শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) দলের নেতা ও জোট ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের প্রার্থী অনুরা দিশানায়েকে বিজয়ী হয়েছেন। শনিবার অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে দেশটির ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো ভোট গণনার ফলাফলে তাকে বিজযী ঘোষণা করা হয়।
রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় দেশটির নির্বাচন কমিশন (ইসি) আর.এল.এ.এম. রত্মায়েকে অনুরা দিশানায়েকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।
৪২.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন অনুরা দিশানায়েকে। তিনি সর্বমোট ভোট পেয়েছেন ৫৬ লাখ ৩৪ হাজার ৯শ ১৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাজিথ প্রেমাদাসা পেয়েছেন- ৩২.৮ শতাংশ ভোট। তিনি মোট ভোট পেয়েছেন ৪৩ লাখ ৬৩ হাজার ৩৫ ভোট।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) প্রেসিডেন্ট শপথ নেবেন অনুরা দিশানায়েকে। এদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
কে এই অনুরা দিশানায়েকে:
অনুরা দিশানায়েক মূলত মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী এবং চিন্তাগতভাবে চীনঘেঁষা বলে পরিচিত। তিনি ১৯৬৮ সালের ২৪ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার থাম্বুথথেগামায় জন্মগ্রহণ করেন। তারা বাবা ছিলেন একজন শ্রমিক আর মা ছিলেন গৃহিণী।
অনুরা দিশানায়েকে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি তার কলেজ জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পর্যন্ত প্রথম স্থান অধিকার করেন।
দিশানায়েকে স্কুলজীবন থেকেই জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) দলের সঙ্গে যুক্ত হন। তারপর তিনি ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
অনুরা দিশানায়েকে প্রথমে তিনি ইউনিভার্সিটি অব পেরাডেনিয়া পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু জীবনের প্রতি হুমকি আসায় তিনি সেখানে আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। পরে তিনি ১৯৯৫ সালে ইউনির্ভাসিটি অব কেলানিয়া থেকে ফিজিক্যাল সায়েন্সে ডিগ্রি অর্জন করেন।
সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে অনুরা দিশানায়েকে জেপিভির নেতৃত্বে চলে আসেন।
১৯৯৫ সালে দিশানায়েকে সোশ্যালিস্ট স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় সংখ্যক হিসেবে নির্বাচিত হন। তারপর তিনি জেভিপি’র সেন্ট্রাল ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সালে তিনি জেভিপির পলিটব্যুরোর একজন সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন।
সোমাভানসা অমরাসিংহের নেতৃত্বে দল মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার সরকারকে সমর্থন করে। ২০০৪ সালে দিশানায়েকে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার সরকারের কৃষি, পশুপালন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
পরে ২০০৫ সালে এলটিটিইর সঙ্গে সরকারের একটি চুক্তি সই হওয়ার পর জেভিপির অন্যান্য মন্ত্রীর সঙ্গে অনুরা দিশানায়েকেও পদত্যাগ করেন।
২০১৪ সালে অনুরা দিশানায়েকে জেভিপি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।
এরপর তিনি ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর (শনিবার) ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) জোটের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন।
অনুরা দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার আইএমএফের (ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড) সুপারিশে দেশের সরকার অর্থনৈতিক সংস্কার করলে তার কড়া সমালোচনা করেন।
২০২২ সালে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার প্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে অন্য ধরনের উত্থান ঘটে জেভিপির।
মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে ৭০ ও ৮০-এর দশকে দুইবার বিপ্লবের ডাক দেওয়া জেভিপি পরে বিপ্লবের পথ থেকে সরে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে।
সে পথেই ২০২২ সালে ক্ষমতাসীন রাজাপাক্ষে পরিবারকে উৎখাতে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় জেভিপি ও তাদের জোট ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)।
গণঅভ্যুত্থানের একপর্যায়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাক্ষে ও তার ছোটভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাক্ষে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপর খুব শিগগিরই দেশটির নাগরিকদের আস্থা অর্জন করে দিশানায়েকের দল জেভিপি।
দুর্নীতি নির্মূল, অর্থনৈতিক সংস্কার, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মতো জনগণের কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে আন্দোলন করে জেভিপি।
যে প্রশ্নের ঘুরপাকে অনুরা দিশানায়েকে:
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক গড়ে তুলবেন, সে নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, এনিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নও রয়েছে। কারণ, তার দল জেভিপি ঐহিত্যগতভাবেই চীনঘেঁষা। কিন্তু যে জোট এনপিপি থেকে বিজয়ী হয়েছেন, সে জোটের অনেকেই আবার চীনঘেঁষা নন।
এনপিপি জোটের এক ঊর্ধ্বতন নেতা অধ্যাপক অনিল জয়ন্ত সম্প্রতি দ্য উইককে জানিয়েছেন, তাদের দল ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলতে চায়।
তিনি বলেন, ভারত অবশ্যই আমাদের প্রতিবেশী এবং একটি পরাশক্তিও বটে। সম্প্রতি, একটি কৃষি সম্মেলনে ভারত আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমরা দিল্লি ও কেরালা সফর করেছি। আমাদের নেতা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সব বড় শক্তির সঙ্গে বসতে চান।
উল্লেখ্য, শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হয়।
দেশের ১শ ৬০ নির্বাচনি বিভাগে ২২টি নির্বাচনি জেলায় ১৩ হাজার ৪শ ২১টি পোলিংস্টেশনে নেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটি ৩১ লাখ ৩১ হাজার ৭শ ৭৪ জন। এর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ ভোটার শনিবার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোট ভোটারের অর্ধেকের বেশি ভোটার নারী। নারী ভোটারের সংখ্যা মোট ৯০ লাখ।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) মধ্যরাতে ভোটগ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শেষ হয়।
এই নির্বাচনে মোট প্রার্থী ৩৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণার পর এক প্রার্থী মারা যাওয়ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন ৩৮ জন প্রার্থী।
১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতার পর ২০২২ সালে প্রথমবার আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, দেশটি কার্যত দেউলিয়া হয়ে যায়। সেই আর্থিক সংকটে পড়ে ২০২২ সালে পতন হয় রাজাপক্ষে পরিবারের।
জনবিক্ষোভের জেরে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে এবং তার ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটাভুটিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন রনিল বিক্রমাসিংহে।
ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার পার্টির নেতা অনুরার পাশাপাশি ২০২২ সালে রাজাপক্ষেবিরোধী গণবিক্ষোভের অন্যতম নুয়ান বোপেজ পিপলস স্ট্রাগল অ্যালায়েন্স দলের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েছেন।
এছাড়া নির্বাচনে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন, প্রাক্তন সেনাপ্রধান তথা প্রাক্তন মন্ত্রী শরথ ফনসেকা এবং বৌদ্ধদের রাজনৈতিক সংগঠন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)-এর প্রধান তথা প্রাক্তন মন্ত্রী বিজয়দশা রাজাপক্ষে।
শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে হলে একজন প্রার্থীকে ৫১ শতাংশ ভোট পেতে হবে। তবে কোনো প্রার্থী ৫১ শতাংশ ভোট না পেলে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফা (রান-অফ) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হয়।
সূত্র: ডেইলি মিরর