরিস্থিতি যেন আর উত্তপ্ত না হয়—এমনটাই দেখার আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়ে আসছে দুই দেশ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানকে একটি ‘ভ্রাতৃত্বপূর্ণ দেশ’ বলে অভিহিত করেছে। শুধু তাই নয়, ‘সম্মিলিত সমাধান’ খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছে। একই ধরনের কথা বলেছে তেহরানও। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পাকিস্তান একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ’। তিনি আরো বলেছেন, ‘আমাদের হামলা কেবল জঙ্গিদের নিধন করার জন্যই।’

এরই মধ্যে পাকিস্তানের অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব রহিম হায়াত কোরেশি ও ইরানের অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ রাসুল মৌসাভির মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা হয়েছে। তাদের আলোচনায় দুপক্ষের মধ্যে কিছু ইতিবাচক বার্তা বিনিময় হয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) ইরানের পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ রসুল মৌসাভি মাইক্রো ব্লগিং সাইটে এক্সে একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লেখেন, আমি বিশ্বাস করি যে দুই দেশের বিদ্যমান উত্তেজনা সমাধানে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শেষ আশ্রয়স্থল। দুই দেশের নেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জানেন যে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা থেকে শুধু সন্ত্রাসী ও শত্রুরা লাভবান হবে।

তার সেই পোস্টের জবাবে দেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব রহিম হায়াত কোরেশি। তিনি তার ইরানের পররাষ্ট্র সচিবকে ‘প্রিয় ভাই’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, পাকিস্তান-ইরানের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ইতিবাচক আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধানে দুই দেশকে এগিয়ে যেতে হবে। দুপক্ষের মধ্যে আস্থা ও ভরসা পুনরুদ্ধার করা গুরুত্বপূর্ণ। এ আস্থা ও ভরসা সব সময় দুই দেশের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। সন্ত্রাসবাদসহ আমাদের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।’

পশ্চিমা ও আঞ্চলিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, তেহরান ইসলামাবাদের সাথে সংঘর্ষে জড়াবে না, যদিও তাদের প্রক্সি বাহিনী ওই অঞ্চলে নানা শত্রু লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে একটি মাত্র ভুলও বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এই উত্তেজনা দুই দেশের সীমান্তের মধ্যেই চলমান তা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পরার মতো বিবাদ নয় ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর