লিপস্টিক লাগালে ধর্ষিত হতে হবে!

, আন্তর্জাতিক

সেন্ট্রাল ডেস্ক ৩ | 2023-08-24 03:02:15

ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার মন্তব্য নিয়ে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেছে৷ ক্লাসে শিক্ষিকা বলেছেন, খোলামেলা পোশাক পরলে কিংবা লিপস্টিক লাগালে ধর্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়৷ ‘‘লিপস্টিক লাগানো যাবে না৷ পরা যাবে না ‘স্কিন টাইট' পোশাক কিংবা ডেনিম৷ এ সব পরলে নির্ভয়ার মতো অবস্থা হতে পারে৷'' বক্তা, স্কুলের বায়োলজি শিক্ষিকা৷ ভারতের ছত্তিশগড় প্রদেশের রায়পুরের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটেছে৷ ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ, স্নেহলতা শঙ্খওয়ার নামে ওই শিক্ষিকা ক্লাসে ঢুকে আচমকাই ‘নির্ভয়া'-র প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন৷ ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিল্লিতে একটি বাসে নৃশংস ভাবে গণধর্ষণ করা হয় এক তরুণীকে৷ পরবর্তীতে তার মৃত্যু হয়৷ ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে রাস্তায় নামে নাগরিক সমাজ৷ নাগরিক সমাজের তরফ থেকেই যুবতীর নাম দেওয়া হয় ‘নির্ভয়া'৷কিন্তু ঘটনার এত বছর পর রায়পুরের ওই শিক্ষিকা কেন হঠাৎ নির্ভয়ার প্রসঙ্গ তুললেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ছাত্রছাত্রীরাই৷ তাদের অভিযোগ, শিক্ষিকা ক্লাসে ঢুকে আচমকাই বলতে শুরু করেন, নির্ভয়ার ঘটনায় আসলে দোষ ছিল মেয়েটিরই৷ অত রাতে এক যুবকের সঙ্গে কেন বেরিয়েছিল সে? তার পোশাক নিশ্চয়ই ‘সঠিক' ছিল না৷ সে কারণেই তার দিকে আকৃষ্ট হয় ধর্ষণকারীরা৷ বস্তুত, ধর্ষণের জন্য এরপর মেয়েদেরকেই দায়ী করেন ওই শিক্ষিকা৷ ক্লাসে ছাত্রদের উপস্থিতিতেই ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘ঠিকঠাক' পোশাক না পরলে, কিংবা লিপস্টিক লাগালে পুরুষেরা মেয়েদের ভোগ করতে চাইবেই৷ কারণ খোলামেলা পোশাক পরা মেয়েদের চরিত্র সকলেই বুঝতে পারে৷ পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই তারা ওই ধরনের পোশাক পরে৷ একাদশ শ্রেণির কিছু ছাত্র ওই শিক্ষিকার সম্পূর্ণ বক্তব্য গোপনে রেকর্ড করে৷ এরপর বাড়িতে গিয়ে সেই রেকর্ডিং শোনালে অভিভাবকেরা স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন৷ অধ্যক্ষ অভিযোগের কথা মেনে নিয়েছেন৷ ওই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে৷ কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়৷ একজন শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই কি মেয়েদের সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে? গত কয়েকবছরে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা বার বার মেয়েদের সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন৷ বিজেপি নেতা সাক্ষী মহারাজ থেকে আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত, খাপ পঞ্চায়েত থেকে গ্রামের মোরল, মেয়েদের সম্পর্কে একের পর এক তীর্যক মন্তব্য করা হয়েছে৷ তাদের মন্তব্য খবর হয়েছে৷ সাময়িক আলোড়ন হয়েছে৷ তারপর সবকিছু ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে৷ উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানার মতো রাজ্যে মেয়েদের সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য স্বাভাবিক বলেই গণ্য করা হয়৷ কারও বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না৷ কারণ, ভারতীয় আইনে এ ধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই৷ বহু সংগঠন এ বিষয়ে নতুন আইন তৈরির দাবি জানাচ্ছে বহুদিন ধরেই৷ কিন্তু এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো আইন প্রণয়ন হয়নি৷ আপাত প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গেও এ ধরনের মন্তব্য শোনা গিয়েছে বারংবার৷ বিশিষ্ট অভিনেতা, অধুনা বিধায়ক চিরঞ্জিৎ একসময় বলেছিলেন, তার এলাকায় বার বার ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে কারণ, সেখানকার মেয়েরা খোলামেলা পোশাক পরে পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে৷ বিধায়কের সেই মন্তব্য নিয়ে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছিল৷ শুধু তাই নয়, বারাসতের কামদুনিতে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করার পরেও শাসকদলের কোনো কোনো নেতা তীর্যক মন্তব্য করেছিলেন৷ তারও আগে পার্ক স্ট্রিটে সুজেট জর্ডনের ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনায় ‘প্রেক্ষিত' বিচার করার কথা বলেছিলেন তৃণমূলের এক সাংসদ৷ বাম আমলের শেষ দিকে সিঙ্গুরে তাপসী মালিক হত্যার ঘটনায় কুরুচিকর মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন প্রথিতযশা বাম নেতারা৷ এক বিশিষ্ট নাট্যকার এবং মহিলা কবি তাপসী মালিক এবং তার বাবার সম্পর্ক নিয়ে মনগড়া রাজনৈতিক চিত্রনাট্যও লিখে ফেলেছিলেন৷ মনোবিদ এবং সমাজবিদদের বক্তব্য, এমন মন্তব্য চলতেই থাকবে৷ কারণ সমাজমন এখনো বহু যুগ পিছনে বাস করছে৷ সামাজিক বদল না ঘটলে এই সমস্যার সমাধান হবে না৷ তবে একই সঙ্গে তাদের আক্ষেপ, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের মতো নাম করা স্কুলেও শিক্ষকদের মানসিকতা এমন হলে সাধারণ গ্রামীণ স্কুলগুলোর অবস্থা কী?

এ সম্পর্কিত আরও খবর