‘মর্ত্যের নরক’ নামে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ানতানামো কারাগারের পৈশাচিক পদ্ধতিই ইসরায়েলের কারাবন্দি ফিলিস্তিনিদের প্রয়োগ করা হয় বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের শেখানো বর্বর কায়দায় বহুদিন ধরে ফিলিস্তিনি বন্দিদের উপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।
রোববার (২৩ জুন) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন কারাগার গুয়ানতানামোর সাবেক ভুক্তভোগীরা যারা বন্দিদশায় দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন, তারা আলজাজিরাকে জানান, ইসরায়েল ‘মার্কিন ধাঁচের’ নির্যাতন ব্যবহার করছে। ফিলিস্তিনি বন্দিদের প্রতি ইসরায়েলি নির্যাতন একই নিদর্শন অনুসরণ করে এবং একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি।
ইসরায়েলি কারাগারে বন্দিদের সমর্থনে ২০২৪ সালের ৩০ মে পশ্চিম তীরের নাবলুসে একটি বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। সে সময় বিক্ষোভ চলাকালীন ইসরায়েলি বাহিনীদের আটক করা কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে চিত্রিত করে একটি পোস্টার ধারণ করেন এক ফিলিস্তিনি নারী।
গুয়ানতানামোর প্রাক্তন বন্দি আসাদুল্লাহ হারুন যখন ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনিদের বন্দি করার সে ছবি দেখেন, তখন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারের স্মৃতিচারণ করেন। তার নিজের সাথে হওয়া অপব্যবহার ও নির্যাতনের মিল খুঁজে পান।
তিনি বলেন, ‘এটি নিপীড়নের সবচেয়ে খারাপ রূপ। যখন আমাকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তখন আমি কোনোভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি। আমি মনে করি, আমেরিকানরা গুয়ানতানামো কারাগারে যা করেছে, ইসরায়েলিরাও সে প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন করছে।’
আসাদুল্লাহ হারুন ২০০৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর কিউবার কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগারে বন্দি ছিলেন। কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাকে বন্দি রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমাকে যখন গ্রেফতার করা হয়েছিল, তখন থেকেই আমাকে অমানসিক মারধর করা হত। আমি বসারও সুযোগ পেতাম না। সবসময় দাঁড়িয়ে থাকতে হত। অনিদ্রা আর অনিশ্চয়তার সাথে বেঁচে ছিলাম। আমাকে বেশ কয়েক দিন ধরে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। সেখানে অনেক বন্দিকে কুকুর কামড়াত। আমাদের খুব কম চিকিৎসা সেবা দেওয়া হত। কোনো নিরাপত্তা ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শারীরিক নির্যাতন সত্যিই খারাপ ছিল কিন্তু সবচেয়ে খারাপ ছিল বিভিন্ন ধরনের মানসিক নির্যাতন। আমি বিশ্বাস করি ফিলিস্তিন, গুয়ানতানামো, বাগরাম এবং আবু ঘরায়েবের বন্দিদের নির্যাতনে খুব একটা পার্থক্য নেই।’
গাজায় বন্দি ও প্রাক্তন বন্দি বিষয়ক কমিশনের মতে, গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েল তার মারাত্মক যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে প্রায় ৫৪ জন ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি কারাগারে নিহত হয়েছেন।
ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বলেছে, তারা কয়েক মাস ধরে ফিলিস্তিনিদের গণ আটক, বন্দীদের অপব্যবহার এবং জোরপূর্বক গুম করার একাধিক প্রতিবেদন পেয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলের শেষের দিকে, ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ ফিলিস্তিনি বন্দিদের নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করে।
এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কারাগারে বন্দিদের নিয়মিত মারধর করা হত, কুকুর দ্বারা আক্রমণ করানো হত, ইসরায়েলি পতাকাকে চুম্বন করতে বাধ্য করা হত, মুহাম্মদ (স.) কে অভিশাপ দিতে বাধ্য করা হত, পানি থেকে বঞ্চিত করা হত। অপর্যাপ্ত খাবার এবং কথায় কথায় উলঙ্গ করা ছিল নিয়মিত ঘটনা।
ইসরায়েলি কারাগারে চালানো বেশিরভাগ অপব্যবহার সৈন্যদের দ্বারা চিত্রিত করা হয়েছে। এটি কুখ্যাত আবু ঘরাইব কারাগারের মতো মার্কিন কারাগারে ইরাকি এবং আফগান বন্দিদের সাথে আচরণের দৃঢ় প্রতিধ্বনি রয়েছে, যেখানে মার্কিন সৈন্যরা ২০০৩ সালে অপমানজনক অবস্থানে বন্দিদের পাশাপাশি নিজেদের ছবি তোলে।
ইসরায়েলে নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাবলিক কমিটি (পিসিএটিআই) এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো ‘ইসরায়েলের কারাগারের ফিলিস্তিনি বন্দিদের প্রতি পদ্ধতিগত অপব্যবহার, নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহার’ বন্ধ করতে জরুরি পদক্ষেপের জন্য নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদককে আহ্বান জানিয়েছে।
আদালাহ, হ্যামোকেড, ফিজিশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটস ইসরায়েল এবং পিসিএটিআই এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে একই চিত্র দেখা যায়। ইসরায়েলের সাতটি ভিন্ন কারাগার এবং সেসব কারাগারে আটক ফিলিস্তিনিদের উপর পদ্ধতিগত সহিংসতা, নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহার পরিচালনার বর্ণনা উঠে আসে এসব প্রতিবেদনে।
আইনজীবীরা বলছেন, ফিলিস্তিনি বন্দিদের প্রতি ইসরায়েলি আচরণ ‘মার্কিন-শৈলীর’ অপব্যবহার ও নির্যাতনের সমস্ত বৈশিষ্ট্য বহন করে।
মানবাধিকার আইনজীবী ক্লাইভ স্ট্যাফোর্ড স্মিথ বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত বিগত ২০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে একটি খুব খারাপ উদাহরণ দিয়েছে যে কীভাবে বন্দিদের সাথে আচরণ করা উচিত।
ক্লাইভ স্ট্যাফোর্ড স্মিথ গুয়ানতানামো বেতে বন্দিদের প্রবেশাধিকার দেওয়া প্রথম আইনজীবীদের একজন ছিলেন। হারুনসহ অনেক ক্লায়েন্টদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।
উল্লেখ্য, গুয়ানতানামো কারাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগার যা বন্দিদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দিদের বিনা বিচারে আটক রাখা হয় এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে বন্দিদের উপর যৌন অত্যাচার, 'ওয়াটার বোর্ডিং'সহ বিবিধ আইনবহির্ভূত উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই বেশি যে এই কারাগারকে ‘মর্ত্যের নরক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই কারাগারটিকে অব্যাহতভাবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতে থাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একে মার্কিনীদের ‘লজ্জা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই কারাগারটি ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের বাইরে কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে এর অবস্থান।