বিদায় ‘এক্সপ্রেস’, স্বাগত অনলাইন মিডিয়া

, আন্তর্জাতিক

সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-31 15:41:40

প্রিন্ট প্রকাশনায় আনুষ্ঠানিক বিদায় নিল বিখ্যাত সাময়িকী ‘এক্সপ্রেস’। যুক্তরাষ্ট্রের মেট্রো যাত্রীদের জন্য বিনা মূল্যে বরাদ্দ সাময়িকীটি প্রকাশনার সুদীর্ঘ ১৬ বছরের ইতি ঘোষণা করেছে গত ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯।

বিখ্যাত দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘এক্সপ্রেস’ মূলত মেট্রো যাত্রীদের জন্য সাপ্তাহিক দিনের প্রকাশিত মুক্ত সংবাদপত্র।

এক্সপ্রেস প্রকাশনা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ হিসেবে ক্রমহ্রাসমান আর্থিক আয়ের কথা উল্লেখ করা হয়। যদিও তারা এ বিষয়ে কোনো আর্থিক ক্ষতির পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেনি। তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, মুদ্রিত কাগজগুলি বর্তমানে আর্থিক আয় হারাতে শুরু করেছে।

রঙিন এবং প্রাণবন্ত এক্সপ্রেস প্রকাশনাটি প্রতিদিন সকালে পাবলিক ট্রানজিট যাত্রীদের, বিশেষত এমন লোকেরা যারা প্রকাশনাটি সাবস্ক্রাইব করেননি তাদের জন্য সহজে ও দ্রুত পাঠযোগ্য করে ডিজাইন করা হতো। এতে আকর্ষণীয় এবং মাঝেমধ্যে কৌতুকপূর্ণ ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে একক সংবাদ, গল্প বা সংবাদ উপস্থাপন করে হাইলাইট করতো।

মূলত প্রকাশিত দৈনিক ‘দ্য পোস্ট’ থেকে সংগৃহিত মিশ্র সংবাদ এবং ফিচারভিত্তিক খবরগুলোকে নিজস্ব সাংবাদিক দিয়ে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে মেট্রো পাঠকদের জন্য প্রস্তত করা হতো।

আনুষ্ঠানিকভাবে এক্সপ্রেস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংবাদমাধ্যমে কর্মরত ২০ জন সাংবাদিক কর্মহীন হয়ে পড়ল।

এক্সপ্রেস’র নির্বাহী সম্পাদক ড্যান ক্যাকাভারো জানালেন, মেট্রো স্টেশন এবং খবরে বাক্সের মাধ্যমে অনেকটা সেকেলে আদলে ৭৫ জন হকারের মাধ্যমে প্রতিদিন সকালে প্রকাশনাটি বিতরণ করা হতো। মূলত ২০০৭ সালে এক্সপ্রেস তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। বলতে গেলে, সে সময় সর্বোচ্চ সুসময়ে ছিল প্রকাশনাটি। ওই সময় প্রতিদিন ১ লাখ ৯০ হাজার কপি ছাপানো হতো। ওই মুহূর্তে, এটি দুর্দান্তভাবে লাভজনক ছিল। সাময়িকীটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে ঘরে ফেরত পাঠকের জন্য বৈকালিক সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

তবে ধীরে ধীরে গত কয়েক বছরে সাময়িকীটি ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে আসে যে, এ প্রকাশনাকে আর লোকসান দিয়ে চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। সার্কুলেশন কমে ১ লাখ ৩০ হাজার কপির নিচে নেমে আসে। মেট্রোতে পাঠক কমে যাওয়া, স্মার্টফোনেই প্রতিদিনের জীবনঘনিষ্ট তথ্য ও সেবা আর ইউটিউবের জনপ্রিয়তার কাছে অসহায় আত্মসর্মপণ করছিল ‘এক্সপ্রেস’। এভাবেই এক্সপ্রেস বন্ধের পেছনের কারণগুলো ব্যাখ্যা করেন ড্যান ক্যাকাভারো।

শহুরে ওয়াইফাই (তারহীন ইন্টারনেট প্রবাহ) প্রযুক্তি বিদ্যার বদৌলতে আধুনিক নাগরিক জীবনে প্রিন্ট কাগজের উপস্থিতি ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে পড়ছে। কঠিন এ সত্যটা এখন আরও বেশি সুস্পষ্ট ও দৃশ্যমান। পাঠক তার প্রয়োজনীয় এবং আগ্রহের খবর স্মার্টফোনের সুদৃশ্য পর্দা থেকেই পেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। 

এক্সপ্রেসে প্রকাশিত বিদায়ী কলামে কাগজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ক্যাকাভারো এসব পরিবর্তনের কথা বলে  লিখেছেন, সোমবার সকালে, আমি ট্রেনে চড়ে কাজ শুরু করলাম। জনাকীর্ণ ব্লু লাইন ট্রেনে শুধু তিনজন এক্সপ্রেস পড়ছিলেন (ধন্যবাদ!)। একজনের নাক ছিল পুরনো কালের বইতে। বাকি প্রায় সবাই স্মার্টফোনে মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন।

তারহীন খবর এবং বিজ্ঞাপনের হালআমলেই এক্সপ্রেস’র মতো সাময়িকী যাত্রীদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। আর তা ব্যবসা সফলও হয়। কিন্তু তার স্থায়ীত্ব খুব বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হলো না। স্মার্টফোনে ওয়াইফাই ইন্টারনেটের জাদুবিদ্যার কাছে ধরাশায়ী হতে হলো জনপ্রিয় প্রিন্ট প্রকাশনাকে। একই চিত্র বোস্টন, নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া এবং শিকাগো শহরের সাময়িকীগুলোর।

বিশ্বব্যাপী মুদ্রিত পত্রিকার পাঠক কাটতি কমে যাওয়া এবং মুদ্রণশিল্পে বিজ্ঞাপনের হার কমে আসা এ ধরনের জনপ্রিয় ও ব্যবসা সফল সাময়িকী প্রকাশনার মুখ থুবড়ে পড়ার প্রধানতম কারণ বলে মনে করেন ড্যান ক্যাকাভারো।

তরুণ পাঠকদের আকৃষ্ট করতে সেলিব্রেটি বিনোদন এবং হালকা মেজাজের খবরের ওপর জোর দিয়ে প্রকাশিত দৈনিকগুলো পাঠক ধরে রাখার অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। যাত্রীদের পাঠ সুবিধার্থে ব্রডশিটের বদলে ট্যাবলয়েড আকারে সাময়িকী প্রকাশ করা হয়। 

যাত্রীকেন্দ্রিক কাগজের ট্রেন্ডলেটের শেষ বেঁচে যাওয়া এক্সপ্রেস, দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গল্পের সাথে খেলাধুলা এবং স্থানীয় সংবাদের সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করতো। বৃহস্পতিবারের সংস্করণে উইকএন্ডের ইভেন্ট এবং বিনোদন সম্পর্কে একটি বিভাগ তুমুল জনপ্রিয় হয়। ফলে এসব খবর প্রকাশে ৮০ পৃষ্ঠা বরাদ্দ করা হয়।

বিশ্বের যাত্রীকেন্দ্রিক বহু কাগজ অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। এ কথার প্রসঙ্গ টেনে ‘দ্য পোস্ট’র নির্বাহী সম্পাদক মার্টিন ব্যারন এক্সপ্রেসের আপেক্ষিক স্থায়িত্বকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, এক্সপ্রেস একটি স্বতন্ত্র প্রাণবন্ত তথ্য পণ্য। কর্মীদের সৃজনশীলতা, তথ্যশক্তি এবং উৎসর্গের দৃশ্যমান প্রতিচ্ছবিই ছিল ‘এক্সপ্রেস’।

যতটা সময় ধরে এটা চলে এসেছে তার নেপথ্যেই ছিল কর্মীরা। মিডিয়ার সমূলে পরিবর্তনের যুগে এতদিন টিকে থাকাই ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। ডিজিটাল পরিবর্তনের ঝড়ে প্রকাশনা শিল্পের গতিধারা ভিন্ন সমীকরণের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। অনলাইনের এ অপ্রতিরোধ্য ধারাকে অস্বীকার করার মতো সুযোগ আর নেই। এটাই সত্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর