ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সাত দফা শেষে এরই মধ্যে বিভিন্ন সংস্থা কিংবা সংবাদমাধ্যম এক্সিট পোল বা বুথফেরত জনমত সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেছে। অধিকাংশ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সকে (এনডিএ) ৫৪৩-এর মধ্যে ৩৫০-এর (৬৫ শতাংশ) বেশি আসন পেয়েছে। কিছু কিছু সমীক্ষা-সংস্থা এনডিএকে ৪০০ ওপরে আসন দিয়েছে; যেমনটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও ভবিষ্যদ্বাণী ছিল।
কিন্তু এসব এক্সিট পোলের নির্ভরযোগ্যতা কতটুকু বা আদৌ বিজ্ঞানসম্মত কিনা তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইাতহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতীতে ভারতে অনেকবারই এক্সিট পোল ফলাফল না মিলতে দেখা গিয়েছে। ২০০৪ সালে যখন অটলবিহারি বাজপেয়ীর বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার হেরে যায় সে বছরের জরিপে বলা হয়েছিল, নিশ্চিতভাবেই বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন বিজেপি এবং এনডিএ দেশের ক্ষমতায় ফিরবে। এর পরের ১০ বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স)।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১৪ সালেও। এক্সিট পোলের সে জরিপে বলা হয়েছিল, এনডিএ জিতবে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হবে। কিন্তু ফল প্রকাশের পরে দেখা যায়, এককভাবে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি পেয়েছে ২৮২ আসন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে প্রয়োজন ২৭২। আর এনডিএ জোট পেয়েছে ৩৩৬ আসন। এ ছাড়া রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন ধরলে তো কথাই নেই, অসংখ্যবার এক্সিট পোল জরিপ ভুল তথ্য দিয়েছে।
এমন ঘটনা এক্সিট পোলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও এই সমীক্ষার যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তা-ও নয় বলে জানিয়েছেন তত্ত্বগত স্তরে এবং মাঠপর্যায়ে কাজ করা ভারতের অন্যতম খ্যাতনামা নির্বাচনী ফল বিশ্লেষক অধ্যাপক আফরোজ আলম।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আফরোজ আলম ২০ বছর ধরে নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করছেন এবং এবারেও ১০০০-এর বেশি সদস্যের দল নিয়ে তিনি তা করেছেন।তার বিশ্লেষণেও দেখা যাচ্ছে, এনডিএ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে। তবে ব্যবসায়িক সমীক্ষা সংস্থা বা টেলিভিশন চ্যানেলের মতো অত আসন তিনি এনডিএকে দেননি।
এক্সিট পোলের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না- এই প্রশ্নের উত্তরে আফরোজ আলম বললেন, যত দিন যাচ্ছে, জরিপের প্রক্রিয়া আরও জটিল হচ্ছে। তবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অবশ্যই রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে নানাভাবে সমীক্ষা চালানো হয়, যদিও আমরা কখনো এক্সিট পোল করি না। আমরা নির্বাচন-পরবর্তী পর্যায়ে একটা সমীক্ষা করি। কিন্তু সেটা এক্সিট পোল নয়। তবে এর এখন নানা প্রক্রিয়া রয়েছে, যেমন সামনাসামনি সাক্ষাৎকার, টেলিফোনে নেওয়া সাক্ষাৎকার ইত্যাদি।’
আফরোজ আলম আরও বলেন যে শুধু তথ্য সংগ্রহ নয়, সেটাকে কীভাবে ভাগ করা হবে এবং বিশ্লেষণ করা হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। তার মতে, ‘তথ্য সংগ্রহ কীভাবে হচ্ছে, কোথা থেকে হচ্ছে, কোন সামাজিক গ্রুপ থেকে হচ্ছে-যেমন কোন ধর্মের মানুষ, কোন জাতের মানুষ, কোন লিঙ্গের মানুষ বা কোন অঞ্চলের বাসিন্দা সমীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন-এর সবকিছুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘একটা কেন্দ্রে হয়তো ২৫ লাখ ভোটার রয়েছেন, অথচ মাত্র ১ হাজার ৫০০ জনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। আমরা এর ভিত্তিতে কীভাবে এক প্রতিনিধিত্বমূলক সংখ্যা বলতে পারি? আমরা কতগুলো গ্রুপের কাছে গেছি, তারা কতটা বৈচিত্র্যপূর্ণ, কী ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছে -এমন আরও অসংখ্য ফ্যাক্টরের ওপর বিষয়টি নির্ভর করছে।’
আফরোজ আলম আরও বলেন, ‘এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে আজকের দিনে একজন প্রার্থী, যিনি ভোটে জেতার জন্য ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা খরচ করছেন, তিনি ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা ডেটা কেনার জন্য খরচ করতেই পারেন। ফলে এই ভোটারের মনমর্জি নিয়ে গবেষণা একটা অত্যন্ত বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আর যেহেতু ব্যবসার উদ্দেশ্য গবেষণা নয়, লাভ করা, তাই ডেটা সংগ্রহ এবং তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভোটারের মন বোঝার ইন্ডাস্ট্রির নানা নেতিবাচক দিক থাকবে। সেটা ধরে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।’
তবে এই ডেটা সংগ্রহ ও তার বিশ্লেষণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অবশ্যই রয়েছে, যা অত্যন্ত জটিল এবং স্বল্প পরিসরে বোঝানো সম্ভব নয়, বললেন আফরোজ আলম।